উত্তর: সংসার বিরাগী, ঈশ্বরপ্রেমে মত্ত এবং বাহ্য বিষয়াদিতে উদাস -এক ধরনের মানুষ বাউল নামে পরিচিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’ এই অর্থে বাউল শব্দের উল্লেখ করেছেন। এই মতানুযায়ী স্বয়ং চৈতন্যদেবও নিজেকে বাউল হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ‘বাউল’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতগণের মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকে মনে করেন ‘বাউল’ শব্দটি এসেছে ‘বাউর’ থেকে, যার অর্থ-এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল ইত্যাদি। তাছাড়া উত্তর ভারতে প্রচলিত ‘বাউর’ শব্দটির প্রায়োগিক অর্থের সাথে ‘বাউল’ শব্দের যথেষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও ধারণা করা হয়, ‘আকুল’ শব্দ থেকে যেমন ‘আউল’ তেমনি ‘ব্যাকুল’ শব্দ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন বাউল মতবাদের সূচনালগ্নে দীনদুঃখী সংসার বিরাগী একতারা বাজিয়েদের সাধারণ জনগণ ‘বাতুল’ বলে উপহাস করতো। অনেকে মনে করেন এই ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।

শব্দের উৎপত্তিগত দিক থেকে এর অর্থ যাই হোক না কেন, ‘বাউল’ দ্বারা বুঝানো হয় ঈশ্বরপ্রেমে মত্ত, স্বাধীনচেতা, অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের একদল ভক্ত, যারা বিশুদ্ধ মানবপ্রেমে বিশ্বাসী তারা সমাজে ‘বাউল’ নামে পরিচিত। জীবন ও সমাজ সচেতন বাউল সম্প্রদায় তাত্ত্বিকগোষ্ঠী। ভেদবুদ্ধিহীন উদার মানবতার পরিসরে সাম্য ও প্রীতির সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনায় ধ্যানস্থ হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও চিন্ত াবিদরা যেভাবে সাম্য-মৈত্রী-প্রীতির কথা বলেন তেমনি বাউলরাও সাম্যবাদী প্রেমের বাণী শোনায় মধুর সুরের লহরীতে। বাউলদের সংগীত একাধারে ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, ভজন ও সাহিত্য। সুফি বা বৈষ্ণবদের মতো বাউলরাও সংগীতের মাধ্যমে স্রষ্টার উপাসনা করেন:

‘বীণার নামাজ তারে তারে

আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।’

জগত ও জীবনের সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার রহস্য উন্মোচন করে বাউল সম্রাট লালন সাঁই বলেছেন-

“এই মানুষ আছে রে মন

যারে বলে মানুষ রতন

ডুবে দেখ দেখি মন তারে

কিরূপ লীলাময়।”

যাঁরে আকাশ পাতাল খোঁজ

এই দেহে তিনি রয়।”

সমাজের নিন্দিত লোকজনও বাউলদের উদার মতবাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কারণ, বাউল সম্প্রদায় বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত নন বলে তারা সকল ধর্মের লোকজনকেই আশ্রয় দিয়েছেন। উল্লেখ্য বাউল মতাদর্শে ইসলামি সুফিতত্ত্বের কিছু। বিষয়াদি যেমন আছে, তেমনি, চৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণবতত্ত্বের প্রভাবও আছে। বাউল সম্প্রদায় চৈতন্যদেবকেও ভক্তি করে। এসব সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা মনের মানুষ সন্ধান করে।

তাছাড়া পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। তাই বাউলদের ধারণা সৃষ্টি-জগতের সকল প্রাণীসহ ফেরেশতারা বা দেব-দেবীরা পর্যন্ত মানবভজনা করে। বাউলরা তাই ধর্মের নীতিকথা তুলে মানুষে মানুষে বিভেদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বাউলদের গানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী প্রভৃতি বিভাজনের পরিবর্তে বাউলদের নিকট মানবধর্ম বড়ো ধর্ম। বাউল সম্প্রদায়ের প্রচারিত সংগীতগুলোয় বাঙালি জাতির নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।