সমাজ-সাহিত্যের জন্মভূমি। সমাজ স্থাবর নয়, জংগম। তার চলনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যও চলতে থাকে, অবশ্য সে যদি সমাজসঙ্গী হয়। মাঝে মাঝে ভাব অথবা ভঙ্গির স্থবিরতা সত্ত্বেও প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যে চলতাশক্তি ফুটে উঠেছে সাধারণত প্রবাদ-প্রবচন প্রয়োগে এবং তার নিত্যনব ব্যবহারে। আবার, পূর্ববর্তী কবি এবং কাব্যের দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র হয়ত এভাবেই রচিত হয়েছে। ‘চর্যাগীতি’ পরবর্তী ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যেও লক্ষণীয় সেই পদক্ষেপ—কথনে ভাবনে মরণে-বাচনে যার অনেক পক্তি চর্যাকার-সমকালীন সমাজ ও কবি-উদ্ধৃতি এবং বড়ু চণ্ডীদাসের নিজের যুগ এবং ধারণার সমন্বিত যোগফল বলে মনে হয়।

সাহিত্যে বা কাব্যে প্রবাদ-ব্যবহারের কারণ,

(ক) লোকসমাজের প্রাত্যহিক আচরণ ও রীতি-নীতিকে প্রতিফলনের আগ্রহ, (খ) কাব্যের বিষয়বস্তুকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য অথবা স্বল্প কথায় বৃহৎ অর্থ প্রকাশের প্রয়োজন-উপলব্ধি, (গ) কৌতুক বা ব্যঙ্গের চমকে বক্তব্যকে উজ্জ্বল করে তোলার চিন্তা—চরিত্রের উক্তিতে দীপ্তি সঞ্চার, (ঘ) বাস্তববাদী মনোভঙ্গী ইত্যাদি।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রাচীন প্রবাদ-প্রবচন ও বিশেষার্থবোধক বাক্য আছে যথেষ্ট। তবু রাধা কৃষ্ণ ও বড়াইয়ের মুখে সেইগুলি সরাসরি যোজনার ফলে চরিত্রগুলির মধ্যে যেমন একদিকে ফুটে উঠেছে তৎকালীন সমাজের সমষ্টি মানুষের তাপ ও ভাপ, অন্যদিকে কবি-চিত্তে পেয়েছে নাট্যকার-সুলভ নিরপেক্ষ থাকার অবকাশ এবং সংলাপ সৃষ্টিতে আকাঙিক্ষত সাফল্য। বস্তুতঃ বড়ু চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব এখানেই যে, বাংলাদেশের নিছক প্রাবচনিক উক্তি বা প্রচলিত প্রবাদগুলিকে তাদের মৌল, রুক্ষ অথচ প্রাণময় উৎস থেকে কোনোরকম আঙ্গিকের মধ্যস্থতা ছাড়াই তুলে এনেছেন (কাব্যটি কোন্ শ্রেণীর সে নিয়ে মতভেদ আছে)। তাই বোঝা যায়, বাংলার বাক্-রীতিকে বস্তুভূমিক নিজস্ব সম্মানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দিকেই তার ঝোক বেশি, অতিরিক্ত বাগ্-বৈভব সৃষ্টিতে নয়।

কাহিনী অনুসরণে দেখা যায়, প্রবাদ-প্রবচন সবচেয়ে বেশি মাত্রায় উচ্চারিত হয়েছে রাধার কথায়। এর একটি কারণ হতে পারে, গ্রাম বাংলায় স্ত্রীসমাজের ভাষাতেই ‘প্রবাদ’ সব থেকে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। রাধা এই বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের গোপসমাজের মেয়ে। তার বাগ্‌ভঙ্গিতে প্রবাদ-প্রাচুর্য তাই প্রত্যাশিত। দ্বিতীয় কারণটি অনুমান করা যায় রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায়—“..সৌন্দর্য্যের সঙ্গে বরঞ্চ প্রখরতা শোভা পায়, যেমন ফুলের সঙ্গে কাটা—তেমনি শাণিত কথা মেয়েদের মুখে বড্ড বাজে বটে, তেমনি সাজেও বটে (ছিন্নপত্র)” কাব্যেও দেখা যায়, “তীনভুবনজনমোহিনী” রাধার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত অসংখ্য প্রবাদ-প্রবচন যেন কৃষ্ণের প্রতি নিক্ষিপ্ত লক্ষ্যভেদী বাণ।

কৃষ্ণের দুর্বিচার অথবা অত্যাচারকে কেন্দ্র করেই রাধার চিত্ত জ্বলে উঠেছে বাক্যের ঝলকে। কখনো বিধিলিপিকে এড়াতে না পারার নিরুপায় ক্ষোভে—‘ললাট লিখিত খণ্ডন না জাএ’ (দানখণ্ড) যে ক্ষোভ স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালী সমাজের স্বভাবধর্ম; ঘনরাম থেকে মানিক গাঙ্গুলি, ভারতচন্দ্র এমনকি মধুসুদন পর্যন্ত নানাভাবে যার কথা কাব্যে রূপায়িত। কখনো নিজের রূপ এবং মর্যাদার ইঙ্গিত দিয়ে “বড়ার বহুয়ারী” রাধা কৃষ্ণকে করে কঠিন ব্যঙ্গ— “দেখিল পাকিল বেল গাছের উপরে। আর তিল কাক তাক ভখিতেঁ না পারে” কিম্বা, “মাকড়ের হাতে যেহ্ন ঝুনা নারীকল”, “মাকড়ের যোগ্য কভো নহে গজোমতী” দুর্লভ ও সুরক্ষিত যৌবন ( স্মরণীয় বেল-এর সঙ্গে যুবতী-স্তনের প্রাচীন উপমা) এবং কাকের মতো কর্কশ ও লোভী ঘৃণ্য কাহ্ন’, মাকড়ের মতো নির্বোধ কামুকের কাছে ‘গজুমতী’ বা সুন্দরী নারীর প্রেম নিবেদনের অচরিতার্থতা ইত্যাদি। অযোগ্য ব্যক্তির দুর্লভ বস্ত্রলাভের আকাঙক্ষাকে আঘাত করা হয়েছে কখনো অন্যভাবে— “মজুরিআঁ হুঁআ কেহ্নে এত বড় রঙ্গ। আলাপ হত চাহ বড়ার সঙ্গ। হার্থে হার্থে চাহ কাহাঞি আকাশের চান্দ” (ভারখণ্ড)।

ধনরক্ষার সঙ্গে চুরির অনিবার্য যোগ এবং লোভের প্রসঙ্গটিও এসেছে বারবার— “পরধন দেখিলে কি পাএ ভিখারী” (দানখণ্ড), “মুদিত ভাণ্ডারে কাহ্নঞি না সাম্বাএ চুরী” (নৌকাখণ্ড), “দেখিয়া সাধুর ধন চোর পড়ী মরে” (ভারখণ্ড)। ব্যঙ্গ স্বাদু এবং উপভোগ্য হয়ে উঠেছে কোনো ক্ষেত্রে— “বিরহ পুড়িআঁ কাহ্ন হাকল বিকল। জড়ুয়া দেখিআঁ যেহ্ন রুচক আম্বল”, “জুড়ায়িলে সোআদ লাগে তপ্ত দুধ”, “চুণ বিহনে যেহ্ন তাম্বুল তিতা। অলপ বয়সে যেহ্ন বিরহের চিন্তা”, “কাতের ভোখ কাহ্নঞি ফলে না পালাএ” “কাটিল ঘাআত লেম্বুরস দেহ কত” ইত্যাদি।

পুরুষ-কেন্দ্রিক সমাজের কাছে নারীর নিরুপায় আত্মসমর্পণ, অপরিণত বয়স থেকেই রতিচেতনার আগ্রহ, একলা দিন কাটানোর বিরহ-আর্তি সবই যেন রাধার কথায় বহু হৃদয়ের দোলায় বেজে উঠেছে “চারপাশে চাহোঁ যেন বনের হরিণী ল। নিজ মাসে জগতের বৈরী” (হরিণী’র সঙ্গে দেহের তুলনাটি ‘চর্যাপদ’ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এমন কি বিদ্যাপতি, মুকুন্দরামের পক্ষেও বহু ব্যবহৃত)। –পুরুষের মাংসল ক্ষুধার সামনে নারী-নিগ্রহের জ্বালা এখানে সোচ্চার। শিশুর কামার্তির ফলে “পোএর মুখে পরবত টলে। গুরু পাপে বেড়িলের অলপ কালে।” তপ্ত হৃদয়ের যন্ত্রণায় রাধা বলে ওঠে কখনো—“বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী। মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী”, কিম্বা “যে পুণি অধম জন অস্তরে কপট। তাহার সে নেহা যেহ্ন মাটির ঘট।” কখনো-বা বিড়ম্বিত জীবনের হাহাকার শোনা গেছে এইভাবে: “দহ বুলী ঝাপ দিলোঁ সে মোর সুখাইল ল” অথবা “যে ডালে করো মো ভরে সে ডাল ভাঙ্গিঞা পড়ে।”

এই সমস্ত প্রবাদে পুরুষ শাসিত সংসার-সমাজে নারী-মনের অসন্তোষ ও কান্নার গুঞ্জরণ শোনা যায়। পরবর্তী মঙ্গলকাব্যগুলিতে ‘নারীগণের পতিনিন্দা’ অংশে তাই হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

কৃষ্ণের কথায় প্রবচনের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। তাম্বুলখণ্ডে বড়াইয়ের দুতীয়ালীর ক্ষমতা প্রসঙ্গে সে বলে—“যে খানে শুচী না জাএ। তথা বাটিআঁ বহাএ।” এটি পরবর্তীকালে টেকচঁাদের রচনায় এবং দামোদর মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে অবিকৃতভাবেই পাওয়া যায়—“যেখানে ছুঁচ চলে না সেখানে বেটে চালান।” কৃষ্ণের আর একটি বচনে পুরুষ প্রেমের বৈশিষ্ট্যটি ধরা যায়— “সোনা ভাঙ্গিলে আছে উপাএ জুড়িএ আগুনতাপে। পুরুষ নেহা ভাঙ্গিলে জুড়িএ কাহার বাপে।” চরিত্রস্খলনের দুর্নীতি এখানে অদ্ভুত চাতুর্যের ছদ্মবেশে সুরক্ষিত। কৃষ্ণের পরবর্তী প্রবচনটি কিন্তু এযুগে তেমন পরিচিত নয়— “মারত্তক যে না মারে। তার পাণী না লএ পীতরে।” অর্থাৎ বধোদ্যতকে যে না মারে পিতৃপুরুষ তার জলগ্রহণ করেন না। বলা বাহুল্য, রাধার প্রতি প্রবাদটির ব্যবহার সুপ্রযুক্তও নয়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধার পক্ষে সখী বা অন্য গাঁয়ের বধূদের সঙ্গে দুধ-দই বিক্রী করার কাজ লোকায়ত সমাজের সমর্থ ছিল বলে মনে হয়।

সজনে নির্জনে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার নিত্যসঙ্গমের বিবরণেই ছিল কবির দৃষ্টি নিবদ্ধ তবু সেই লক্ষ্যে উপলক্ষ হয়ে উঠেছে ঘরনী রাধার দুর্লভ পরিচয় দান। প্রথমেই আছে গোপ পরিবারের নিত্যকর্ম— দুগ্ধমন্থনে দ্রব্য তৈরি– “ঘোলে ঘরত মাথানি না বুলে” তারপর আছে রান্না— ভাত, ভাজা, ঝোল, অম্বল ইত্যাদি। সুনিপুণা রাঁধুনী রাধা রন্ধন করে ভালোই, কিন্তু বাঁশীর ডাক শোনার পর থেকেই ইদানীং ‘রান্ধনের জুতী’ আর সে খুঁজে পায় না। সেই সচেতন অবস্থায় বিনা জলে চাল চড়ায়, পটোলের নামে কাঁচা সুপারি ঘিয়ে ভাজে, নিমঝোলে দিয়ে ফেলে লেবুর রস। রাধা নিজেই স্বীকার করে “বাঁশীর শবদে মো আউলাইলোঁ রন্ধন।”

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে গ্রাম-বাংলার সমাজ-জীবনের যে দৃশ্য উপস্থিত তা প্রধানতঃ এইভাবে প্রবাদ-প্রবচনের মধ্য দিয়েই মধ্যযুগের সমকালীন প্রাণোত্তাপকে প্রকাশ করে।