প্রশ্নঃ বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা আলােচনা কর।

অথবা, তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামাজিক গবেষণার সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার উন্মেষ ও বিকাশ সাম্প্রতিক কালের সমাজের অগ্রগতির জন্য মানুষের আচরণ, সামাজিক পরিবেশ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতাজাত অনুসন্ধানের গুরুত্ব অপরিসীম। তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের বিরাজমান সমস্যার প্রতিকার, আসন্ন সমস্যার প্রতিরােধ এবং সার্বিক ভারসাম্যময় উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্নমূখী সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণার সমস্যাঃ সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিদ্যমান সমস্যাবলি বা সীমাবদ্ধতা নিম্নরূপ-

(১) পদ্ধতিগত সমস্যা/সীমাবদ্ধতাঃ সামাজিক গবেষণায় বহুসংখ্যক পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা প্রতিটি সমাজে বিদ্যমান, যেগুলাে বাংলাদেশেও প্রকট আকারে রয়েছে। এসব পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা যতটা সম্ভব কাটিয়ে ওঠে সঠিক গ্রহণযােগ্য পদ্ধতি প্রয়ােগ করে সামাজিক গবেষণা পরিচালনা করার মতাে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষকের অভাব এদেশে রয়েছে। ফলে গুণগত মানসম্মত ও সামাজিক বাস্তবতা উদঘাটনের মতাে খুব কম সংখ্যক গবেষণা এদেশে সম্পাদিত হয়েছে।

(২) সংগঠনের অভাবঃ গবেষণাকার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত সংগঠনের প্রয়ােজন। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা ব্যতিত সুষ্ঠু, সুশৃংখল ও কার্যকর গবেষণা পরিচালনা কঠিন। বাংলাদেশে সামাজিক গবেষণাকার্য পরিচালনার জন্য যে, কটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলাে দায়সারা প্রকৃতির। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেসব গবেষণা পরিচালিত হয় সেগুলােও সমাজের প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল।

(৩) ব্যবসায়িক মানসিকতাঃ সামাজিক গবেষকদের ব্যবসায়িক মানসিকতা এদেশে কার্যকর গবেষণার অন্যতম একটি অন্তরায়। অনেক গবেষকের মধ্যে তথ্য বিক্রির মানসিকতা বিদ্যমান। এর ফলে তারা এমন বিষয়ে গবেষণা করেন বা এমন তথ্য সংগ্রহ করেন যেগুলাে বাজারে চড়া মূল্যে বিক্রি হয়। এ অবস্থায় সামাজিক চাহিদা উপেক্ষিত হয়।

(8) তথ্যদাতাদের অসহযােগিতাঃ তথ্যদাতাদের তথ্য প্রদানে অনীহা ও অসহযােগিতা সামাজিক গবেষণাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তারা মনে করেন যে, এসব তথ্য প্রদান করে তাদের কোনাে লাভ নেই। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করতে হলে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সম্মতি প্রয়ােজন এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়ােজনীয় সম্মতি ও সহযােগিতা পাওয়া যায় না।

(৫) দাতাদের নিয়ন্ত্রণঃ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ পরিচালিত সামাজিক গবেষণার সিংহভাগ দাতাদেশ বা সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত গবেষণা। এসব গবেষণায় সামাজিক প্রয়ােজন ও গবেষকের আগ্রহের প্রতি খেয়াল রাখা হয় না বরং দাতাদের। লক্ষ্য অর্জনই মূল্য বিষয়। ফলে এসব গবেষণায় গুণগত মান ও সামাজিক প্রয়ােজনীয়তা মােটেই অর্জিত হয় না।

(৬) লাগসই পদ্ধতির অভাবঃ এদেশের সামাজিক গবেষণার কার্যকরি ও উপযুক্ত পদ্ধতি উদ্ভাবনে গবেষকদের অক্ষমতা একটি অন্যতম সীমাবদ্ধতা। উন্নত দেশের সমাজ অধ্যয়ন করার জন্য উদ্বুদ্ধ ও ব্যবহৃত কলাকৌশল দিয়ে আমাদের মতাে পশ্চাৎপদ সমাজ অধ্যয়ন করা হয় যা সব সময় বাস্তব অবস্থাকে তুলে ধরতে পারে না। যেমন, বিগত নির্বাচনে কোন দলকে ভােট দিয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমেরিকার জনগণ খােলামেলাভাবে সঠিক উত্তর দেবে কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ভীষণ গােপনীয়তা রক্ষা করবে।

(৭) মূল্যবােধের সমস্যাঃ বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক গবেষণার জন্য প্রয়ােজন গবেষকের মূল্যবােধ নিরপেক্ষ হওয়া। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক গবেষকদের অধিকাংশই দল, মত, আদর্শ ইত্যাদি লাইনে বহু ধারায় বিভক্ত। তারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণার ফলাফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। ফলে তাদের দ্বারা বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা সম্ভবপর হয় না।

(৮) আর্থিক সীমাবদ্ধতাঃ আর্থিক সীমাবদ্ধতা এদেশের সামাজিক গবেষণার একটি অন্যতম সমস্যা। এ ধরনের গবেষণা পরিচালনার জন্য বই-পুস্তক, যন্ত্রপাতি, সাজ-সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ, কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয়বাবদ প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন হয়। এরূপ বিপুল অর্থের চাহিদা সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তিগতভাবে পূরণ করা কঠিন। এর ফলে এদেশে গবেষণার গুণগত মানই কেবল নিম্ন নয় বরং সংখ্যাও অপর্যাপ্ত।

(৯) র‍্যাপোর্টর সমস্যাঃ প্রয়ােজনীয় র‍্যাপাের্টের অভাবে সামাজিক গবেষণায় প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের গবেষকদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং সময়ের স্বল্পতার কারণে বাস্তবে গবেষণা এলাকায় অবস্থান করে, তথ্যদাতাদের সাথে র্যাপাের্ট করা সম্ভবপর হয় না বরং শহর বা ক্যাম্প থেকে গিয়ে প্রথমেই একজনকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। এ অবস্থায় সঠিক তথ্য প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম।

(১০) সরকারি পষ্ঠপােষকতার অভাবঃ সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা ও প্রয়ােজনীয় প্রেষণা প্রদানের অভাবে এদেশে পর্যাপ্ত সামাজিক গবেষণা হচ্ছে না। সীমিত কিছু ক্ষেত্রে সরকার গবেষণা পরিচালনা করলেও তা প্রয়ােজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় এবং এসব গবেষণাকে তেমনভাবে উৎসাহ দেয়াও হয় না। উপরন্তু গবেষকের সামাজিক স্বীকৃতির অভাবেও পর্যাপ্ত গবেষণাকার্য পরিচালিত হয় না।

(১১) যােগাযােগ ও পরিবহন সমস্যাঃ আধুনিক ও উন্নত যােগাযােগ ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাব সামাজিক গবেণার ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায়। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রাম ও দুর্গম এলাকায় গবেষণা পরিচালনা করা কঠিন কাজ।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণা হলাে সামাজিক ঘটনাবলি সম্পকে বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া। এই গবেষণা আমাদের দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সুযােগ-সুবিধা, পৃষ্ঠপােষকতার অভাব এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের অভাবসহ উপযুক্ত সমস্যাবলির কারণে সামাজিক গবেষণা যতটা গতিবেগ পাওয়ার কথা ততটা পায়নি।