“কাব্যের আত্মা যা-ই হোক, ওর শরীর হচ্ছে বাক্য—অর্থযুক্ত পদসমুচ্চয়।” -আলোচনা করো।
বামন বলেছেন—’কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ’ —ব্যাখ্যা করো।
মহাকবিদের প্রতিভা অপূর্ব শব্দে গ্রন্থণের সাহায্যে যে বস্তু সৃষ্টি করে তাকে আলংকারিকেরা কাব্য বলেছেন, কিন্তু সকল আলংকারিক এবিষয়ে একমত হয়নি। তাঁরা কাব্যের কাব্যত্ব নিয়ে অভিমত পোষণ করেছেন।
কাব্য গঠিত হয় শব্দ সমন্বয়ে। যেমন সব কিছুরই দেহ এবং আত্মা আছে, কাব্যেরই তেমন দেহ এবং আত্মা আছে। একদল আলংকারিক বলেন— কাব্যের আত্মা যাই হোক, সে বিচারে না গিয়ে বলবো যে কাব্যের শরীর হচ্ছে বাক্য—অর্থযুক্ত পদসমুচ্চয়। তাঁদের মতে শব্দ ও অর্থ ছাড়া কাব্যের আর স্বতন্ত্র আত্মা নেই। কাব্যের দেহ অর্থাৎ শব্দাবলি নিয়েই কাব্যের কাব্যত্ব। বাক্যের শব্দ আর অর্থকে আটপৌরে না রেখে সাজসজ্জায় সাজিয়ে দিলেই বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে।
এই সাজসজ্জার নাম অলংকার। কুয়াশাঘেরা পল্লির নদীর বর্ণনায় যেই কবি বললেন— ‘নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার—তখন একদল আলংকারিক বললেন নদীকে নারীর সঙ্গে এই যে অভেদ কল্পনা করে রূপকতা দান করা হল, তা কুশায়াকে ফুল বলা হল—রূপক অলংকার সৃষ্টি করে, এতেই কবিত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই অলংকার সৃষ্টির মাধুর্যের ওপরেই কাব্যত্ব নির্ভর করে। বামন প্রমুখ আলংকারিকেরা তাই বলেছেন—’কাব্যং গ্রাম্যমলঙ্কারাৎ’।
অলংকার আছে বলেই কাব্যের চারুত্ব এবং কাব্যদেহের এই চারুত্ব বা সৌন্দর্য মুগ্ধতার জন্যেই সাধারণ মানুষ কাব্যকে ভালোবাসে। শব্দকে অনুপ্রাস, যমক শ্লেষ প্রভৃতির দ্বারা আর অর্থকে উপমা রূপক, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি, প্রভৃতি নানা অলংকারে চারুত্ব দান করা হয়। তাই একদল আলংকারিক—যাঁরা কাব্যদর্শনে দেহাত্মবাদী—বলেছেন যে অলংকারের জন্যেই মানুষের কাছে কাব্য এতে মধুর ভাবে আস্বাদ্য। ‘নীল আকাশে খইখেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা’—একটি সাদৃশ্যবাচক অর্থালংকারেই এই বাক্যটি কাব্যত্বে উন্নীত হয়েছে।
কিন্তু দেহাত্মবাদীদের সমালোচনা করে আর একদল আলংকারিক বলেছেন যে বাক্য অলংকৃত নয়, অথচ তা চারুত্বমণ্ডিত এবং সুন্দরভাবে আস্বাদনীয়—এরকম বহু উদাহরণ আছে। তাঁরা আরও বলেছেন যে এমন বাক্যে আছে যেখানে শব্দ ও অর্থ—দু’রকম অলংকারই আছে অথচ বাক্যটি কাব্য নয়। সুতরাং অলংকারই কাব্যের সর্বস্ব-একথা বলা ঠিক নয়। একটি উদাহরণ ধরা যাক—
এ নয় গানের দিন। বৎসরের হ্রস্বতম দিনে
স্বল্প সূর্যালোক, ন্যূনতম তাপ আর কুয়াশার আচ্ছন্ন আভার চাঁদ
দুরাশারে পশায় কফিনে, আশারে মিশায় হতাশায়।
তবু তো শীতের আশা, দুরাশাও, দাঁড়ায় আবার ;
দাঁড়ায় মুহূর্ত মৃত, নামমাত্র দিনের খবরে,
বৎসরের হ্রস্বতম দিনের কবরে জন্মে
আবার দ্বিতীয় দিন, হ্রস্বতায় বৎসরে দ্বিতীয়।
এবাক্যে শব্দে ও অর্থে অনুপ্রাস ও রূপক অলংকার রয়েছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও একে যথার্থ কাব্য বলা যাবে না। আবার বাক্য অলংকৃত অথচ শ্রেষ্ঠ কাব্য,–এরও উদাহরণ আছে ; যেমন—
রহিয়া রহিয়া নব-বসন্তে ফুল-সুগন্ধ গগনে
কেঁদে ফেরে হিয়া মিলনবিহীন মিলনের শুভলগনে।
আপনার যারা আছে চারি ভিতে
পারিনি তাদের আপন করিতে,
তারা নিশিদিন জাগাইছে চিতে বিরহবেদনা সঘনে।
পাশে আছে যারা তাদেরি হারায়ে ফিরে প্রাণ সারা গগনে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে অলংকার ছাড়াও কাব্য হয়। এখানে অনলংকৃত বাক্যের সৌষ্ঠব এবং চারুত্ব একে কাব্যত্ব দান করেছে।
Leave a comment