অথবা, বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক ধারা বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণাল সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।
বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতিঃ স্বাভাবিকভাবে সংস্কৃতি বলতে যেকোনাে সমাজের way of life কে বুঝিয়ে থাকে। কোনাে দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই ঐ দেশের মানুষের জীবনপদ্ধতি সম্পকে জানা প্রয়ােজন। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ওতপ্রােতভাবে মানুষের সংস্কৃতি জানতে হলে প্রথমেই জানা দরকার এদেশের মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতিটা কী রকম। কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পারি। যেমন বাঙালিদের ঘরবাড়ির ধরন, পােশাক-পরিচ্ছদের বিবরণ, খাদ্যাভ্যাস এবং অর্থব্যবস্থা থেকে শুরু করে তাদের ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি, বিশ্বাস ও উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সবকিছু। বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি সম্পর্কিত আলােচনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলাে-
বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশঃ অতীতকাল থেকেই আমাদের এই দেশটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের অধিকাংশ অঞ্চল গ্রাম। তাই বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে অনেকটা গ্রামীণ সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এ দেশের অর্থনীতিও গ্রামীণ অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কোনাে না কোনােভাবে দেশের কৃষিব্যবস্থার সাথে জড়িত। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলাদেশের একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে চিন্তা করা যায় না। এ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে কৃষিব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। মূলত দেশের অর্থনীতিও সে দেশের জীবনধারণ পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে থাকে। তাই আমাদের সংস্কৃতি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে।
ধর্মীয় সম্প্রদায় ও আচার-অনুষ্ঠানঃ বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে থাকে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ও উপজাতি। বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা রয়েছে তার মধ্যে ৮০% লােক ইসলাম ধর্মাবলম্বি। বাকি ১৫% হিন্দু ও ৫% বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা তাদের রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। যেমন মুসলমানরা মসজিদ, হিন্দুরা মন্দিরে, বৌদ্ধরা প্যাগােড়ায় এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায় চার্চে তাদের প্রার্থনা সম্পাদন করে থাকে।
দারিদ্র্যঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। অধিক জনসংখ্যা, সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অভাবের কারণে এদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। যতদিন পর্যন্ত সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। ততদিন এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জনসাধারণের অধিকাংশই ন্যূনতম খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশের মানুষের আহারঃ বাংলাদেশ মূলত নদী, খাল, বিল ও হাওড়সমৃদ্ধ। তাই অতীতকাল থেকেই এখানে অধিক হারে মাছ পাওয়া যেত। এবং অন্যদিকে রয়েছে কৃষিভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। যার ফলে এক সময় বাংলাদেশের মানুষকে ভাতে মাছে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতাে। ভাত, মাছ, শাক, ডাল প্রভৃতি এ দেশের মানুষের প্রধান খাবার। কোনাে কোনাে আচার-অনুষ্ঠানে হরেকরকম পিঠাও বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য।
বসতভিটাঃ ঘরবাড়ির ধরন গ্রামীণ ঘরবাড়ি বাঁশ, বেত, ছন বা খড়ের তৈরি। অধিকাংশ জনগণই চন বা খড়ের ছাউনি ঘরে বসবাস করে। অবশ্য বর্তমান আধুনিক সমাজে গ্রামেও অনেক দালান ঘর তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া মাটির ঘর আলাদা ঐতিহ্য বহন করে।
ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষাঃ বাংলাদেশের মানুষের ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে একটিই, যা বাংলা ভাষা। তা ছাড়া সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত সব বাংলা ভাষাকে ঘিরেই-তবে সকল মানুষ বাংলা ভাষাভাষী হলেও অঞ্চলভেদে ভাষার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষারও তারা ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে।
সঙ্গীত ও নৃত্যকলাঃ পল্লীগীতি, লালনগীতি, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত এ দেশের সংস্কৃতির অন্যতম দিক। এ ছাড়াও লােকগীতি, পুঁথি, লােকনৃত্য, জারি, সারি গানের দেশ বাংলাদেশ। তা ছাড়া যাত্রা অভিনয় এবং বিভিন্ন নৃ-গােষ্ঠীর সনাতন প্রাধান্য দেয়া হয়। এ ছাড়া বংশ মর্যাদার ভিত্তিতেও গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামাে আবর্তিত হয়।
সামাজিক শ্রেণি ও মর্যাদাঃ শ্রেণি কাঠামাের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে যারা উৎপাদনের উপকরণের মালিক তারা উচ্চ শ্রেণিতে অবস্থান করে। উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার ভিত্তিতে ব্যক্তির মর্যাদা ক্রমােচ্চভাবে সজ্জিত হয়। অবশ্য ধর্মীয় ও বংশ মর্যাদাকে অনেক সমাজে প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে ব্যক্তির সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে।
পরিশেষঃ বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ আমাদের এই দেশ, বিশেষ করে সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য। অতীতকাল থেকেই এদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র ধারায় পরিচালিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির সাথে এর তেমন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। একেবারেই ভিন্নধারার সংস্কৃতি যা এখানকার রাজনৈতিক, ভৌগােলিক, সামাজিক জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠছে। যদিও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে শহুরে এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবুও উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলােই মূলত বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। তাই পরিশেষে যদি বলা হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতি ‘বৈচিত্র্যময়’ তাহলে অত্যুক্তি হবে না।
Leave a comment