উত্তর-রৈবিক বাংলা কবিতার এক অন্যতম পুরোধা কবি-চিত্রনাট্যকার ছোটগল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র । ‘কল্লোলে’র বিখ্যাত ‘ট্রায়ো’র একজন।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের জন্ম:
প্রেমেন্দ্র মিত্রের জন্ম ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দের ৩ মে, কাশীতে। (মতান্তরে ১৯০৩ খ্রীঃ সেপ্টেম্বর মাস, মঙ্গলবার)। বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র, মা সুহাসিনী দেবী। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে চলে আসেন উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরে। এখানেই শিক্ষা শুরু হয়। তবে মাতামহ রাধারমণ মারা গেলে ছয় বছরের শিশু প্রেমেন্দ্রকে চলে আসতে হয় গ্রাম বাংলায় নলহাটিতে। এখানে ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে স্কুলে ভর্তি হন। তবে এখানেও বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠেনি। এরপর শিক্ষা শুরু হয় প্রথমে কলকাতায়, পরে ঢাকায়। তিনি স্থান ত্যাগ করেন, আসেন কলকাতার ভবানীপুরে। ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে তিনি সাউথ সুবার্বন স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখানে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে সহপাঠী রূপে পান। এই সময় তাঁর কবিতা লেখার সূচনা হয়। ১৯২০ খ্রীস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হন। পরে এগ্রিকালচার কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য শ্রীনিকেতন চলে যান। কিন্তু এগ্রিকালচারে ভর্তি হওয়ার পরেও তিনি মত পরিবর্তন করে তিন মাস পরে কলকাতায় ফিরে আসেন। সুবার্বন কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এইসময় ‘সচল সংঘ’ নামে একটি সাহিত্যচর্চার আসরে যোগ দেন। ১৯২৩-এর মে মাসে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শিশিরচন্দ্র বসু এবং বিনয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘আভ্যুদয়িক’ নামে একটি সাহিত্যিক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। দু’বছর ডাক্তারি পড়েন। এই সময় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় পর পর দুটি গল্প প্রকাশিত হয়।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কর্মজীবন:
তার কর্মজীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। স্কুল মাস্টারী, ওষুধের বিজ্ঞাপন লেখা, ছোটদের জন্য রচনা, পত্রিকা সম্পাদনা, চিত্রনাট্য রচনা ও সিনেমা-শিল্পে যোগদান, কবিতা গল্প-উপন্যাস-ফিচার-রোমাঞ্চকর রচনা প্রকাশ, অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করা প্রভৃতি। লেখাকে জীবিকা রূপে গ্রহণের পূর্বে তিনি নানারকম কর্মসূত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন; যেমন—১৯২৫ সালে চড়কডাঙ্গা এম. ই. স্কুলে কিছুদিন সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকুরি, ১৯২৬ সালে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ এ্যাসিস্টেন্টের পদে যোগদান, ১৯২৮-এ সুভাষ বসুর ‘বাংলার কথা’ দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক এবং ‘সংবাদ’ ও ‘খবর’ পত্রিকা সম্পাদনা, ১৯৩১-এ বেঙ্গল ইমিউনিটিতে কাজ করা, ১৯৩৩-এ ‘রংমশাল’ পত্রিকা এবং ১৯৩৬-এ ‘নবশক্তি’ পত্রিকা সম্পাদনা, সরকারী অনুবাদকের কাজ করা, বেঙ্গল ইমিউনিটির প্রচার সচিবের পদ ত্যাগ করে দেবদত্ত কোম্পানীর ফিল্মের পাবলিসিটি অফিসারের পদ গ্রহণ করা, কিং থিয়েটার, নিউ থিয়েটার্স-এ কাজ করা, অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব, চিত্রনাট্য লেখা, মুম্বাই ও কলকাতায় বারবার যাতায়াত, ১৯৫৫-তে আকাশবাণীর প্রোগ্রাম প্রোডিউসার হওয়া, সেখান থেকে তিন বছর আকাশবাণীর ইস্টার্ন জোনে ‘এ্যাডভাইসার’ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ইত্যাদি। ১৯৫৭ এ বেলজিয়ামে তৃতীয় বিশ্ব কবিতা উৎসবে যোগদান করেন। তার প্রতিভা ছিল বহুমুখী, শিল্পীসাহিত্যের বহু বিচিত্র শাখায় ছিল অনায়াস বিচরণ। সংখ্যায়ও তা অল্প নয়। প্রায় ত্রিশটি ছোটগল্প সংকলন, পঞ্চাশটি উপন্যাস, শিশু ও কিশোর সাহিত্য, ত্রিশটি নাটক, চারটি প্রবন্ধ, আটটি স্মৃতিকথা, আটটি অনুবাদগ্রন্থ, আটটি ছড়াগ্রন্থ, আটটি কাব্য তিনি লিখেছিলেন। অনুবাদগল্প ও রচনা আছে। যেমন সমারসেট মম এবং ডি. এইচ. লরেন্সের গল্প, জর্জ বার্নাড’ শ’র সরস ও বিরস নাটক, হুইটম্যানের কবিতার অনুবাদ। বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প এবং গোয়েন্দা গল্প রচনায়ও ছিলেন অনন্য। এছাড়া একাধিক চলচ্চিত্রের কাহিনী, নব্বইটির মত চিত্রনাট্য রচনা এবং ত্রিশটি সিনেমার জন্য গান লিখেছিলেন। তিনি ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার’ ও ‘অকাদেমি পুরস্কার এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সাম্মানিক ডিগ্রীতে ভূষিত হয়েছিলেন। কথাসাহিত্যে ও কাব্যের দ্বিমুখী ধারায় তার অবগাহন। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় চেকভের সঙ্গে তুলনা করে সকৌতুকে প্রশ্ন করেছিলেন : “সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র কবিতা ও ছোটগল্পের মধ্যে কোন্টিকে বলবেন জীবনসঙ্গিনী আর কাকেই বা চিহ্নিত করবেন নর্মসঙ্গিনী? কে তার বৈধী কে তার রাগানুগা? তার সাহিত্যিক সত্তা নিয়ে যদি কবি ও গল্পকারদের মধ্যে সম্ভ কবীরের শবদেহের মতো বিরোধ বাধে, তা হলে কবীরের ভক্তদলের মতো কোনো পক্ষই হতাশ হবেন না” (“বাংলা গল্প বিচিত্রা’)।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যবৈশিষ্ট্য:
অবশ্য ছোটগল্পের অভিনব অভিজ্ঞতা ও নিত্যনব উপস্থাপনা তাঁর কবিতায় অনুপস্থিত। তবু তিরিশের দশকে তার কবিতায় যে সুর শোনা গিয়েছিল তা বৈশিষ্ট্য-চিহ্নিত। একদিকে নিজস্ব আদর্শে জীবনের স্বপ্ন-সাধ পরিতৃপ্ত করার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে আদিম জৈবধর্মের বন্ধনের অনিবার্যতা সম্পর্কে সচেতনতা—এই দুয়ের দ্বন্দ্বময় বেদনাই তাঁর কবিতার অন্তঃসার। তাছাড়া কবিতায় বিষয় অনুসন্ধানে তিনি প্রধানতঃ সামাজিক, ঘাম-ঝরা খেটে খাওয়া মানুষের নিত্যসঙ্গী। অনেক সময় তিনি রাজনীতি সচেতন, মার্কসবাদে প্রতীষ্ঠ না হয়েও মানবতার অভিজ্ঞতায় সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আবার কখনও বা নাগরিক জীবনের গ্লানি ও ক্লান্তি কাটাতে প্রাকৃতিক নির্জনতার অভিলাষী অথবা ইতিহাস ও ভূগোলের ধূসর ও সুদূর পথে যাত্রা পিয়াসী।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যগ্রন্থসমূহ : ‘প্রথমা’ (১৯৩২), ‘সম্রাট’ (১৯৪০), ‘ফেরারী ফৌজ’ (১৯৪৮), সাগর থেকে ফেরা’ (১৯৫৬), ‘কখনো মেঘ’ (১৯৬০), ‘হরিণ চিতা চিল’ (১৯৬১), ‘অথবা কিন্নর’ (১৯৬৫), ‘নদীর নিকটে’ (১৯৭১), ‘নতুন কবিতা’ (১৯৮১)।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের উপন্যাস : ‘পাক’ (১৯২৬), ‘বাঁকা লেখা’ (১৯২৭), ‘মিছিল’ (১৯২৮), ‘বেনামী বন্দর’ (১৯৩০), ‘পুতুল ও প্রতিমা’ (১৯৩২), ‘কুয়াশা’ (১৯৩২), ‘উপনয়ন’ (১৯৩৩), ‘আগামীকাল’ (১৯৩৬), ‘প্রতিশোধ’ (১৯৪১), ‘মৃত্তিকা’ (১৯৩২), ‘নিশীথ নগরী’ (১৯৬০)।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পগ্রন্থ : ‘শুধু কেরানী’, ‘পোনাঘাট পেরিয়ে’, ‘সাগর সঙ্গম’, ‘পুন্নাম’, ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’, ‘মশা’, ‘হয়তো’, ‘স্টোভ’ প্রভৃতি।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিচিত্র রচনা : কল্পবিজ্ঞান ও এ্যাডভেঞ্চার ‘ঘনাদার’ গল্প (পরাশর বর্মা ছদ্মনামে লেখা)।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের পত্রিকা সম্পাদনা ও সংযোগ : ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘সংহতি’ (১৯২৩), ‘লাঙল’ (১৯২৫), ‘কালিকলম’ (১৯২৬), ‘প্রগতি’ (১৯২৭), ‘সংবাদ’ (১৯২৮), ‘খবর’ (১৯২৮), ‘রং মশাল’ (১৯৩৩), ‘নবশক্তি’ (১৯৩৬)।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের পুরস্কার ও সম্মানপ্রাপ্তি : ‘শরৎ স্মৃতি পুরস্কার’ (ক. বি. ১৯৫৪), ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যের জন্য ‘আকাদেমি’ ও ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ লাভ (১৯৫৮), ‘পদ্মশ্রী’ উপাধি লাভ (১৯৬০), কল্লোলের ‘নায়ক’ রূপে স্বীকৃতি লাভ (১৯৬২), “শিশু সাহিত্য পরিষদের পুরস্কার’ এবং ‘ভুবনেশ্বরী পদক’ লাভ (১৯৭০), আনন্দ পুরস্কার’ (১৯৭১), রাশিয়ায় গিয়ে ‘নেহেরু পুরস্কার’ (১৯৭৬) গ্রহণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘হরনাথ ঘোষ পদক’ (১৯৮০) প্রাপ্তি, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সাম্মানিক ডি. লিট.’ (১৯৮১) প্রাপ্তি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ (১৯৮৪) গ্রহণ, সর্বভারতীয় Authors Guild-এর সভাপতি পদ গ্রহণ (১৯৮৪), বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি (১৯৮৮) লাভ প্রভৃতি।
কবির বয়স যখন ২৪ বছর তখন প্রকাশিত হয় ‘প্রথমা’ কাব্যগ্রন্থ। সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা এই কাব্যের ‘লক্ষ্যভ্রষ্ট’, ‘আমি কবি’, ‘বেনামী বন্দর’ প্রভৃতি কবিতায় দেখা যায়।
কবিতাটি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হলে তিনি নতুন দিগন্তের যুগান্তকারী কবি বলে চিহ্নিত হন। ‘লক্ষ্যভ্রষ্ট’ কবিতায় দেখা যায় মাটির পৃথিবীতে কল্পিত দেবদেবীর পরিবর্তে মাটির মানুষকে ভালোবাসার কথা। ‘বেনামী বন্দরে’ আছে সমুদ্র-ভাঙা জাহাজ-বন্দরের চিত্রকল্পে নিপীড়িত নির্যাতীত জীবনযুদ্ধে পরাজিত হতভাগ্য মানুষের প্রতি সমবেদনা—
“মহাসাগরের নামহীন কূলে
হতভাগাদের বন্দরটিতে ভাই
সেই সব যত ভাঙা জাহাজের ভীড়”।
আবার ‘দেবতার জন্ম হল’ কবিতায় “জীর্ণ গৃহ আবর্জনা চারিদিকে তার মাঝে আলোহীন বায়ুহীন কক্ষে” কিভাবে “ছিন্ন শয্যা’ পরে শুয়ে” আছে “রোগ-রুক্ষ ক্ষুধা ক্ষীণ দেহ নিয়ে দেবতা আমার” –সেই অকৃত্রিম মরমী অভিজ্ঞতা সংবেদী পাঠক লাভ করে। বোঝে কিভাবে শত্রুরা “দেবতার আলো চুরি” করে অন্যের মুখের অন্ন কেড়ে “মানবের যাত্রাপথে সুবিপুল বাধা আবর্জনা” জমিয়ে পৃথিবীতে বিশ্বজোড়া হাহাকার সৃষ্টি করে। তাই মানুষরূপী দেবতা কবির চোখে ক্ষুধার ফাঁদে বন্দী হয়ে কোটি কোটি মা-র কোলে নিরন্ন শিশুর রূপ নিয়ে দেখা দেয়—
“আজ
বিকৃত ক্ষুধার ফাদে বন্দী মোর
ভগবান কাঁদে কাঁদে কোটি মা-র
কোলে অন্নহীন ভগবান মোর।”
আবার এই কাব্যের ‘দ্বার খোল’ কবিতায় আছে নিঃস্ব মানুষদের আনন্দদানের উপযোগী জীবনবিধান। ‘পাওদলে’ আছে মলিন কোর্তাপরা কারখানার কুলি, মূর্খ মজুর, মাঠের চাষা, জাহাজের খালাসী, পথের মুটের প্রতি সমবেদনা। তাদের পেশাকে সম্মানের বাসনা। এই কবিতায় বিশ্বের রাজনৈতিক ভূমিতে যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছে কবি যেন তার পদধ্বনি শুনে অন্যদেরও শোনাতে চেয়েছেন—
“পায়ের শব্দ শুনতে পাও?
নিযুত নগ্ন পায়ের মহাসঙ্গীত
……..
আজ পাওদল, চলে নবজাগ্রত ভয়মুক্ত মানবের দল,
তার সাথে পাওদল, চলেছেন মানবের দেবতা।”
‘সম্রাট’ ও ‘ফেরারী ফৌজ’ কাব্যগ্রন্থের কোন কোন কবিতায় দেখা যায় মানবসভ্যতার বিস্তৃত পটে আধুনিক জীবনসমস্যা অনুসন্ধানের প্রয়াস; যেমন—
“সাত সাগরের তীরে
ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো;
আনো সব সূর্য-কণা
রাত্রি-মোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তরে
-এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হলো ফেরারী ফৌজের।”
আবার ‘কাঠের সিঁড়ি’র প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমাজের ওপর তলার মানুষেরা ওঠার পথ নীচের জনের জন্য যে বেশি দিন বন্ধ রাখতে পারবে না তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
এই কাব্যের ‘নীলকণ্ঠ’ কবিতায় আছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অত্যাচার সত্ত্বেও পলিনেশিয়া ও আফ্রিকার আদিম উজ্জ্বলতার পাশে আধুনিক সভ্যতার অসুস্থ রূপের তুলনা—
“মোহিনী পলিনেশিয়া!
…আমি জানি,
সমুদ্রের ঔরসে
মহারণ্যের গর্ভে যার জন্ম,
আঁধার বরণ সেই আফ্রিকাকেও জানি;
উদ্দাম আঁধার-বরণ আফ্রিকা!
কণ্ঠে তার দুরস্ত আরণ্য-উল্লাস
–হে ইডি, হাইডি, হা-ই!….
আমাদের গলায় কই সেই উদ্দাম উল্লাস,
ঘাসের ঘাঘরায় দুরস্ত সমুদ্র-দোলা?
কেমন করে থাকবে?
আমাদের জীবনে নেই জ্বলস্ত মৃত্যু,
সমুদ্রনীল মৃত্যু পলিনেসিয়ার।
আফ্রিকার সিংহ-হিংস্র মৃত্যু।
আছে শুধু স্তিমিত হয়ে নিভে যাওয়া,
-ফ্যাকাশে রুগ্ন তাই সভ্যতা!”
এই আদিম অরণ্য ছায়া চিড়িয়াখানার খাঁচায় বদ্ধ বাঘের কপিশ চোখে, উদ্ভিদে কাঁটায়-কাঁটায় শিকড়ে-শিকড়ে দ্বন্দ্বে, শিশুতরুর বনস্পতির সাথে সংগ্রামে লক্ষ্য করে কবির মনে হয়েছে “বস্তুর প্রবাহচক্রে মৃত্যু শুধু দ্বার” (“বাঘের কপিশ চোখে’)।
‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যের ‘আবিষ্কার’ কবিতায় শোনা যায় কবি-নাবিকের এক মৃত মহাদেশে পরিভ্রমণের কথা—
“নিঃসঙ্গ নাবিক ফের
বাঁধি পোত শ্মশান-বন্দরে
তরীর কঙ্কাল যত, যেখানে বিছানো স্তরে স্তরে
–দুঃসাহসী দুরাশাবশেষ।”
এই পরিভ্রমণের উদ্দেশ্যে “মৃত সেই মহাদেশ” বিচরণ করে সে “একটি ‘পুদগল’ বীজ” বপন করতে চায়।
‘হরিণ চিতা চিল’ কাব্যগ্রন্থটির নাম-কবিতাটি প্রতীক-নির্ভর। ‘হরিণ’ হল স্বাধীন মানসিকতা। ‘চিতা’ হল আদিম বন্যতা, আর ‘চিল’ হল নিয়মতান্ত্রিকতা ও গতানুগতিকতার প্রতীক। কবির প্রশ্ন হল, এই কঠোর দুরস্ত জীবন থেকে কি পালানো সম্ভব? আর পালালে কি সত্যি শান্তি পাওয়া যায়? পরে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন মৃত্যুর ঝুঁকি না থাকলে জীবন হবে পঙ্গু। ‘হরিণ’ যে স্বাধীন মনের প্রতীক সেও যদি ঝুঁকি না নিয়ে পালাতে চায় তবে তার স্থান হবে জাদুঘরে। অবোধ চাউনি থাকবে বরফে জমানো।
ইতিহাস ও ভূগোলের জগতে কবির মানস-ভ্রমণের চিত্র বেশ কিছু কবিতায় দেখা গেছে।
আঙ্গিক-সজ্জা : প্রেমেন্দ্র মিত্র আঙ্গিক সচেতন কবি। তাঁর কবিতায় ছন্দ-নির্মাণে পর্বাঙ্গে ও পর্ববিন্যাসে বৈচিত্র্য দেখা যায়; যেমন ই-ধ্বনি ও হসন্ত ধ্বনি ছন্দস্পন্দে প্রয়োজনীয় তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতা সঞ্চার করেছে এই অংশে—
“হে-ইডি, হাইডি, হা-ই
অরণ্য ডাকে ওই—যাই।
সিংহের দাঁতে ধার, সিংহের নখে ধার,
চোখে তার মৃত্যুর রোশনাই
হে-ইডি, হাইডি, হা-ই”
আবার “মানুষের মানে চাই গোটা মানুষের মানে” ইত্যাদি কবিতায় ছন্দে উদ্দামতা উদ্দীপনা বিরল, যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের সুরই প্রবল। তাঁর কবিতার চিত্রকল্পও ব্যঞ্জনাময়; যেমন পুরাণভাবনায় সজ্জিত—
“মেঘের ঢাকা দিলেই নাগরালি
তুফানে মাতে, ঘোচায় তপোচর্যা।
ঊর্বশীই মুকুরে উমা নয় কি?”
এখানে ‘উর্বশী’ উচ্ছৃঙ্খল কামনার এবং ‘উমা’ পবিত্র ভালোবাসার প্রতীক। উর্বশীর ছায়া যখন মুকুরে পড়ে তখনই সে উমায় রূপান্তরিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে এরা পরস্পর বিরোধী। কিন্তু ‘মুকুর’ এদের দুজনকে এক করে মিলন ঘটায়। কবিসত্তা হল সেই মুকুর, যার প্রভাবে স্থূল অভিজ্ঞতা বিশোধিত হয়ে নান্দনিক তাৎপর্য পায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতায় শব্দসচেতনতা দেখা যায়। তিনি নিজে পাঠকের উদ্দেশে বলেছেন—
“সমস্ত শব্দের মাঝে
যে বিদ্যুৎ-চঞ্চল শূন্যতা
তাই যদি খুঁজে পাও
উদ্ভাসিত চেতনায় নিরর্থক সব মুখরতা।”
তার কোন কোন কবিতায় দেখা গেছে শব্দের ধ্বনি-রূপের প্রকাশ; যেমন ‘রঙ্গ’, ‘নীলকণ্ঠ’, ‘আমি কবি’, ‘নীল’ ইত্যাদি কবিতা। কোন কবিতায় দেখা গেছে চিত্ররূপের প্রাধান্য; যেমন—’ফেরারী ফৌজ’, ‘হরিণ চিতা চিল’ ইত্যাদি।
আধুনিক বাংলা কাব্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র নতুন পথের দিশারী না হলেও সর্বজনমান্য কবি-রূপে খ্যাত।
Leave a comment