প্রথম বিশ্বযুদ্ধােত্তর পর্বে তরুণ প্রজন্মের নৈরাশ্য ও বিদ্রোহ, আবেগ ও মনন, বাংলা সাহিত্যের নবযুগের গতি-প্রকৃতি যে সাময়িক পত্রটিকে কেন্দ্র করে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেটি ‘কল্লোল’ পত্রিকা। ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। সম্পাদক ছিলেন কবি দীনেশ রঞ্জন দাশ এবং সহ-সম্পাদক গােকুলচন্দ্র নাগ।
কল্লোল গােষ্ঠীর লেখকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নূপেন্দ্রকৃয় চট্টোপাধ্যায় মণীন্দ্রলাল বসু, জগদীশ গুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, মনীশ ঘটক, গােকুল নাগ, দীনেশরঞ্জন দাস প্রভৃতি। এই পত্রিকার আয়ুষ্কাল ছয় বৎসর। ১৯২৩ থেকে যাত্রা শুরু করে ১৯২৯-এ কল্লোলের সমাপ্তি।
‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশের প্রেক্ষাপটে ছিল যুগের তাড়না। মনে রাখতে হবে, বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে জাতীয় আবেগ বাংলার আপামর মানুষকে আলােড়িত করেছিল, ১৯১১ তে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে যাওয়ায় সেই আবেগ স্তিমিত হয়ে গেল। ১৯১৪ তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতের মুক্তি সম্ভাবনাকে আবার জাগ্রত করেছিল। কিন্তু এই বিশ্বযুদ্ধে সহযােগিতা করলে ব্রিটিশ ভারতবর্ষকে স্বরাজ দান করবে এই আশ্বাস মিথ্যায় পরিণত হল যুদ্ধশেষে। স্বরাজের পরিবর্তে ভারতে এল মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন। ফলে সমগ্র ভারতের মতােই বাংলার যুবসমাজের মধ্যেও সারিত হল বিপুল নৈরাশ্য। ‘কল্লোল’ পত্রিকার তরুণ লেখকগােষ্ঠী ছিলেন এই নৈরাশ্যপীড়িত যুবসমাজেরই প্রতিনিধি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা বাংলার অর্থনীতিতেও স্বভাবতই প্রভাব ফেলেছে। একদিকে তীব্র খাদ্য ও বস্ত্র সংকট ও দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি বাংলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল, অন্যদিকে সেনাবাহিনী ছাড়া অন্যক্ষেত্রে চাকুরির অভাব যুবসমাজে ব্যাপক বেকার সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। ‘কল্লোলে’র রচনাগুলিতে যুবচিত্তের এই যন্ত্রণা ভাষারূপ লাভ করেছিল।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পেষণে নৈরাশ্যপীড়িত এই যুবসমাজের কাছে রবীন্দ্রনাথের কল্যাণচেতনা ও পবিত্র ভাবমূর্তি অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হল। ফলে কাব্যক্ষেত্রের মতােই কল্লোলের তরুণ কথাসাহিত্যিকেরাও নতুন উপাদানের সন্ধানে ব্রতী হলেন। রােম্যান্টিক ভাবালুতাকে বিসর্জন দিয়ে তাঁরা নেমে আসতে চাইলেন নগ্ন বাস্তবের মাটিতে। প্রেম ও সৌন্দর্যের ধারণাতেও এই রবীন্দ্র-বিরােধিতা প্রকট হল। দেহকেন্দ্রিক জৈব প্রেমের কামনা বাসনার চিত্র, কদর্য জীবনের আদিম সৌন্দর্যকে রূপায়িত করলেন কল্লোলের লেখকেরা। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য- “যাকে কল্লোল যুগ বলা হয় তার প্রধান লক্ষণই বিদ্রোহ, আর সে বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্যই রবীন্দ্রনাথ।”
১৯১৩-১৪ নাগাদ মনােবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যৌন বিষয়ক তত্ত্ব মানুষের নৈতিক মূল্যবােধের ভিতটিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন মানুষের আচরণ ও কর্মপ্রেরণার মূলে ক্রিয়াশীল যৌন-এষণাকে। ফলে দেহাতীত প্রেমের ভাবকল্পনার পরিবর্তে দৈহিক কামনার বাস্তবতা স্বীকৃতি পেয়ে গেল তরুণ সাহিত্যিকদের মধ্যেও। অতএব উগ্র বাস্তবতার পথ ধরে যৌনতার অনুপ্রবেশও ঘটল কল্লোলগােষ্ঠীর কথাসাহিত্যে।
ইংরাজি সাহিত্যপাঠের সঙ্গে এ যুগের শিক্ষিত তরুণেরা ফরাসি, রুশ, জার্মান সাহিত্যের সঙ্গেও ব্যাপকভাবে পরিচিত হচ্ছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের উগ্র বাস্তবতা সঞ্চারিত হল কল্লোলের তরুণ লেখকদের মধ্যেও। শ্রমিকব্তি, ফুটপাতবাসী, গণিকাপল্লি, অন্যান্য নিচুতলার নগ্ন আদিম স্থুল জীবনচিত্র উঠে আসতে লাগল কথাসাহিত্যের উপকরণ হিসাবে।
কিন্তু বাস্তবতার নামে এই নগ্নতার চর্চা কৃত্রিম আবেগ সর্বস্বতাতেই পরিণত হয়েছিল। কেননা এইসব নিচুতলার জীবন সম্পর্কে যথার্থ বাস্তব অভিজ্ঞতা কল্লোলের শিক্ষিত তরুণ সাহিত্যিকদের ছিল না। ফলে বাস্তবতার চর্চা ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রয়ােগ করতে গিয়ে কল্লোলের সাহিত্য আন্দোলন বৈজ্ঞানিক সমাজবাস্তবতার পরিবর্তে ফেনিল উচ্ছ্বাসময় ভাবাতিশয্যে পরিণত হয়েছিল।
কল্লোল প্রকাশের এক বছর পূর্বেই নজরুল লিখেছেন ‘সাম্যবাদী’ কবিতা। সাম্যবাদ ও কমিউনিজম-এর প্রভাবও কল্লোলের তরুণ লেখকগােষ্ঠী নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কনে উদ্দীপ্ত করেছিল। কিন্তু মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের যথার্থ মর্ম তারা অনুধাবন করতে পারেন নি। ফলে নিম্নবিত্ত মানুষের বাস্তব জীবনচিত্র ও আবেগময় দরদী ভূমিকাকেই কল্লোলের লেখকেরা সাম্যবাদী চেতনার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ বলে মনে করেছিলেন।
মােট কথা, বাস্তবতার চর্চা, রবীন্দ্রবিরােধী মানসিকতা, যৌনতার কুণ্ঠাহীন প্রকাশ, নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কন, নৈরাশ্যের ও যুগগত যন্ত্রণার প্রকাশ, সাম্যবাদী-মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আবেগ, যৌবন-আবেগ ও বিদ্রোহচেতনাই ‘কল্লোল’ পত্রিকাগােষ্ঠীর সাহিত্য আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য।
তারাশংকর ও বিভূতিভূষণ কল্লোলপর্বের লেখক হলেও কিছুটা স্বাতন্তচিহ্নিত। কল্লোলের কৃত্রিম আবেগের ফেনিলতা অতিক্রম করে যথার্থ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার প্রয়ােগ করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু কল্লোর যে বাংলা সাহিত্যে যৌবনচেতনা ও বিদ্রোহদৃষ্টির সঞ্চার করেছিল, রােমান্টিক ভাবালুতা থেকে যেভাবে সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত নিম্নতম স্তরে সাহিত্যের উপকরণ সন্ধান করেছিল, তা শুধু অভিনব নয়, তা আসলে ভবিষ্যৎ প্রগতি সাহিত্যেরই পথ প্রস্তুত করেছিল।
Leave a comment