চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতার প্রবল সমকালমনস্কতা, পঞ্চাশের দশকে পৌঁছে যখন প্রায় স্তিমিত তখনই মর্মনিঙড়ানো ব্যর্থতাকে সমষ্টির চৈতন্যে মিলিয়ে দেবার আকুতি নিয়ে কবি শঙ্খঘোষের আবির্ভাব। সামগ্রিকতার বোধে তাঁর বাচনভঙ্গীই ছিল স্বতন্ত্র। তিনি তাই বলেছেন : “আমার কাছে আধুনিকতার একমাত্র মানে মানবিকতা L..যে মানুষ বেঁচে আছে তার অসংখ্য অপূর্ণতা নিয়ে, মৃত্যু আর প্রকৃতি দিয়ে পদে পদে খণ্ডিত যে মানুষ, অথচ যে মানুষ, তারই মধ্য দিয়ে নিজের বিকাশ খুঁজে চলেছে কেবল, তার সেই চলনটাকেই বলি মানবিকতা। … সেই মানবিকতার চর্চার মধ্যেই আছে যোগ্য আধুনিকতা।…” (পিলসুজ পত্রিকা/সংখ্যা ২৩/পৃ: ১৪)

“বাবরের প্রার্থনা” কবিতায় এই “মানবিকতার চর্চাই কবিতাটিকে তাই করে তুলেছে যথার্থ আধুনিক। তাঁর উচ্চারিত এই “প্রার্থনা”র মধ্যে রয়েছে একটি চিন্তাসূত্র যা প্রচলিত স্মিথ এর উপাদানকে ব্যবহার করে, হয়ে উঠেছে সমগ্রমানবসমাজের মঙ্গলকাঙ্ক্ষা। “কবিতার মুহূর্ত” গ্রন্থের সূচনায় তিনি তার কবিতার মধ্য দিয়ে পিছনে ফিরে যেতে মিশে যাওয়া এক সময়পথ।” আমরা কবিতাপাঠ করতে করতে, “বাবরের প্রার্থনা”র ভাষাশৈলীতে ওই ঐতিহাসিকস্মৃতির সময়পথে বিধৃত বৃহত্তর এক দেশ-কাল সমাজের জীবনচিত্রই খুঁজে পাই। ওই ‘সময়’ হল সত্তরের ‘অস্থির সময়’। সেই সময় অসুস্থ কন্যার সুস্থতা কামনা করতে গিয়ে কবির স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে এক ঐতিহাসিক কিংবদন্তী-সন্তান হুমায়ুনের জীবন ভিক্ষায় মগ্ন নতজানু পিতার বাবরের প্রার্থনার কথা। লোকচেতনাই প্রভাবিত করেছে কবি শঙ্খ ঘোষকে, প্রাথমিক ভাবে। ইতিহাসের কিংবদন্তী হয়ে উঠেছে কবিতাটির নিশ্চিত উপাদান। কবিতাটির কোথাও হুমায়ুনের কথা উচ্চারিত হয়নি। একমাত্র শিরোনাম ছাড়া বাবরের নামও নয়। অর্থাৎ এটি কেবল বাবার নামে কোনো পিতার প্রার্থনা, যা দেশ-কালের নিরিখে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।

কবিতাটির প্রেক্ষাপট সত্তরের দক। যদিও কবিতার নামকরণ ও বক্তব্যের মধ্যে কালগত ব্যবধান আছে তবু কবি শঙ্খ ঘোষ ওই কালগত ব্যবধানের মধ্যে নির্মাণ করেছেন চিরন্তন অনুভূতির সেতু। সন্তানের জন্য বাবরের প্রার্থনা বা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কবির স্নেহশঙ্কিত মন যে কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিশেছে সেখানে রয়েছে সত্তর দশকের বিক্ষুব্ধ বাস্তব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্জন কবি ভোর অতিক্রমের সময়, এক বিকেলের অনুভবকেই তিনি সাজিয়েছেন পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। যে বিকেলের পরেই আছে সম্ভাব্য রাত্রি, যা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক অন্ধকার নয়, দেশ-কাল অর্থনীতির ঘনিয়ে আসা সংকটের অন্ধকারও বটে। কবিতার সময়কাল ১৯৭৪ সালের শেষদিক। ছয়টি স্তবকের দীর্ঘ কবিতার মোট পক্তি সংখ্যা চব্বিশ। প্রথম স্তবকে, পশ্চিমে মুখ রেখে জানু পেতে প্রার্থনায় বসার ছবি রয়েছে। আমরা জানু। বসতে পত্র-পুষ্পে প্রকৃতি নিজেকে সাজায়। এই প্রচলিত ছবির সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ছবি শীর্ষে রেখে যখন শুরু হল এ কবিতা—“এই তো জানু পেতে বলে পশ্চিম/আজ বসন্তের শূন্য হাত” তখন আমরা বুঝতে পারি শুধু প্রকৃতির শূন্যতা নয়, এই পক্তির গভীরে অন্তর্লীন হয়ে আছে আরও গভীরতর কোনও শূন্যতার কথা, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে মানব প্রকৃতির কথা, এক নিঃসীম শূন্যতার বোধ যা প্রবাহিত হয়েছে দ্বিতীয় স্তবকে বিস্ময়বোধ নয়ে। তৃতীয় স্তবকে যে প্রার্থনা উচ্চারিত তা দ্বিতীয় স্তবকেরই অনুচিন্তনজানিত টেনশনের ফলশ্রুতি। তাই বসন্তের শূন্য হাত, স্বচ্ছ যৌবনের গোপনক্ষয় ও পরাভব দেখে ব্যথিত পিতৃহৃদয় যে আজান গান প্রার্থনা করে তা ধূসর শূন্যের এবং তা শূন্যতাদূরীকরণের বিবরণ সম্বন্ধে প্রকাশক হয়ে ওঠে।

প্রার্থনা বাদ     সম্পন্ধ পদ    সম্বন্দ প্রকার

জাগাও    শূন্যের আজানগান    নিবারণ সম্পদ

এই নিবারণ সম্বন্ধের সূত্রেই অপূর্ণতা, যৌবনের পরাভব ও ক্ষয় দূর করার ইচ্ছা আর সেই ইচ্ছা থেকে হাত প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে তৃতীয় স্তবকে— 

জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে

ধূসর শূন্যের আজান গান ;

এই আজানগান কোনো নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ নয়। শহরের ‘প্রান্ত থেকে ‘প্রান্তরে’ তার অবাধ ও দীর বিস্তার। শূন্যতার মধ্যে মুক্তির আহ্বান হিসেবে তা নিবারণ সম্বন্ধকেই প্রকাশ করে। জীর্ণ, অসুস্থসন্তানের অন্ধকার শূন্য জীবন কাম্য নয় বলেই তার অস্তিত্ব বাস্তবে না থেকে স্বপ্নে থাকাই শ্রেয়তর মনে হয় আর সেই স্বপ্নসম্ভাবনাকে রূপায়িত করার জন্য কবি পিতা নিজেই হয়ে উঠতে চান প্রজনন অক্ষম জড় বা নিশ্চলপাথর। তাই বলেন—

“পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”

প্রথম তিনটি স্তবকে বাইরের প্রেক্ষিতের সম্পূর্ণ বিবরণ, শেষ তিনটি স্তবকে কবির পিতৃহৃদয়ের স্নেহশঙ্কিত মনে বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে প্রশ্ন আপন প্রজন্মের ত্রুটি বিচ্যুতির মধ্যেই সে খুঁজছে, তার উত্তরাধিকারী, তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুবীজ। শেষ তিনটি স্তবক তাই প্রশ্নচিহ্নে আকীর্ণ—

  • ১) নাকি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে/কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের?

  • ২) আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে/মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?

  • ৩) নাকি এ প্রাসাদের আলোর ঝল্‌সানি/পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয়হাড়/এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে/লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের?

  • ৪) আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার/জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?

আমরা দেখছি, দ্বিতীয়বার প্রার্থনার পরে প্রার্থনাকারীর মনের অশান্তভাব না কমে বরং বেড়ে যায়। তাই প্রথম স্তবকে প্রার্থনা উচ্চারণের পরে দ্বিতীয় স্তবকে ছিল বিসময় চিহ্নভরা বাক্য ; তৃতীয় স্তবকে প্রার্থনার পর তা দুটি স্তবকে, উপরোক্ত চারটি প্রশ্নের রূপ ধারণ করেছে। “আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক”—এই প্রার্থনা বাক্যটিও প্রথম, তৃতীয় ও ষষ্ঠ স্তবকে এসেছে ধ্রুবপদের মতো। একমাত্র শিরোনাম ছাড়া, কবিতার ছয়টি স্তবকে আর কোথাও ‘বাবর’ নামটি উচ্চারিত হয়নি কিন্তু পিতা বাবরের প্রার্থনার সুর, আজানের সুরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র কবিতায়। অর্থাৎ বাবর নামে বক্তার ‘আমিত্ব’ মুছে যাচ্ছে। প্রথম স্তবকে ‘আমি’ (অনুজ কর্তা) শেষ স্তবকে ‘আমাকে’ কর্মের রূপ পায় । আর বাবর তাই হয়ে ওঠেন সার্বজনীন পিতা। বাবরের প্রার্থনা হয়ে ওঠে সন্তানের জন্য সর্বকালীন মঙ্গল প্রার্থনা।

চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ স্তবকের উচ্চারিত প্রশ্নগুলির মধ্যে কবি দেখিয়েছেন অসুস্থতার উৎসসন্ধান প্রশ্নেই নিহিত রয়েছে উত্তর—

(১) এ শরীরের পাপের বীজাণুতে ভবিষ্যতে ত্রাণ নেই। (নাকি’ শব্দটি ব্যবহারে সিদ্ধান্তের সম্পর্কে দ্বিধাও বোঝাচ্ছে একই সঙ্গে) 

(২) ‘আমারই বর্বর জয়ের উল্লসে’ মৃত্যুকে (বা ধ্বংসকে) ডেকে আনা হয়েছে নিজের ঘরে (বা জীবনে)

(৩) আলোর ঝলসানিতে দগ্ধ (মৃত) হৃদয় (মন) ও শরীরে বাসা বেঁধেছে লক্ষ লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গ (বা তরুণ প্রজন্ম) ফলত তারাও হৃদয়হীনতার উত্তরাধিকার পাচ্ছে।

(৪) এই হৃদয়হীন, জীর্ণ প্রজন্মকে কোথাও নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ ক্ষয়ে যাওয়া তরুণপ্রজন্ম আর কোন নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারবে না। আরও বিস্তৃতভাবে বললে কবি বোঝাতে চেয়েছেন কোনও এক গোপনক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে তারুণ্যে, সেই ক্ষয়ের ফলশ্রুতিতে দ্রুত বসিয়ে বিষিয়ে যাচ্ছে ফুসফুস ধমনী-শিরা। অস্থির, দিশাহীন এক তৈরি হওয়া উত্তেজনার আঁচে দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া, অকালে ক্ষয়ে যাওয়া সত্তরের দশকের তরুণ প্রজন্ম, যাদের “চোখের কোণে সমূহ পরাভব” দেখেছেন কবি, দেখেছেন এবং বিস্মিত হয়েছেন। ষষ্ঠ ও অষ্টম পঙ্ক্তিতে যে বিস্ময়বোধ প্রকাশিত। মতাদর্শগত ব্যর্থতার ঘুণপোকা কুড়ে কুড়ে খেয়ে যে প্রজন্মকে, তাকে নষ্ট করেছে ফুসফুস, নতুন স্বপ্ন আর স্বচ্ছজীবনে শ্বাস নেওয়ার সুযোগটিও তাই নষ্ট হয়ে গেছে। যে প্রাণশক্তি নিঃশেষিত, তা জীবনে আর নতুন আশাবহন করে আনতে পারে না, সুতরাং “কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের?” এই প্রশ্ন পৌঁছে দেয় শেষ ও তৃতীয় প্রার্থনা উচ্চারণে—

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর 

আমার সম্ভতি স্বপ্নে থাক।

এখানে এসেছে “ঈশ্বর” সম্বোধন। এখানে, “যদিও চাও”-এই সংযোজক ভাব নেই, নেই কোনও শর্ত, যা প্রথমস্তবকে ছিল। এখানে, এল এক বিজস্র আত্মনিবেদনের ভঙ্গী যদিও তার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট, দ্বিধাহীন বলিষ্ঠতাও অপ্রকাশিত থাকেনি। সুস্থ, স্বচ্ছ জীবনই একমাত্র কাম্য তাই কবির স্বপ্নে তরুণ প্রজন্ম তার সুস্থ আশাবাদ নিয়ে জাগ্রত থাকে। বাস্তবের ক্ষয়িত সময়ে তার উপস্থিতি কবির কাছে পীড়াদায়ক।

সামগ্রিকভাবে তাই আমরা বলতে পারি, ‘বাবরের প্রার্থনা কবিতার ভাষা শৈলীতে এক গভীর জীবনবোধ নির্মিত হয়েছে যা কবিতার ফ্রেমেই সঞ্চার করেছে বৃহত্তর এক দেশ কাল-পটভূমির প্রেক্ষিতে তরুণপ্রজন্মের অবস্থান ও পরিণতি।