প্রশ্নঃ বিদায় হজ্জের ঘটনা বর্ণনা কর। আরাফাতের ময়দানে প্রদত্ত মহানবী (স)-এর ভাষণের বিবরণ দাও।

অথবা, বিদায় হজ্জ উপলক্ষে মহানবী (স)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ বিশদভাবে বর্ণনা কর।

উপস্থাপনাঃ রাসূলুল্লাহ (স)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণ মানবাধিকারের এক শ্রেষ্ঠ সনদ। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারি হযরত মুহাম্মদ (স) ইসলামের মর্মবাণী উচ্চারণ করেছিলেন এ ভাষণে। তাই ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে বিদায় হজ্জের ভাষণ এক চিরন্তন ও শাশ্বত দলীল। মূলত এটা ছিল মহানবী (স)-এর আরাফার ময়দানে প্রদত্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষণ। এ ভাষণের প্রশংসায় ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন- His (Mohammad) life with noblest record of a work nobly and faithfully performed.

বিদায় হজ্জঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত মুহাম্মদ (স) জীবনের শেষ হজ্জ পালনের নিমিত্তে দশম হিজরী সনের ২৫ যিলকদ মােতাবেক ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার। সাহাবী সাথে নিয়ে মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এটাই ছিল মহানবী (স)-এর জীবনের শেষ হজ্জ। তাই একে হাজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজ্জ বলা হয়ে থাকে।

বিদায় হজ্জের ঘটনাঃ মক্কাভিমুখে যাত্রার ১০ দিন পর মহানবী (স) মক্কার ৬ মাইল দূরে যুল হােলাইফা নামক স্থানে পৌছেন। সেখান থেকে সাহাবীগণকে নিয়ে হজ্জের পােশাক পরিধান করে এ কাদশ দিনে মক্কায় প্রবেশ করেন। যিলহজ্জ মাসের অষ্টম তারিখে কাবাগৃহের চারদিকে সাত বার তাওয়াফ করেন এবং মাকামে ইবরাহীম নামক স্থানে সালাত আদায় করেন। সাফা এবং মারওয়া নামক পবর্তদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাত বার সায়ী করেন। যিলহজ্জ মাসের অষ্টম দিনে মীনায় গমন করেন এবং নবম দিনে নামেরা হয়ে আরাফাহ ময়দানে পৌছেন। অবশেষে আরাফার পর্বত চূড়ায় আরােহণ করে। অবিস্মরণীয় ভাষণ দান করেন। এটাই বিদায় হজ্জের ভাষণ নামে প্রসিদ্ধ।

বিদায় হজ্জের ভাষণঃ

১. আল্লাহর প্রশংসাঃ আল্লামা শিবলী নােমানী বলেন, ভাষণের শুরুতেই মহানবী (স) আকাশের দিকে তাকিয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা করেন।

২. জনতার মনােযােগ আকষর্ণঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, এ ভাষণ যে মহানবী (স)-এর জীবনের শেষ ভাষণ তা তিনি পূর্বেই হৃদয়ঙ্গম করেছেন। তাই তিনি বলেন, হে সমবেত মুসলমানগণ! মনােযােগ সহকারে আমার বাণী শ্রবণ কর। সম্ভবত এরপর তােমাদের সাথে আমার মিলিত হওয়ার সুযােগ আল্লাহ আমাকে নাও দিতে পারেন।

৩. আল্লাহর দরবারে উপস্থিতিঃ তিনি বলেন, স্মরণ রেখাে! তােমাদের একদিন আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে হবে।

৪. জবাবদিহিতাঃ তিনি বলেন, তােমাদের সকল কাজের জন্য আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং কখনাে তােমরা সত্য পথ ভ্রষ্ট হয়াে না।

৫. জীবন ও সম্পত্তি পবিত্রঃ স্মরণ রেখাে, তােমাদের জীবন ও সম্পত্তি পরস্পরের নিকট পবিত্র এবং হস্তক্ষেপের অনুপযুক্ত।

৬. স্বামী-স্ত্রী অধিকার সংরক্ষণঃ বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (স) বলেন, হে মানবমণ্ডলী! স্ত্রীদের ওপর তােমাদের যেরূপ অধিকার আছে, তােমাদের ওপরও তাদের সেরূপ অধিকার আছে। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তােমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তারই আদেশ মতাে তাদেরকে তােমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ। সুতরাং তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে।

৭. সুদ প্রথা বিলোপঃ আরাফাতের ময়দানে মহানবী (স) ঘােষণা করেন, আজ থেকে জাহেলিয়া যুগের যাবতীয় সুদ বাতিল করা হলাে।

৮. রক্তপাত ও সন্ত্রাস প্রহিতকরণঃ মহানবী (স) এ ভাষণে মুসলমানদের রক্ত ও সম্মান ইজ্জতকে পবিত্রতার আসনে সমাসীন করেন।

৯. দাস দাসীর অধিকারঃ তিনি বলেন, তােমরা দাস দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। নিজে যা খাবে, যেমন বস্ত্র পরিধান করবে, তাদেরও অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র দেবে।

১০. শিরক নিষিদ্ধকরণঃ আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার না করার জন্য মহানবী (স) সকলের প্রতি আহ্বান জানান। কেননা আল কুরআনে আল্লাহ ঘােষণা। করেন- “নিশ্চয়ই শিরক মহা অন্যায়”।

১১. নরহত্যা ও ব্যভিচার নিষিদ্ধকরণঃ মহানবী (স) বলেন, তােমরা অন্যায়ভাবে নরহত্যা করবে না এবং কখনাে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না।

১২. নেতার আনুগত্যঃ যদি কোনাে নাক কাটা হাবশী গােলামও তােমাদের নেতা নিযুক্ত হয়, তবে যে পর্যন্ত সে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী মীমাংসা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তােমরা তার আনুগত্য করবে।

১৩. কুসংস্কারের বিরুদ্ধাচরণঃ তিনি বলেন, জাহেলিয়া যুগের সকল কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ও অনাচার আজ আমার পদতলে পিষ্ট হলাে।

১৪. ভ্রাতৃত্ব বন্ধনঃ জেনে রেখাে, প্রত্যেক মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই এবং একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। দুনিয়ার সকল মুসলিম এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ এবং একই জাতিসত্তা থেকে আগত।

১৫. বর্ণবাদের অবসান ঘােষণাঃ মুসলমানগণ স্মরণ রেখাে বর্ণ, গােত্র ও জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান একই সম্প্রদায়ভুক্ত। আজ হতে জাহেলী যুগের বংশগত কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত করা হলাে, সে ব্যক্তিই তােমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কুলিন যে স্বীয় কাজের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে আগ্রহী।

১৬. দ্বীন প্রচারের নির্দেশঃ মহানবী (স) বলেন, আজ যারা এখানে উপস্থিত আছ তােমরা আমার বাণী অনুপস্থিতদের কাছে পৌছে দেবে।

১৭. ভবিষ্যৎ পথপ্রদর্শনঃ বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (স) বলেন, আমি তােমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তা হলাে- আল কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ। যতদিন তােমরা এ দুটো আঁকড়ে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না।

১৮. শেষ নবীঃ তিনি বলেন, আমার পর আর কোনাে নবী আসবে না।

১৯. দ্বীনের ব্যাপারে সাবধান বাণীঃ তিনি বলেন, সাবধান! দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। যদি তাই কর তাহলে শয়তান খুশি হবে। শয়তানকে খুশি করা থেকে বিরত থেকো।

২০. আমানত হেফাযতের নির্দেশঃ আমানত সম্পর্কে তিনি বলেন, সর্বদা অন্যের আমানতের হেফাযত করবে এবং আমানতে খেয়ানত করার মতাে পাপ। কার্য এড়িয়ে চলবে।

২১. ফৌজদারী আইনঃ প্রত্যেক মানুষ নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী। একজনের অপরাধে অন্যকে দায়ী করা যাবে না। তেমনি পিতার অপরাধে পুত্রকে বা পুত্রের অপরাধে পিতাকে দায়ী করা যাবে না।

২২. দায়িত্ব পালনের সফলতা যাচাইঃ মহানবী (স) ভাষণের শেষ পর্যায়ে আকাশের দিকে ইতি তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলেন, হে প্রভু! আমি কি তােমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি? উপস্থিত মুসলমানগণ গগণভেদী আওয়াজ তুলে বললেন, হ্যা, নিশ্চয়ই পেরেছেন।

২৩. অহী লাভঃ পরিশেষে আবেগভরা কণ্ঠে জনগণকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, তােমরা সাক্ষী, আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। বিদা, আল বিদা!

উপসংহারঃ মহানবী (স)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণ সর্বদিক দিয়েই তাৎপর্যবহ। এ ভাষণে তাওহীদ, খতমে নবুয়ত, ওয়াহদানিয়াত, মানবতা ও নৈতিকতা, ভাববাদ ও বস্তুবাদ, সামাজিক সাম্যবাদ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং দার্শনিকতা ও বাস্তবতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। এজন্য এ ভাষণ মানবাধিকারের মহাসনদ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।