অথবা, বাস্তববাদের বিভিন্ন রূপ সংক্ষেপে তুলে ধর।
ভূমিকাঃ বাস্তববাদ এমন একটি সত্তা বিষয়ক মতবাদ, যে মতবাদ অনুসারে বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ বা মনানরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে। জ্ঞাতা কোনাে জ্ঞেয় বস্তুকে না দেখলে তার কোনাে অস্তিত্ব থাকে না- এ কথা বলা আমাদের কোনাে যুক্তিসঙ্গত অধিকার নেই। জ্ঞাতা ছাড়াই জ্ঞেয় বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। যেমন- কলম্বাস আমেরিকা নামক দেশ আবিষ্কার করার পূর্বেও আমেরিকা নামক দেশের অস্তিত্ব ছিল। তবে নাম হয়তাে ছিল না।
বাস্তববাদঃ যে মতবাদ অনুসারে জ্ঞেয় বস্তুর একটি স্বাধীন সত্তা আছে, জ্ঞাতা জানুক বা না জানুক জ্ঞেয় বস্তু স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল তাকে বাস্তববাদ বা (Realism) বলে।
বাস্তববাদের বিভিন্ন প্রকারভেদঃ বাস্তববাদের ইতিহাস পর্যালােচনা করে এর চারটি প্রকারভেদ আমরা খুঁজে পাই। যথা- (ক) সরল বা লৌকিক বাস্তববাদ। (খ) বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ। (গ) নব্যবাস্তববাদ এবং (ঘ) বিচারমূলক বাস্তববাদ। নিম্নে এগুলাের বর্ণনা দেওয়া হলাে-
(ক) সরল বা লৌকিক বাস্তববাদঃ লৌকিক বাস্তববাদ প্রাচীনতম মতবাদ। লৌকিক বা সরল বাস্তববাদ অনুসারে জ্ঞান হতে হলে বস্তুর দরকার। কাজেই বস্তু আছে। কিন্তু এ জাগতিক বস্তুর দ্রব্যত্ব এবং সকল গুণ জ্ঞান বা মননিরপেক্ষ। সহজ, সরল, সাধারণ মানুষের মতের সঙ্গে মিল থাকায় এ শ্রেণির বস্তুবাদকে লৌকিক বাস্তববাদ বলে। এ মতবাদ অনুসারে মনের বাইরে বাহ্যজগতের একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। বাহ্যবস্তুর রূপ, রস, গন্ধ, আকার, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ঘনত্ব প্রভৃতি আমরা ইন্দ্রিয় দিয়ে সরাসরি জানতে পারি। আমাদের জ্ঞান বা চেতনা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব ও গুণগুলােকে যথাযথভাবে প্রকাশ করে। সুতরাং সরাসরিভাবে আমরা বস্তুর যথার্থ রূপকেই জানি। অথবা আমরা সরাসরিভাবে যা জানি তা সবই সত্য। এ মতবাদকে সাধারণ লােকের মতবাদ বলা হয়। সাধারণ লােক সহজ-সরলভাবে মনে করে বস্তুজগতের অস্তিত্ব তাদের মনের বাইরে আছে। বস্তু ও তার গুণগুলােকে সরাসরিভাবে জানা যায়। এ মতবাদে সাধারণ লােকের ধারণা পাওয়া যায় বলে এর নাম সরল বস্তুবাদ। আবার এতে বস্তুকে সরাসরিভাবে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সাক্ষাত্তাবে জানা যায় বলে এর অন্য নাম সাক্ষাৎ বাস্তববাদ।
(খ) বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদঃ বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ লৌকিক বাস্তববাদের ত্রুটি নির্দেশ করে। লৌকিক বাস্তববাদের ত্রুটি নিরসনের জন্য লক বৈজ্ঞানিক বা প্রতিরূপী বাস্তববাদের প্রবর্তন করেন। এ মতবাদ সরল বাস্তববাদের মত বস্তুর স্বতন্ত্র মননিরপেক্ষ অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তবে এ মতবাদ মনে করে যে, বস্তু প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জ্ঞাত হয় না। প্রত্যক্ষ প্রতিভাত হয় বস্তুর প্রতিরূপ। আর এদিক থেকে এ মতবাদকে প্রতিরূপী বাস্তববাদ বলা হয়। মন কেবল প্রত্যক্ষভাবে ধারণাকে জানতে পারে এবং ধারণার মাধ্যমে পরােক্ষভাবে বস্তু সম্পর্কে জ্ঞাত হয়।
বস্তু সাক্ষাৎভাবে জ্ঞাত হয় না। তিনি বস্তুর গুণাবলিকে দুইভাগে ভাগ করেন। যথা- (1) মুখ্য গুণ (Primary Qualities) (ii) গৌণ গুণ (Secondary Qualities)
যে গুণগুলাে বস্তুতেই থাকে তাদের তিনি মুখ্য গুণ বলেছেন। যেমন- বস্তুর আয়তন, সংখ্যা, ঘনত্ব, বিস্ততি, গতি প্রভৃতি বস্তুর মুখ্য গুণ। আর যে গুণগুলাে ব্যক্তিসত্তা জ্ঞানগত এগুলােকে তিনি গৌণ গুণ বলেছেন। যেমন- রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি গুণ আন্তঃভাবেই ব্যক্তিনির্ভর বা জ্ঞাননির্ভর। কাজেই বাহ্য সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা বস্তু প্রতীকের মাধ্যমে। কোনাে বস্তুকে সরাসরি জানা যায় না। এ মতবাদ অনুসারে বস্তুর প্রতীককে আমরা সরাসরি জানতে পারি। এ মতবাদের আর এক নাম প্রতীকবাদ। যখন প্রতীকের সঙ্গে বস্তুর সামঞ্জস্য হয় তখন সত্য জ্ঞান পাওয়া যায়। আর যখন প্রতীকের সঙ্গে বস্তুর কোনাে মিল থাকে না তখন সেই জ্ঞান হয় মিথ্যা।
(গ) নব্য বাস্তববাদঃ আত্মগত ও বস্তুগত ভাববাদের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ উদ্ভূত হয় নব্যবাস্তববাদ। এ মতবাদমনকে মূল সত্তা হিসেবে স্বীকার করেনা। বস্তুর মননিরপেক্ষ সত্তার সপক্ষে ওকালতি করে। নব্য বাস্তববাদ অনুসারে, মন সরাসরি বাহ্যবস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে, কোনাে ধারণার সাহায্য আবশ্যক হয় না। ধারণা বস্তুর অবিকল প্রতিলিপি নয়, মনের বাইরে অবস্থিত স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বস্তু সরাসরি জ্ঞাত হওয়া যায়। নব্য বাস্তববাদকে প্রত্যক্ষ বাস্তববাদও বলা চলে। এ মতবাদ সম্প্রতি ব্রিটেন ও আমেরিকায় জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ব্রিটেনে নব্য বাস্তববাদ প্রকাশ পেয়েছে মর, আলেকজান্ডার ও রাসেলের হাতে এবং আমেরিকায় এ মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে রয়েছেন হােল্ট, মারভিন, মন্টেগাে, পেরী পিটবিরন এবং স্পাউলডিং। আমেরিকার ছয়জন দার্শনিক যৌথভাবে ‘The Neo-Realism’ নামে ১৯২২ সালে একটি গ্রন্থও রচনা করেন। এ মতবাদ মূলত লৌকিক বাস্তববাদের আধুনিক ব্যাখ্যা।
(ঘ) সবিচার বাস্তববাদঃ ভাববাদ ও নব্য বাস্তববাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরাসরি বাস্তববাদের আবির্ভাব। এ মতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন ডুরাল্ট ডেক প্রাট, সেলার্স, লভজর রােজার্স। প্যাট্রিক এ মতবাদকে নব্যবিচারমূলক বাস্তববাদ বলে অভিহিত করেছেন। এরা নব্য বাস্তববাদকে তীব্র ভাষায় সমালােচনা করেন। তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯২০ সালে যৌথভাবে ‘The Essays in Critical Realism’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। প্রাচীন বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ থেকে নিজেদেরকে বাস্তববাদী ধ্যান-ধারণা পৃথক ও স্বতন্ত্র রাখার জন্যই এর নাম দিয়েছেন সবিচার বাস্তববাদ।
সবিচার বাস্তববাদের প্রধান প্রতিপাদ্য হলাে বস্তুর সরাসরি প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্ভব নয়। সরাসরি যা পাওয়া যায় তা হলাে ইন্দ্রিয়ােপাত্ত। ইন্দ্রিয়ােপাত্তের মাধ্যমেই বিষয়জ্ঞান অর্জিত হয়। সবিচার বাস্তববাদীদের মতে, প্রত্যেক জ্ঞানের তিনটি অংশ আছে- (১) প্রত্যক্ষকারী মন (২) বাহ্য বস্তু এবং (৩) ইন্দ্রিয়ােপাত্ত। এগুলাের মধ্যে কেবল ইন্দ্রিয়ােপাত্তকেই সরাসরি জানা যায়। এর মাধ্যমেই মন বিষয়ের গুণ লাভ করে থাকে। সবিচারমূলক বাস্তববাদীদের মতে, বস্তুর গুণাবলি আংশিকভাবে বস্তুগত এবং আংশিকভাবে ব্যক্তিগত। সুতরাং নব্য বাস্তববাদীরা অধ্যাস অমূলক প্রত্যক্ষণ ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারেন না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সবিচার বাস্তববাদের বিভিন্ন ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ মতবাদ অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে ভাববাদ ও নব্য বাস্তুববাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ দূর করতে সক্ষম। বস্তুত সবিচার বাস্তববাদ হলাে একটি সমন্বয়ী বাস্তববাদ, যেখানে ভাববাদ ও নব্য বাস্তববাদ ‘নয়’ ও ‘প্রতিনয়’ হিসেবে বিবেচ্য। অতএব বলা যায়, বিভিন্ন সমালােচনা সত্ত্বেও দর্শনে বাস্তববাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment