উত্তর: পল্লির জনগোষ্ঠী লোকসাহিত্যে অবদান রেখেছেন। বাংলার মাঝিরা নৌকায় পাল তুলে মনের সুখে ভাটিয়ালি গান গায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের গাড়োয়ান বা গুরুর গাড়ির চালক গাড়ি চালাতে চালাতে ভাওয়াইয়া গানের সুর তোলে। বাউলেরা একতারা বাজিয়ে তাদের তত্ত্বকথা গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। লোকসাহিত্য মূলত মৌখিক সাহিত্য। ফলে এ ধরনের সাহিত্য স্মৃতিসহায়ক কৌশল, ভাষার গঠনকাঠামো এবং শৈলীর ওপরও নির্ভর করে। এদেশের লোকসাহিত্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাউল গান।

বাউল গান মূলত বাউল সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গান। বাংলার লোকসংগীত তথা বাংলা লোকসাহিত্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাউল গান। বাউলরা বাউল গানের মধ্যে দিয়েই তাদের মতামত এবং দর্শন প্রকাশ করে। বাংলার লোকসংগীতের মধ্যে একমাত্র বাউল গানই হয়েছে শিরোমণি, হয়েছে সর্বসাধারণের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। জাত-পাত, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্রই হলো বাউল দর্শন। বাউল সাধকরা সাধারণত সংসার বিরাগী। তাদের সাধনা অতি প্রাচীন। তবে এ গানের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য আমাদের জানা না থাকলেও অনুমান করা হয় সতেরো শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এ গানের প্রচলন ছিল। আর তখন থেকেই বাউলরা তাদের একমাত্র সাধনা সহজ পথের সন্ধান করে আসছে, যা তাদের সংগীতের মধ্যেই অন্তর্নিহিত। তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের দেহ যা তাদের মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক।

বাউল গান মানুষের জীবনদর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন। বাউল মতবাদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম এবং সুফিবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে, আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন। সাধারণত অশিক্ষিত হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন। তারা তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন।

বাংলার লোকসাহিত্যের অনন্য আধার বাউল গানের প্রবাদ পুরুষ লালন সাঁই। তার বাউল গানের মূর্ছনায় আজও কেঁপে ওঠে বাংলার লোকসাহিত্যের অঙ্গন। তার দেহতত্ত্ববাদের কবিতাবলি গান হয়ে উঠেছে কিন্তু গানের আগে সাহিত্যের অগ্রাধিকার। কবির কথায়, ‘সেই সত্য, যা রচিবে তুমি’ আর লালন ফকিরের রচনায় গান তো তখন আর গান নয়, গান ও কবিতার সূক্ষ্ম সীমারেখায় দাঁড়িয়ে বাংলার কবিতা প্রেমিক আজও হাতড়ে মরে সেই আধুনিকতাকে :

“আমার বাড়ীর কাছে আরশী নগর,

এক পড়শী বসত করে।

আমি একদিন না দেখিলাম তারে॥”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বে বাউল সম্প্রদায়টিকে বাংলার মানুষ কেবলই উদাসীন, খেপা, ছন্নছাড়া তি প্রতিভাতায় ফেলত। তাদের রচিত গান নিছক পাগলামি ব্রজে প্রতিঘাত হতো। শুদ প্রচারের অভাবে বাউল গান যে কত উচ্চমার্গের লোকগান তা বুঝতে বাঙালির অনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এই খেপামি ও উদাসীনতার তাড়নায় এ সম্প্রদায় বাংলা সংস্কৃতির তথা লোকসাহিত্যকে কতখানি সমৃদ্ধ করে এসেছে তা আমরা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। মুগ্ধ হয়েছি আমরা এদের রচনাশৈলীতে। ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা গানের সংস্কৃতি। আধ্যাত্মিক এবং দেহতত্ত্বের ওপর এ লোকগান ছড়িয়েছে মুখে মুখে।

বাউলের সৃষ্ট লোকসাহিত্য সর্বজনীন দেহতত্ত্ববাদ আজ সর্বজনবিদিত। রবীন্দ্রনাথও অকপটে স্বীকার করেছেন সমগ্র বাউল সম্প্রদায়ের কাছে তার অপরিশোধিত ঋণের কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘The Religion of Man’ বইটির এপেন্ডিকসের একটি অধ্যায় রয়েছে যার নাম ‘The Baul Singers of Bengal’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাতড়ে বেড়িয়েছেন এই অমোঘ সত্যক আর তাই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সি ডিমক রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন ‘The Greatest of The Bauls of Bengal’.

বাংলা লোকসাহিত্যের বিশেষ অংশ বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ, সিরাজ শাহ্ প্রধান। এদের ও অন্যান্য বাউল সাধকের রচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসংগীত’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এসব গানকে আবার ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া গান’ নামেও অভিহিত করেন। বাউল গান সাধারণত দুটি ধারায় পরিবেশিত হয় আখড়া আশ্রিত সাধন সংগীত এবং আখড়া বহির্ভূত অনুষ্ঠানভিত্তিক। আখড়া আশ্রিত গানের ঢং ও সুর শান্ত’ এবং মৃদু তালের অনেকটা হামদ, গজল কিংবা নাত সাদৃশ্য। লালন আখড়ায় বসে ফকিররা এ শ্রেণির গান করে থাকে। অপর ধারার চর্চা হয় আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানাদিতে, জনসমক্ষে। এ গান চড়া সুরে গীত হয়।

বাউল গানে সাধারণত দু-ধরনের সুর লক্ষ করা যায়। প্রথম কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর এবং অন্য সব কলিতে কিছুটা ভিন্ন সুর। সবশেষে দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ পুনরায় গীত হয়। এ গানে অস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। অস্থায়ীকে কখনও ধুয়া, মুখ বা মহড়া বলা হয়। দ্রুত লয়ের এ গানে প্রতি অন্তরায় পর অস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো গানে সঞ্চারী থাকে; আবার কোনো কোনো গানে নাচেরও প্রচলন রয়েছে, যার উৎস গ্রামীণ পাঁচালি গান বলে মনে করা হয়। তবে আখড়া আশ্রিত বাউল গানে নাচের প্রচলন নেই। কিছু কিছু বাউল গান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। তবে বাউল গানে সুফিভাবনাই প্রবল। বাউল গানের একটি বড় সম্পদ তার গায়কী বা গায়নশৈলী।

বাউল সম্রাট লালন সাঁই তার দীর্ঘ সংগীত জীবনে অসংখ্য বাউল গান সৃষ্টি করেন যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এমনকি বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছেও লালনের গান আধুনিকতার প্রতীক হিসেবেই ধরা দিয়ে আসছে। মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, জীবনবোধ, ধর্ম, প্রেম এবং দেশের কথাই বেশিরভাগ সময় উঠে এসেছে লালনের গানে। লালনের গানের সংখ্যার তেমন কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। তবে তার সৃষ্ট গান অসংখ্য হওয়ায় সব গান সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমান বাংলায় বাউল গানই সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রায় সব বয়সের শ্রোতাই তাই সবটা না বুঝলেও এ গান শুনে আন্দোলিত ও আপ্লুত হয়। বাউল মূলত আখড়ার গান- যেখানে গুরু কিংবা সাইজি গানের তত্ত্বকথার ভিতর দিয়ে তার শিষ্যদেরকে দেহকেন্দ্রিক সাধন ভজনের ক্রিয়াকরণ- বুঝিয়ে দেন; কখনওবা সাধক তার একান্ত আপন প্রার্থনা বা আত্মনিবেদনে নিমগ্ন হন গানের অতলস্পর্শী সুরের আমেজে।