অথবা, বাংলাদেশে বসবাসকারি প্রধান প্রধান উপজাতিসমূহের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে তুলে ধর।
ভূমিকাঃ উপজাতি বলতে এমন একটি জনগােষ্ঠিকে বােঝায়, যারা মােটামুটিভাবে একটা অঞ্চলে সংগঠিত এবং যাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং যার সদস্যরা মনে করে যে, তারা একই সাংস্কতিক এককের অন্তর্ভুক্ত। তাদের এই বিশেষ সংস্কৃতির জন্য তাদের অন্য জনগােষ্ঠি থেকে পৃথক করে রাখে। এরা রাজনৈতিকভাবে তেমন সুসংগাঠত নয়। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপজাতির বসবাস রয়েছে। এরা সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা বজায় রেখে চলেছে। চাকমা, গারাে, খাসিয়া, ওরাও, রাখাইন, মারমা বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উপজাতি।
বাংলাদেশের উপজাতিঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫ হাজার নৃ-তাত্ত্বিক গােষ্ঠিতে বিভক্ত ৩০ কোটি উপজাতি বা আদিবাসী রয়েছে। তার মধ্যে ২০ লাখের অধিক আদিবাসী বাংলাদেশে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ২০টির মতাে উপজাতির বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতি বাস করছে। যেমন: চাকমা, মুরং ও মগা পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর বনাঞ্চলে বাস করে। গারাে, হাজং, সাঁওতাল, পালীয় ও দুলাই উপজাতির লােকেরা জৈয়ন্তিকা পাহাড়ে এবং মণিপুরীরা সিলেটে বাস করে। এ ছাড়া বাংলাদেশে টিপরা, ম্রো, তাং চইঙ্গা, কুকি, খুসি, লুসাই, খাইয়ান, বিয়াং, রণজঙ্গি, পাংকু, রাখাইন, খাসিয়া সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে।
প্রধান প্রধান উপজাতিসমূহের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয়ঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারি কোনাে জনগােষ্ঠিই এখানকার মূল আদিবাসী বা ভূমিপুত্রের (So not the Soil) দাবিদার হতে পারে না। বাঙ্গালিরা যেমন: সমতল থেকে আগমন করেছে, তেমনি উপজাতিরাও ত্রিপুরা, আরাকান প্রভৃতি স্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আগত উপজাতির সংখ্যা প্রায় ২০টির মতাে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের বাস। তবে বেশির ভাগ পার্বত্য পাহাড়ি এলাকায় । নিম্নে এদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আলােচনা করা হলাে:
(১) আবাসস্থলঃ বাংলাদেশের বেশির ভাগ উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। তবে অন্যান্য অঞ্চলেও এদের বাস দেখতে পাওয়া যায়। যেমনঃ গারাে, হাজং, সাঁওতাল, হােদি, পালীয়রা বাস করে ময়মনসিংহের গারাে পাহাড়ে; মণিপুরীদের বাস মণিপুর রাজ্যে; অন্যদিকে খাসিয়ারা সিলেটে বাস করে। এদের ঘরবাড়িগুলাে বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন: খাসিয়ারা মাচা পেতে ঘর তৈরি করে বসবাস করে। ঘরবাড়িগুলাে বাঁশ, খড়, কাঠ দিয়ে তৈরি।
(২) নামকরণঃ বাংলাদেশের উপজাতিগুলাের নামকরণ করা হয়েছে তাদের অবস্থান ও উৎপত্তির ভিত্তিতে। যেমনঃ মণিপুর রাজ্যে বসবাস করে ফলে তাদের মণিপুরী; গারাে পাহাড়ে বসবাসকারিদের গারাে; চম্পােক নগরীতে বসবাসকারিকে চাকমা নামে অভিহিত করা হয়।
(৩) অর্থনীতি/জীবিকা নির্বাহঃ উপজাতিদের প্রধান জীবিকা হলাে কষিকাজ। তারা জুমচাষ করে। তবে বর্তমানে হালচাষ পদ্ধতি প্রচলিত হচ্ছে। প্রায় সব উপজাতি বিশেষ করে চাকমা, গারাে, সাওতাল, মানপুরা, ত্রিপুরা, কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ ছাড়া চাকমারা মুরগী ও শুকর পালন করে এবং চাকরি করছে; খাসয়ারা পাতার জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ করে বিক্রি করে।
(৪) খাদ্যঃ উপজাতিদের প্রধান খাদ্য ভাত। তবে এরা মদকে অনেক প্রাধান্য দেয়। এরা শূকর, শেয়াল, গরু, ছাগল, সাপ, ইঁদুর, জোঁক, কচ্ছপ, ব্যাঙের মাংস খায়।
(৫) সমাজের গঠনঃ উপজাতীয়দের সমাজের গঠন ভিন্ন ভিন্ন। যেমনঃ চাকমাদের সামাজিক গড়ন এরকম ক্ষুদ্র থেকে > পরিবার > গােত্তি বা গােজা > আদাম > গ্রাম বা মৌজা > চাকমা সার্কেল। গারাে সমাজ মূলত মাতৃসূত্ৰীয়। তাদের বৃহৎ মাতৃসূত্রীয় দল বা গােত্রের নাম চাচী। প্রতিটি চাচী ছােট ছােট গােত্রে বিভক্ত। সাঁওতালরা যে গ্রামে বাস করে তা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। গ্রামপ্রধানকে বলা হয় ‘মাজি’ খাসিয়াদের মধ্যে ছয়টি গােত্র যথাঃ সিনতেং, লিনগ্যাম, ডুই, পনার, লাংদুহ ও বার।
(৬) পরিবার ব্যবস্থাঃ উপজাতিদের বেশিরভাগ পরিবার মাতৃপ্রধান। তবে পিতৃপ্রধান পরিবারও লক্ষ করা যায়। যেমনঃ চাকমা পিতৃপ্রধান; গারাে মাতৃপ্রধান; খাসিয়ারা মাতৃপ্রধান; রাখাইন মাতৃপ্রধান।
(৭) বিবাহরীতিঃ উপজাতিগুলাে বিভিন্ন ধরনের বিবাহ রীতি মেনে চলে। যেমন- চাকমারা cross-cousin এবং অন্তর্বিবাহ ও বহির্বিবাহ রীতি অনুসরণ করে; গারােদের ভেতরে মনােগামী বা যুগল বিবাহ রীতি এবং বহু স্ত্রী বিবাহ দেখা যায়। সাঁওতালদের মধ্যে আমলি, রাজারাজি, হুর কাটারা বিবাহ প্রচলিত; মণিপুরীদের মধ্যে অন্তর্বিবাহ প্রচলিত।
(৮) বিবাহবিচ্ছেদঃ বেশ কিছু উপজাতির মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাবিবাহ পরিলক্ষিত হয়। যেমনঃ চাকমা ও সাঁওতাল সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভবপর। আবার মণিপুরী সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাবিবাহ উভয়ই প্রচলিত।
(৯) পােশাক-পরিচ্ছদঃ উপজাতিরা সভ্য মানুষের মতাে পােশাক পরে না। যেমনঃ গারাে পুরুষ ধুতি এবং মেয়েরা ব্লাউজের মত বুকে কাপড় লুঙ্গির মতাে টুকরাে কাপড় পরে। মণিপুরী মেয়েরা অবশ্য বুকে ওড়না পড়ে এবং এখন আধুনিক পােশাকের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। খাসিয়া পুরুষ লুঙ্গির সাথে গায়ে এক প্রকার কাপড় পরে। রাখাইনরা (পুরুষ) লুঙ্গি ও ফতুয়া পরে, মেয়েরা লুঙ্গির সাথে ব্লাউজ পরে।
(১০) ধর্মঃ উপজাতির অধিকাংশই বৌদ্ধ ও খ্রিস্টধর্মালম্বি। চাকমারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বি সাথে সাথে তাদের কিছু অংশ গাঙ, লক্ষ্মীপূজা এবং ঈশ্বরকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে; গারােদের ৯০% খ্রিস্টধর্মাবলম্বি। এদের ধর্মের নাম সংসাবেক; সাওতালদের দেবতার নাম মারঙ বরু; মণিপুরীদের নিজস্ব কোনাে ধর্ম নেই। তারা মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, বিষ্ণুর মুর্তি স্থাপন করে পুজা করে। খাসিয়ারা অতিপ্রাকৃত শক্তির ওপর বিশ্বাস করে এবং পুনর্জন্মবাদেও বিশ্বাস করে।
(১১) ভাষাঃ প্রত্যেকটা উপজাতিরই প্রায় নিজস্ব ভাষা রয়েছে। যেমনঃ চাকমারা বিবেধ বার্মান ভাষার পরিবারভুক্ত আরকানী ভাষায় কথা বলে, তবে লেখার কাজে বাংলা ভাষাকে বেছে নিয়েছে। গারােরা মান্দি বা গারাে ভাষায় কথা বলে এবং বাংলা অক্ষরে গারাে ভাষা লিখছে। রাখাইনরা মঙ্গোলীয় স্রোতধারার ভােট-ব্রহ্মা ভাষায় কথা বলে।
(১২) শিক্ষাঃ বর্তমানে উপজাতি শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পাচ্ছে। যেমনঃ চাকমারা উচ্চাশক্ষা গ্রহণের সুযােগ পাচ্ছে এবং নারী ও পুরুষ চাকরি করছে। গারােদের ২৯% শিক্ষিত। রাখাইনরা ‘কিয়ং’-এ শিষ্টাচারমূলক শিক্ষা নিয়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশােনা করে। তবে এ বাংলা মাধ্যম ততটা উন্নত নয়।
(১৩) নৃত্যঃ প্রত্যেক উপজাতিই তাদের উৎসবগুলােতে নৃত্য করে। তবে খাসিয়াদের নৃত্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তাদের নৃত্যের নাম ‘নােংগক্রেম’।
(১৪) নেতৃত্বের ধরনঃ চাকমা সমাজের নেতৃত্বে আছেন চাকমা রাজা; গারাে সমাজে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যেমনঃ ইউনিয়ন, থানা গড়ে ওঠেছে।
(১৫) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াঃ উপজাতিরা মৃত্যুর পরও কিছু ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে। যেমনঃ চাকমারা মৃতদেহ পােড়ায়; গারাে সমাজে মৃতদেহ পােড়ানাে হলেও এখন খ্রিস্টধর্ম মতে কবরস্থ করা হচ্ছে। সাঁওতাল মনিপুরীদের মৃতদেহ পােড়ানাে হয়। রাখাইনরা মৃতদেহ চিতায় তুলে পােড়ায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রত্যেকটা উপজাতির সাংস্কৃতিক দিকগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা প্রায় সকল ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভাষা, শিক্ষা, পােশাক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক সভ্য সমাজের ছোঁয়া গ্রহণ করছে। এটা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে ধারণা করা হয়।
Leave a comment