সূচনা: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যতম প্রত্যক্ষ ফল ছিল ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে বেশি পরিচিত। সরকারি শােষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শস্যহানি, বাইরে থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানিতে বাধা, খাদ্যের মজুতদারি, মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ঘটনা পঞ্চাশের মন্বন্তরকে ভয়াবহ করে তালে।
[1] ব্যাপক প্রাণহানি: পঞ্চাশের মন্বন্তরে অনাহার ও বিভিন্ন রােগের প্রকোপে বাংলায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সঠিক কোনাে পরিসংখ্যান ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকাশ না করলেও দুর্ভিক্ষে অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ বা আরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মৃতদেহগুলি রাস্তাঘাটে, বনেবাদাড়ে স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা যেত। মৃতদেহ সৎকারের মানুষ ছিল না। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মৃতদেহের দখল নিয়ে শিয়াল আর কুকুরের মধ্যে লড়াই চলত। দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে মৃতদেহের মাংসের প্রতি শিয়াল, কুকুর, শকুনেরও অরুচি ধরে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলায় যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও তত মানুষের মৃত্যু হয়নি। এই মন্বন্তরের ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি ছিল।
[2] অর্থনৈতিক বিপর্যয়: মন্বন্তরের সময় বাংলায় চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। দরিদ্র মানুষের দীর্ঘদিন ধরে জমানাে অর্থসম্পদ দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য কিনতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এরপর নিঃস্ব, রিক্ত, অভুক্ত মানুষগুলি থালা-বাটি হাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তিতে বেড়িয়ে পড়ে। “মা, একটু ফ্যান দাও” বলে কাতরাতে কাতরাতে কলকাতার বুভুক্ষু মানুষের দল দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং পরে অভুক্ত, শীর্ণ, কঙ্কালসার এই মানুষগুলি রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকছে—এই দৃশ্য কলকাতা-সহ বাংলার সর্বত্র দেখা যেত।
[3] মানবিক বিপর্যয়: ভয়াবহ পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলায় চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। খিদের জ্বালায় মানুষ অখাদ্য পশু ও কীটপতঙ্গ, লতাপাতা, এমনকি দুর্বাঘাস প্রভৃতি অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে শুরু করেছিল। কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে অভুক্ত মানুষ শহরের ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। মানুষ তার প্রিয়জনকে মৃত্যুমুখে ফেলে রেখে নিজে বাঁচার তাগিদে অন্যত্র চলে যায়। অভাবের তাড়নায় অনেকে স্ত্রী সন্তানদের বিক্রি করে দেয়। কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে অভুক্ত মানুষ শহরের ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। মানুষ তার প্রিয়জনকে মৃত্যুমুখে ফেলে রেখে নিজে বাঁচার তাগিদে অন্যত্র চলে যায়। অভাবের তাড়নায় অনেকে স্ত্রী সন্তানদের বিক্রি করে দেয়।
[4] খাদ্য সরবরাহ: দেরিতে হলেও সরকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মধ্যে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। শহরে কয়েকটি ন্যায্য মূল্যের দোকান খুলে মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার সামান্য প্রয়াস দেখা যায়। বাইরে থেকে বাংলায় ২৬৪ হাজার টন চাল, ২৫৮ হাজার টন গম এবং ৫৫ হাজার টন মিলেট বাংলায় আমদানি করা হয়। অবশ্য খাদ্য আমদানির আগেই বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে গেছে।
[5] কমিশন গঠন: দুর্ভিক্ষের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সরকার দুর্ভিক্ষের পর ‘দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন দীর্ঘ তদন্ত করে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ সরকারকে তার রিপাের্ট জমা দেয়। এই কমিশনের রিপাের্ট মন্বন্তরের সময় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক, পৌর ও সামরিক নীতির ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল যে, অন্য কোনাে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশের সরকার নিজের বিরুদ্ধে এরূপ সমালােচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেনি।
[6] শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি: পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। চিত্তপ্রসাদ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত বাংলা’ ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ’-এ, বিজন ভট্টাচার্য তাঁর ‘নবান্ন’ নাটকে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ কাহিনি তুলে ধরেন। উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ দেন বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এ ছাড়া ভবানী ভট্টাচার্যের ‘So Many Hungers’, অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘আকালের সন্ধানে’ (যা পরে চলচ্চিত্রে রূপ দেন মৃণাল সেন), কে. এ. আবৃাস পরিচালিত ‘ধরতি কে লাল’ ও বিমল রায় পরিচালিত ‘Bengal Famine’ চলচ্চিত্র, জয়নুল আবেদিনের আঁকা বিভিন্ন চিত্র প্রভৃতিতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ কাহিনি ধরা পড়েছে।
[7] গ্রন্থ নিষিদ্ধকরণ: চিত্তপ্রসাদ তাঁর ‘ক্ষুধার্ত বাংলা’ ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের সময় তার মেদিনীপুর সফরের একটি অসামান্য বিবরণ তুলে ধরেন। তাঁর বর্ণিত জীবন্ত করুণ চিত্রে সরকারের মুখােশ খুলে যায়। এতে সরকার যথেষ্ট বিব্রত হয় এবং সরকারকে বিভিন্ন সমালােচনার মুখে পড়তে হয়। সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে এর ৫০০০ কপি বাজেয়াপ্ত করে। এই বইয়ের একটি কপি লুকোনাে অবস্থায় চিত্তপ্রসাদের পারিবারিক সংগ্রহে থেকে গিয়েছিল, যেটি বর্তমানে দিল্লির আর্ট গ্যালারিতে রাখা আছে।
উপসংহার: পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর সম্পর্কে চর্চা ও গবেষণা আজও চলছে। মেদিনীপুর সফরের সময় চিত্তপ্রসাদ ও তার সঙ্গীরা ধানখেত থেকে বছর ছয়েকের এক শিশুকে উদ্ধার করেন—চিত্তপ্রসাদের ভাষায়: ‘হাড়ের তৈরি কালাে পুতুল!’ এ চিত্র শুধু মেদিনীপুরের নয়, এ ছিল দুর্ভিক্ষের সময় সারা বাংলার চিত্রের প্রতীক।
Leave a comment