বাংলা রচনা : বই পড়ার আনন্দ |
বই পড়ার আনন্দ
অথবা, পুস্তক পাঠের আনন্দ
অথবা, গ্রন্থ পাঠের আনন্দ
[ সংকেত : ভূমিকা; পুস্তক পাঠের উপকারিতা; পুস্তক পাঠের আনন্দ; সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় বই; বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগের উত্তম উপায় বই; মনের স্বাস্থ্যবিকাশে পুস্তক পাঠ; পাঠকচিত্তে গ্রন্থপাঠের প্রভাব; উপসংহার। ]
ভূমিকা : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ।…
বিশাল বিশ্বের আয়ােজন;
মন মাের জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারই এক কোণ ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে —
সৃষ্টির সেই উষালগ্ন থেকেই মানুষ নিজেকে ব্যক্ত ও ব্যাপ্ত করতে চেয়েছে; চেয়েছে তার মহৎ ও বিচিত্র সৃষ্টিশীল উপলব্ধিকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে। সীমিত জীবনের মধ্যে অনন্ত জীবনের স্বরূপ অনুভবের আকাক্ষা মানুষের সহজাত প্রবণতা। সেই অনুভবের অন্তর্গত সাড়া নিয়ে যুগে যুগে শিল্পীরা রূপে, রঙে, ভাষায়, ছন্দে, ইঙ্গিতে, চিত্রে, সংগীতে, চিত্রকল্পে, উপমা, অলংকরণে মূর্ত করে তােলেন তাদের বিচিত্র সৃষ্টি। পুস্তক হলাে এসব সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তু । কেননা, বইয়ের অভ্যন্তরে আছে আলােয় ভরা কালাে বর্ণের আনন্দলােক। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি নিজের বুকে নিয়ে অনাগত পাঠকের জন্য চির অপেক্ষমাণ হয়ে আছে বই। বইয়ের পাতায় জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কল্লোল শােনা যায়। মানুষ তার আত্মার আত্মীয়ের তথা বিশ্বমানবের সাহচর্য ও সঙ্গ লাভ করে গ্রন্থের মাধ্যমে। অনাদিকাল থেকেই গ্রন্থ পাঠে মানুষ অনাবিল শান্তি লাভ করে আসছে। প্রাজ্ঞ মনীষী ও সাহিত্য স্রষ্টাগণ যুগে যুগে পাঠকের হাতে সৃষ্টির অমৃত পাত্র তুলে দেন । পাঠক নির্বিকল্প রসানন্দে আবিষ্ট হন। আর সমুদয় পাঠকের রসাস্বাদনেই পুস্তক প্রণেতার সম্পূর্ণ সার্থকতা।
পুস্তক পাঠের উপকারিতা : বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তয় বলেছেন- ‘Three things are essential for life and these are books books and books। বই জ্ঞানের ভান্ডার, বােধের আধার, আনন্দের আনন্দলােক, মানবিক শুদ্ধতার শান্তিনিকেতন । পুস্তক পাঠে মানুষের মনে জাগে আনন্দ-বেদনার দার্শনিক সত্যবােধ। পুস্তক পাঠের প্রভাবেই মানবজীবন সুন্দর ও মহৎ হয়ে ওঠে। মানুষের মনে। এনে দেয় নম্রভাব, সহানুভূতি, মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতির ভাব । যুগে যুগে গ্রন্থ দিয়েছে ত্যাগের দীক্ষা, করতে শিখিয়েছে সত্য ও সুন্দরের সাধনা। প্রকৃতপক্ষে মনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে সহজ পন্থাই হলাে পুস্তক পাঠ। পুস্তক পাঠ মানুষের দৃষ্টিকে উদার করে, মনকে করে উন্নত। দুঃখ-কষ্ট, শােক-তাপ, হতাশা, অবসাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে পুস্তক পাঠেই মানুষ স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করতে পারে । তাই অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন- ‘বই পড়াকে যে যথার্থ হিসেবে নিতে পারে, সংসারের দুঃখ-কষ্টের বােঝা তার অনেকখানি কমে যায় ।
পুস্তক পাঠের আনন্দ : মানুষের আনন্দ লাভের বিচিত্র পথ রয়েছে। তার মধ্যে গ্রন্থ পাঠ আনন্দ লাভের শ্রেষ্ঠ পথ হিসেবে বিবেচিত। ভিনসেন্ট স্টারেন্ট বলেছেন- “When we buy a book we buy pleasure.’ পুস্তক পাঠ মানুষের কর্মক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা ও হানাহানির মধ্যে ক্লিষ্ট-পীড়িত চিত্তের ক্লান্তি দূর করে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি । গ্রন্থ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু । জীবনের নানাবিধ। অভিঘাত আমাদের যখন উন্মত্ত করে তােলে তখন আমরা সান্ত্বনা, সহানুভূতি ও আনন্দের জন্য ছুটে চলি গ্রন্থাগারের দিকে। পুস্তকের পেয়ালা হতে তৃষ্ণার্ত চোখে পান করি আনন্দলােকের অমৃত; শান্ত-শীতল করি অশান্ত-উত্তপ্ত অন্তর । নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যায়, তখন সেই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে, হতাশা থেকে মুক্তি দিতে পারে। একটি ভালাে বই। মানুষের উচ্চতর বৃত্তিগুলাে চায় সত্য, জ্ঞান ও আনন্দের আলাে। আর বই সত্য ও জ্ঞানের সন্ধান দিতে, আনন্দলােক সৃষ্টি করতে সর্বাধিক সাহায্য করে থাকে। বই সত্য ও আলাের পথ দেখিয়ে ব্যক্তিকে বিশুদ্ধ করে গড়ে তােলে। পুস্তক পাঠের আনন্দ প্রসঙ্গে মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন- ‘সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হলাে মনের ভেতর আপন ভুবন। সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার। ততই বেশি হয়।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় বই : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সঁকো বেঁধে দিয়েছে।’ গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম-অগ্রগতির পথে । আমাদের বৃহত্তর জীবনের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড়াে সঙ্গী এবং শক্তিশালী সম্পদ হলাে বরেণ্য মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই । এসব বই পড়েই আমরা তাদের মহৎ চিন্তাচেতনা ও বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি ।
বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগের উত্তম উপায় বই : সমগ্র বিশ্বকে জানতে হলে গ্রন্থ পাঠের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বাকায়। এই পাঠের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি । মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিশ্বের অজস্র গ্রন্থ। গ্রন্থপাঠ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তােলে। অতীতের ঐতিহ্য নানা সৎ-অসৎ চিন্তার অনুশীলন ও বিচিত্র ভাবধারা নিহিত রয়েছে গ্রন্থরাজিতে । তাই বিচিত্র জাতি, দেশ ও সমাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য গ্রন্থের সাহায্য ছাড়া গত্যন্তর নেই ।
মনের স্বাস্থ্যবিকাশে পুস্তক পাঠ : দেহ আর মন নিয়েই মানুষ । দেহের পুষ্টির জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়ােজন, তেমিন মনের স্বাস্থ্যের জন্য মানসিক খাদ্য অপরিহার্য। মনের খাদ্য আহরণ করতে হয় রূপ-রসের আনন্দ-বাজার থেকে । মনের ঐশ্বর্যের গুণেই মানুষ মহৎ হয়, হয় মৃত্যুঞ্জয়ী। পুস্তক হলাে সেই আনন্দ-ঐশ্বর্যের খনি । মনের খাদ্য তাই প্রত্যক্ষ নয়, তা অনুভবের বিষয়, উপলাকার ব্যাপার । সেই ভাব-উপলব্ধির সৌন্দর্য সমগ্র জীবনেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। মহৎ বইয়ের প্রভাবে, তাতে অভিব্যক্ত ব্যঞ্জনার অনুরণনে, সত্যের দ্বার। মুক্ত হওয়ায় আমরা হৃদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যােগ অনুভব করি । পুস্তক যুগে যুগে মানুষকে দিয়েছে মহৎ ও উন্নত জাবনের দক্ষিা । পুস্তক পাঠে মানুষের মানসিক রুচির পরিবর্তন ঘটে এবং তা নিম থেকে ঊর্ধপানে ধারিত হয়। মানুষ তার ভেতরের সাড়া শুনতে পায় এবং নিজেকে চিনতে শেখে, বুঝতে শেখে অবাধের অবগুণ্ঠনে ঢাকা জীবনের সার-সত্যকে। পুস্তক মানবজীবনের মহিমাকে করেছে গৌরবদীপ্ত । অধর্ম-অন্যায়কে আশ্রয় করলে পরাজয় যে তার অনিবার্য, শক্তির দম্ভস্ফীত মানুষও যে নেপথ্য নিয়তির নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অমিত আকাঙ্ক্ষার অসংযমে, হিংসার পরিণামে, দ্বিধা-দ্বন্দের দোলাচল মনােভাবে জীবন যেখানে সর্বনাশ কবলিত, সেখানে ভােগ নয় ত্যাগ, মােহ নয় কল্যাণ- এই চিরন্তন সত্যই পুস্তকে নিত্য উদ্ভাসিত। পুস্তক পাঠ আমাদের মনের সংকীণতা দূর করে; উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বভ্রাতৃত্ববােধে । তাই মনের স্বাস্থ্য বিকাশে এবং রুচির উন্নতি সাধনে পুস্তক পাঠের গুরুত্ব অনির্বচনীয়।
পাঠকচিত্তে গ্রন্থপাঠের প্রভাব : মহাকবি গেটে পুস্তক পাঠের মাধ্যমেই আনন্দ খুঁজে পেতেন । পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম নিভৃতে বৃক্ষতলে স্বর্গ রচনার জন্য উপকরণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে একখানি কাব্যেরও স্থান ছিল। তিনি বলেছেন- ‘রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালাে চোখ ঘােলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্তযৌবনা যদি তেমন বই হয়। আবার কোনাে একজন মনীষী বলেছেন, সাহিত্য অমৃতায়মান শক্তির উৎস । শক্তির কল্পফলের রস। তাই এ চির আধি-ব্যাধি বিজড়িত, কর্ম তাপতপ্ত নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন সংসারে যে জাতি জ্ঞানামৃত পান করে, সে জাতি মরণ তন্দ্রার মধ্যেও বেঁচে ওঠে, অবসাদের মধ্যেও আনন্দ পায় । আনাতােল ফ্রাস্ পুস্তক পাঠের আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলেছেন, নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই একটা একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে। বস্তুত মাতৃদুগ্ধের অমৃতধারা মাতৃভাষার মধ্যে সঞ্চারিত আছে। তাই মাতৃভাষার সাহিত্যে যে ভাব প্রবাহ ছােটে তা জাতির প্রাণের মধ্যে স্পন্দন জাগায় । সাহিত্য প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা বলে। প্রাণে প্রাণে প্রেরণা ছােটায় । তাই বিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গাের্কি বলেছেন, আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছেই ঋণী।’ সত্যি বলতে, বই ছাড়া স্বর্গীয় আনন্দ অপূর্ণ ।
উপসংহার : পুস্তক পাঠে মানুষ আনন্দ লাভ করে থাকে সত্য, তবে আনন্দ উপলব্ধির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। আর তার জন্য অধ্যবসায়ী হওয়া বাঞ্ছনীয় । উৎকৃষ্ট গ্রন্থই মানুষকে প্রকৃত সুখ ও আনন্দ দান করতে পারে । মহৎ বই পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব ও সার্থক ব্যক্তিত্ব বিকাশে জোরালাে ভূমিকা পালন করে। একমাত্র সাহিত্যই দেশে দেশে, কালে কালে, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে। সাহিত্য মানুষের মনের রুদ্ধ দ্বার খুলে মানুষকে কল্যাশ্বতে অনুপ্রাণিত করে তােলে । মােটকথা, পুস্তক পাঠে মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটে । যে জাগরণ গােপনে গােপনে, অলক্ষ্যে বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে; ক্ষণকাল থেকে চিরকালের দিকে। তাই ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামিসহ সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাতে সকলেরই বেশি বেশি বই পড়া উচিত।
Leave a comment