খ্রীঃ চতুর্দশ শতকের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে দিল্লীর সুলতানদের হাত থেকে বাঙলাকে উদ্ধার করে তার শাসন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। বস্তুতঃ এই সঙ্গেই দেড়শতাব্দীব্যাপী অপশাসনের অবসান ঘটায় বাঙলার বুকে আবার শান্তি-স্বস্তি ফিরে এলাে এবং বলা চলে যে বাঙলার ইতিহাসে ক্রান্তিকালেরও অবসান সূচিত হলাে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই শুরু হলাে মধ্যযুগের।

প্রাচীন যুগের নৈর্ব্যক্তিক সাহিত্য: আমরা অনেকটা য়ুরােপীয় সাহিত্যের অনুকরণে বাঙলা সাহিত্যের তিনটি যুগের কথা কল্পনা করেছি, কিন্তু বাস্তবে যুগমাত্র দুটি—একটি প্রাচীন বা পুরাতন যুগ, অপরটি আধুনিক যুগ। বাঙ্লা সাহিত্যে যে মধ্যযুগের কথা বলা হয়, তার সঙ্গে প্রাচীন যুগের কোন মৌলিক পার্থক্য নেই, পার্থক্য যেটা আছে সেটা শুধুই কালগত। কালধর্মে বা সাহিত্যে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, তাও গুণগত নয়, বড় জোর বলতে পারি রূপগত। বস্তুতঃ একটু শিথিলভাবে আমরা প্রাচীন যুগ এবং মধ্যযুগের সাহিত্যকে একযােগে প্রাচীন বা পুরাতন সাহিত্য বলেই অভিহিত করে থাকি। প্রাচীন যুগের সাহিত্যের সঙ্গে মধ্যযুগের সাহিত্যের ভাষাগত এবং রূপগত পার্থক্য ছাড়া ভাবগত কোন বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় না। পক্ষান্তরে এতদুভয়ের সঙ্গে আধুনিক যুগের সাহিত্যের পার্থক্য আকাশচুম্বী। আধুনিক যুগের সাহিত্যকে যদি বলি ব্যক্তিসাহিত্য, তবে প্রাচীন সাহিত্যবে এককথায় বলতে পারি নৈর্ব্যক্তিক সাহিত্য।

নিঃস্বতার উত্তরাধিকার: ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে বালা সাহিত্য নবজাত সাহিত্য—এর বয়স এখনাে হাজার পার হয়নি। বা সাহিত্যের জন্মের পূর্ববর্তী আড়াই হাজার বছর ধরে সাহিত্যের যে ধারাটি ছিল ক্রমবিকশিত, তা রচিত হয়েছিল প্রধানতঃ সংস্কৃত ভাষায় তবে কালের বিচারে দীর্ঘতর ছিল প্রাকৃত ধারা। সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যিক ঐশ্বর্য ছিল অতুলনীয়। পক্ষান্তরে প্রাকৃতের যে ধারাটি অবলম্বন করে মাগধী প্রাকৃত, মাগধী অপভ্রংশ এবং মাগধী অবহটুঠের মধ্য দিয়ে তথা গৌড়ী প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার সৃষ্টি, সাহিত্য-সম্পদের দিক থেকে সেই ধারাটিকে একেবারে নিঃস্ব বললেও অত্যুক্তি হয় না। সংস্কৃত সাহিত্য ছিল রাজসভার সাহিত্য, বালা সেই উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে একেবারেই পল্লীসাহিত্যরূপে জন্মগ্রহণ করেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে যখন সর্বাঙ্গীণ অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, জগৎ ও জীবনকে অস্বীকার করে শিল্পবিলাসকেই যখন তার একমাত্র উপজীব্য বলে গ্রহণ করেছে, বস্তুতঃ তখনই ঘটে বাঙলা সাহিত্যের উদ্ভব। ফলে সদ্যপ্রসূত বাঙলা সাহিত্যের দৃষ্টি হয়ে উঠলো সংকীর্ণ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এবং ভাবালু। অবশ্য সমকালীন বাঙালীর জাতীয় জীবনই এর জন্য দায়ী।

প্রাচীন সাহিত্যের তিন ধারা: বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগ মিশিয়ে যে প্রাচীন বা পুরাতন সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, তাতে তিনটি রূপভেদ লক্ষ্য করা যায়—সভাসাহিত্য, গােষ্ঠীসাহিত্য এবং জনসাহিত্য। বাঙলা সাহিত্যের অপর ধারা- ব্যক্তিসাহিত্য শুধু আধুনিক যুগেই আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে, অপর তিনটি ধারা একালে অনুপস্থিত। প্রাচীন সাহিত্যকে কোনক্রমেই স্বাধীন রচনা বলা চলে না, অপরের প্রয়ােজনে বা নির্দেশে এ জাতীয় সাহিত্য রচিত হয়েছিল। প্রাচীন সাহিত্যগুলিকে নিম্নে শ্রেণীবিভাগ করে দেখানাে হলো।

  • সভাসাহিত্য (ধ্রুপদী সাহিত্য): প্রধানতঃ ভূস্বামীদের পৃষ্ঠপােষকতায় এবং নির্দেশেই যে এ জাতীয় সাহিত্য রচিত হয়েছিল, তার বহু সমর্থন পাওয়া যায় কবিদের উক্তি থেকেও। সভা সাহিত্যে পৌরাণিক দেবতা বা ভাবধারাই প্রধান স্থান অধিকার করেছে। এ জাতীয় সাহিত্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বিভিন্ন অনুবাদ এবং ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল। সভাসাহিত্য রচনার পশ্চাতে রাজসভার মনােরঞ্জনের ভাবটি পরিস্ফুট থাকায় এ জাতীয় সাহিত্য স্বভাবতই উদাত্ত গম্ভীর মহাকাব্য জাতীয় রচনা। ভাষা, ভঙ্গি, উপস্থাপনা ও অলঙ্কারাদির বিচারে সভাসাহিত্যগুলিকে সাধারণভাবে আমরা বার ক্ল্যাসিক সাহিত্য বা ধ্রুপদী সাহিত্য বলে অভিহিত করতে পারি। রাজন্যবর্গের আনুকূল্য, পৃষ্ঠপােষকতা এমন কি উপদেশ-নির্দেশও যে এ জাতীয় সাহিত্য-রচনার মূলে সক্রিয় ছিল, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
  • ‘গােষ্ঠীসাহিত্য (বৈষ্ণব ও শাক্ত পদ): কোন-না-কোন ধর্মীয় গােষ্ঠীর আনুকূল্য, প্রবর্তন কিংবা প্রচার কামনাতেই গােষ্ঠীসাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। একপ্রকার ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব প্রয়ােজনে এ জাতীয় সাহিত্য রচনা করলেও কখন কখন এগুলি গােষ্ঠীচেতনা থেকে মুক্ত হয়ে সার্বজনীন রস- স্বীকৃতি লাভ করেছে। গােষ্ঠীসাহিত্য দ্বিবিধ ও সাধন সঙ্গীত ও প্রচার সাহিত্য। বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, শাক্ত এবং বাউল সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব যে সাধন সঙ্গীত রচনা করে গেছেন, সেগুলিকে যথাক্রমে চর্যাগীতি, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী ও বাউল গান নামে অভিহিত করা হয়। “গােষ্ঠীসাহিত্যের সাধন সঙ্গীতগুলিই প্রাচীনবঙ্গের গীতিকবিতা; ভাষায়, কল্পনায় ও ভাবে এইগুলির অধিকাংশ রােমান্টিক এবং কিছু মিস্টিক। এগুলির অধিকাংশ কালজয়ী কবিতা; আধুনিক যুগেও ইহাদের জনপ্রিয়তা অল্প নহে” (ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য)। গােষ্ঠীসাহিত্যের দ্বিতীয় ধারাটি প্রচার সাহিত্য। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ও তার পার্ষদদের জীবনীগ্রন্থ এবং বৈষ্ণবত্ত্বসাহিত্য এর অন্তর্ভুক্ত। মননশীলতা এবং ঐতিহাসিকতার দিক থেকে এদের উপযােগিতা ও মূল্য স্বীকার করতে হয়।
  • জনসাহিত্য (মঙ্গলকাব্য): জনসাহিত্যকে বলা হয় গােষ্ঠীসাহিত্যের বিপরীতধর্মী। একটা সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠী তাদের নিজেদের জন্যই গােষ্ঠীসাহিত্য রচনা করে থাকে, তার কিছু কিছু সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভে ধন্য হয়েছে, আবার কিছু কিছু এমন সাঙ্কেতিকধর্মী যে সম্প্রদায়ের বাইরে অপর সকলের নিকট তা’ দুর্বোধ্য বিবেচিত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে জনসাহিত্য জনতার সাহিত্য তথা বারােয়ারি সাহিত্য-সংসারাসক্ত জনগণই এই সাহিত্যের রচয়িতা। এই জাতীয় সাহিত্যের প্রধান নিদর্শন বিভিন্ন কালে রচিত এবং বহুধা শাখায় বিভক্ত ‘মঙ্গলকাব্য’। মঙ্গল-কাব্যগুলির প্রধান শাখা চারটি-মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন বা শিবমঙ্গল। এই কাব্যগুলির অধিদেবতা যারা, শক্তির দাপটে ভয় দেখিয়ে পূজা আদায় করতে চান। অতএব এই দেবতাদের পূজার মূলে রয়েছে ভক্তি নয় ভয়; অতএব ভক্তরাও সেখানে মুক্তিকামী নয়, ঐহিক সুখ-সুবিধাই ছিল তাদের কাম্য। মঙ্গলকাব্যগুলি সম্ভবতঃ ক্রান্তিকালে সংক্ষিপ্ত পাঁচালি আকারে রচিত হয়েছিল, পরে শক্তিশালী কবির হাতে পড়ে মঙ্গলকাব্যের রূপ ধারণ করে।

লৌকিক সাহিত্য: জনসাহিত্য আসলে লৌকিক সাহিত্য। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য—এতে গীতিকবিতার কোন স্থান নেই, আখ্যায়িকা কাব্যই এদের অবলম্বন। মঙ্গলকাব্যের বাইরে আরো কিছু জনসাহিত্য রচিত হয়েছিল, এদের মধ্যে একটি ধামালি-জাতীয় রচনা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। পল্লীর অর্ধশিক্ষিত কবিদের রচিত ‘পল্লীগীতিকা’-গুলিও (ময়মনসিংহ গীতিকা) লৌকিক সাহিত্যের উল্লেখযােগ্য নিদর্শন। এদের মধ্যেও কাহিনীই প্রধান—এতে যেমন রূপ কথাও আছে তেমনি সমসাময়িক ঘটনারও বর্ণনা আছে। এছাড়া রােসা রাজসভায় মুসলমান কবিগণ ভিন্ন ভাষা থেকে অনুবাদ করে যে সকল কাহিনী রচনা করেন এবং পরবর্তীকালে যার সংখ্যা অনেকগুণ বৃদ্ধি লাভ করে, সেই ‘কিসসা সাহিত্য ও জনসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

চৈতন্য-আবির্ভাবে যুগান্তর: মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাঙলা সাহিত্যে কিছুটা গুণগত এবং অনেকটা পরিমাণগত পরিবর্তন সাধন করে। এই বিবেচনায় ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যকে দু’টি পর্বে বিভক্ত করে থাকেন। অবশ্য বালার তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিও প্রাগুক্ত পরিবর্তন সাধনে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। ১৪৮৬ খ্রীঃ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং ১৪৯৩ খ্রীঃ সুলতান হােসেন শাহের বাঙলার শাসন-কর্তৃত্ব গ্রহণএই দুটি বিষয়ই বাঙলার সমাজ-জীবনে আশার আলাে নিক্ষেপ করেছিল। তাই ঐতিহাসিকগণ শামউদ্দিনের শাসনকর্তৃত্ব গ্রহণ থেকে হােসেন শাহের শাসনকাল পর্যন্ত অর্থাৎ মােটামুটি ১৩৫০ খ্রীঃ থেকে ১৫০০ খ্রীঃ পর্যন্ত কালকে আদিমধ্যযুগ’ বা চৈতনয-পূর্বযুগ’ নামে অভিহিত করে থাকেন। পরবর্তী পর্বে চৈতন্য-প্রভাব ছিল প্রায় সর্বাতিশায়ী। তাই ১৫০০ খ্রীঃ থেকে ১৮০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বিস্তৃত কালসীমাকে ‘অন্ত-মধ্যযুগ’ বা ‘চৈতন্যোত্তর যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়।

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ: আদিমধ্যযুগে সাহিত্যরচনার প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত সীমিত, তাই এই পর্বে রচিত সাহিত্যগ্রন্থের সংখ্যা তেমন উল্লেখযােগ্য নয়, তাছাড়া এই যুগের সাহিত্যে তেমন বৈচিত্র্যও দেখা যায় না। চৈতন্যোত্তর যুগের প্রথম শতকে অর্থাৎ ষােড়শ শতকে বাঙলা সাহিত্যে যেন প্লাবন দেখা দিয়েছিল। তারপরই দেখা দেয় ভাটা। শেষ পর্যন্ত অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যুগের সমাপ্তি ঘটে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুতে বাঙলার রাজনৈতিক আকাশেও তখন পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত সিরাজের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা্র সৌভাগ্যসূর্য অস্তমিত হয়। এর পর সুদীর্ঘ শতাব্দীকাল কোম্পানী শাসনের ঘনঘাের মেঘজালে বাংলার সামাজিক আকাশ সমাচ্ছন্ন-সূর্য-চন্দ্র-তারা সবই অদৃশ্য; কিন্তু তারই আড়ালে চলছিল পরবর্তী পর্বের প্রস্তুতি। ১৮৫৭ খ্রীঃ সিপাহি বিদ্রোহের পর বাঙলার শাসনভার কোম্পানী থেকে হস্তান্তরিত হলাে। সমসাময়িক কালের শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা ছিল ইংলণ্ডের পার্লামেন্টের-মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নামে বাংলা তথা প্রায় গােটা ভারতেরই শাসনভার ন্যস্ত হলাে সেই পার্লামেন্টের হাতে। ১৮৫৮ খ্রীঃ সেই অন্তর্বর্তী কালের শেষ চিহ্ন কবি ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যু এবং পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যধারার সঙ্গে পরিচিত কবি রঙ্গলালের সাহিত্যজগতে আবির্ভাব। ১৮৬১ খ্রীঃ আধুনিক মন্ত্রের উদ্গাতা মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সৃষ্টি এবং রবীন্দ্রনাথের জন্ম বাঙলা সাহিত্যের আকাশে নবসূর্যের আবির্ভাবক্ষণ।

আদিমধ্যযুগ: ১৩৫০ খ্রীঃ থেকে ১৫০০ খ্রীঃ পর্যন্ত ব্যাপ্ত অদিমধ্যযুগ তথা চৈতন্যপূর্ব যুগে রচিত সাহিত্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য-বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। নব-জাগরণের মুহূর্তে প্রাচীন আদর্শের দিকে তাকানাে একটা প্রবণতা সব দেশে সব কালেই দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যেও তাই রামায়ণ ভাগবত এবং সম্ভবতঃ মহাভারতের অনুবাদ রচনার প্রচেষ্টা এ সময় দেখা দিয়েছিল। কৃত্তিবাস ‘রামায়ণ’, মালাধর বসু ভাগবত’ এবং হয়তাে কবীন্দ্র পরমেশ্বর এবং শ্রীকর নন্দী ‘মহাভারত’ অনুবাদ করেন। এই পর্বে ‘মনসামঙ্গল কাব্যের অনুবাদে অগ্রসর হয়েছিলেন সম্ভবতঃ তিনজন কবি—বিজয়গুপ্ত, নারায়ণদেব এবং বিপ্রদাস পিপলাই। ওই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ‘বিদ্যাপতি’—যিনি বাঙালী না হলেও বাঙলা সাহিত্যে এর অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস-ও একালেই বর্তমান ছিলেন বলে অনেকে অনুমান করেন।

১৫০০ খ্রীঃ থেকে ১৭০০ খ্রীঃ পর্যন্তই যথার্থ বিচারে অন্ত্যমধ্যযুগ বা চৈতন্যোাত্তর যুগ রূপে অভিহিত হয়। এ যুগ বিষয়-বৈচিত্র্যে এবং অজস্রতায় অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিষয় অনুযায়ী এ যুগের শ্রেণীবিভাগই অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত হবে। কারণ কবিদের জীবৎকাল বিষয়ে মতান্তরের অবকাশ রয়েছে।

চরিত-শাখা: চৈতন্যোত্তর যুগের মহত্তম কীর্তি চৈতন্য-জীবন-কাহিনী অবলম্বনে রচিত চৈতন্য-জীবনী- গ্রন্থগুলি; এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যােড়শ শতকে রচিত বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত’, লােচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল’, জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত চূড়ামণিদাসের ‘গৌরাঙ্গবিজয়’ এবং গােবিন্দদাসের কড়চা’ (१), চৈতন্য-পরিকর অদ্বৈতাচার্য এবং তৎপত্নী সীতাদেবীর জীবনকাহিনী-অবলম্বনে রচিত শ্যামদাস আচার্যের’ অদ্বৈতমঙ্গল’, হরিচরণদাসের ‘অদ্বৈতমঙ্গল’, ঈশান নাগরের অদ্বৈত-প্রকাশ’, বিষ্ণুদাস আচার্যের সীতাগুণকদম্ব’ এবং লােকনাথদাসের সীতা- চরিত্র।

বৈষ্ণব পদাবলী: চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যেও প্লাবন দেখা দিয়েছিল। এই কবিদের মধ্যে ছিলেন ষােড়শ শতকের যশােরাজ খান, মুরারিগুপ্ত, নরহরিদাস সরকার, লােচনদাস, বলরামদাস, জ্ঞানদাস, বাসু ঘােষ, গােবিন্দ ঘােষ, মাধব ঘােষ, বংশীবদন, অনন্ত দাস, দেবকীনন্দন, শিবানন্দ সেন, নরােত্তম দাস, গােবিন্দদাস কবিরাজ, গােবিন্দ চক্রবর্তী, যদুনন্দন, রায়শেখর, কবিরঞ্জন এবং আরাে অনেকে। সপ্তদশ শতকের মধ্যে কবিদের প্রধান—যদুনন্দন দাস, সৈয়দ মর্তুজা, তরুণীরমণ চণ্ডীদাস এবং আরাে অনেকে। অষ্টাদশ শতকের কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য—ঘনশ্যাম দাস, শশিশেখর, পীতাম্বর দাস, রাধামােহন ঠাকুর প্রভৃতি।

বৈষ্ণব তত্ত্বসাহিত্য: বৈষ্ণব ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটায় বালায় বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে সঙ্গে বিস্তর বৈষ্ণবতত্ত্বসাহিত্যও রচিত হয়েছিল। কবিতাকারে রচিত হলেও এগুলি আসলে প্রবন্ধ জাতীয় বস্তুনিষ্ঠ রচনা। প্রায় প্রত্যেক শতকের কবিদেরই নাম উল্লেখ করা হলাে। ষােড়শ শতকে—লােচনদাস, জ্ঞানদাস, রামচন্দ্র কবিরাজ, শঙ্করদেব মাধবদেব, কবিবল্লভ, শ্যামানন্দ দাস, নরােত্তম দাস। সপ্তদশ শতকে—দেবনাথ দাস, বলরাম দাস, হৃদয়ান্দ দাস, রসিক দাস, অভিরাম দাস প্রভৃতি। এই জাতীয় গ্রন্থের কিছু কিছু অনুবাদও রয়েছে।

অনুবাদ সাহিত্য: অন্ত্যমধ্যযুগের অনুবাদ শাখায় রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবতই প্রধান। যােড়শ শতকে রামায়ণের উল্লেখযােগ্য অনুবাদ নেই, তবে মহাভারতের বিভিন্ন অংশের অনুবাদ করেছেন রামচন্দ্র খান, পীতাম্বর, দ্বিজ রঘুনাথ, অনিরুদ্ধরাম সরস্বতী ও তৎপুত্র গােপীনাথ। ভাগবত এবং অন্যান্য পুরাণ-অবলম্বনে কৃষ্ণকাহিনী রচনা করেছেন—গােবিন্দ, মাধব আচার্য, পরমানন্দ, কবিশেখর, দুঃখী শ্যামদাস, পীতাম্বর। সপ্তদশ শতকে রামায়ণ অনুবাদকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য—অদ্ভুতাচার্য নিত্যানন্দকৃত ‘অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ’, রামশঙ্করের ‘অদ্ভুত রামায়ণ’, রামশঙ্কর দত্তের ‘রামায়ণ’, ভবানীনাথের ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ এবং বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ-পাঁচালি’।

কাশীরাম দাসের মহাভারত-ও এযুগের কীর্তি। মহাভারতের অপর বিশিষ্ট অনুবাদক নিত্যানন্দ ঘােষ। এ ছাড়া এ শতকের অনেকেই মহাভারতের বিভিন্ন পর্ব অনুবাদ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন দ্বিজ অভিরাম, রামেশ্বর নন্দী, রাম কবিরাজ, গােবিন্দ কবিশেখর এবং আরাে অনেকে।

কৃষ্ণ কাহিনী-কাব্য-রচয়িতাদের মধ্যে ভবানন্দের ‘হরিবংশ’, পরশুরাম, বংশীদাস ও জীবন চক্রবর্তীর ‘কৃষ্ণমঙ্গল’, কৃষ্ণদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণবিলাস’, অভিরাম দাসের গােবিন্দবিজয়’ প্রভৃতি।

অষ্টাদশ শতকে অনুবাদ-সাহিত্যের প্রাচুর্য লক্ষণীয় হলেও উল্লেখযােগ্য শক্তির পরিচয় দিতে পেরেছেন এমন লেখকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। এই পর্বের একজন ভূরিত্রষ্টা লেখক শঙ্কর কবিচন্দ্র। ইনি সংক্ষিপ্ত ভারত পাঁচালী’, ‘রামায়ণ পাঁচালি’ এবং ‘কৃষ্ণমঙ্গল’-ছাড়াও একাধিক মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন। অপর অনুবাদকগণ সকলেই রামায়ণ-মহাভারতাদির খণ্ডাংশ মাত্র অনুবাদ করেছেন।

মঙ্গলকাব্য: মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের একটি অতিশয় প্রধান শাখা—মঙ্গলকাব্য। বহুধারায় বিভক্ত এই মঙ্গলকাব্য ও তার গ্রন্থকারদের পরিচয় দান সহজ ব্যাপার নয়; তাই শুধু প্রধান কয়টি নাম উল্লেখ করা হলাে। ‘মনসামঙ্গল কাব্যের তিন শ্রেষ্ঠ লেখকই চৈতন্য-পূর্ব যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যােড়শ শতকে তন্ত্রবিভূতির ‘মনসামঙ্গল, এবং সপ্তদশ শতকে দ্বিজ বংশীদাস এবং কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল ই শুধু উল্লেখযােগ্য। অষ্টাদশ শতকের মনসামঙ্গল কাব্যে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন—জগৎজীবন ঘােষাল, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র, গঙ্গা দাস সেন, ষষ্ঠীবর প্রভৃতি। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী এবং দ্বিজ মাধবের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ষােড়শ শতকে রচিত হয়েছিল। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনার পরবর্তীকালে আর কেউ তেমন উল্লেখযােগ্য কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন নি। উল্লেখ করার মত নাম, সপ্তদশ শতকে—জনার্দন ও রামদেব এবং অষ্টাদশ শতকে মুক্তারাম সেন, ভবানীদাস, বলরাম কবিকঙ্কণ। মঙ্গলকাব্যের অপর প্রধান শাখা ধর্মমঙ্গলে’র উদ্ভব ঘটে সপ্তদশ শতকে। এই পর্বে রয়েছেন—খেলারাম, শ্যামদাস, ধর্মদাস, রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতারাম দাস এবং অষ্টাদশ শতকে—ঘনরাম চক্রবর্তী, শঙ্কর কবিচন্দ্র, সহদেব চক্রবর্তী প্রভৃতি। “শিবায়নের কবিদের মধ্যে সপ্তদশ শতকের দ্বিজ রতিদেব, রামকৃষ্ণ রায় এবং অষ্টাদশ শতকের রামেশ্বর চক্রবর্তী উল্লেখযােগ্য।

এ সকল ধারার বাইরে সপ্তদশ শতকের উল্লেখযোগ্য রচনা–দৌলত কাজীর ‘লােরচন্দ্রানী’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, ‘সতী ময়না’, ‘সপ্তপথকর’ প্রভৃতি এবং অষ্টাদশ শতকের রচনা- রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদাবলী ও ভরতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর, অন্নদা-মঙ্গল এবং বাংলা গদ্য গ্রন্থ দোম আন্তোনিও রচিত ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ ও মনােএল-দা-আসাম্পসাও রচিত “কৃপারশাস্ত্রের অর্থভেদ।

ময়মনসিংহ গীতিকা’ ও অন্যান্য পল্লীগীতিকা সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে রচিত হয়ে থাকতে পারে।