সর্বাত্মক বা সামগ্রিকতাবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা:

সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে অল্পবিস্তর বিভ্রান্তির অবকাশ আছে। সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে ফ্যাসিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে সর্বাত্মক বা সামগ্রিকতাবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “.totalitarianism, presents far more problems of operationalisation than does that of liberal democracy.” তিনি আরও বলেছেন: “The most famous and most utilised definition of totalitarianism was produced by Friedrich and Brzezinski.” ফ্রেডারিশ ও ব্রেজিনস্কি তাঁদের Totalitarian Dictatorship and Autocracy শীর্ষক গ্রন্থে সর্বাত্মক ব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল: 

  • (ক) একটি সরকারী মতাদর্শ বর্তমান থাকে (“There is an official ideology.”); 

  • (খ) একজন নেতার নেতৃত্বাধীন দলের অস্তিত্ব (“There is a single mass party usually led by one man.”), 

  • (গ) আনুগত্য আদায়ের জন্য সরকার সন্ত্রাস চালায় (“Terror is used by government to enforce obedience”); 

  • (ঘ) সংযোগ সাধনের মাধ্যমগুলির উপর সরকারের একচেটিয়া অধিকার বর্তমান থাকে (“The government has monopoly of communication.”); 

  • (ঙ) সরকার অস্ত্রশস্ত্রের উপর একচেটিয়া অধিকার কায়েম করে (“The government has monopoly over weapons”); 

  • (চ) আর্থনীতিক ব্যবস্থার উপর কেন্দ্রীয় নির্দেশ কার্যকর হয় (“There is central direction of the economy”)। 

এই দুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত অনুসারে সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হল ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা। এই কারণে সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার আলোচনা একসঙ্গে করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে অ্যালান বলের অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “The difficulties with this conceptualisation of totalitarianism abound and the critics of this approach are many. Certainly, the above definition would seem to fit the political regimes of Hitler’s Germany and Stalin’s Soviet Union more easily than any contemporary political system, especially in terms of one-man rule and the use of terror” তবে বল এও বলেছেন: “There are now no longer any examples of fascist totalitarian systems of the type presented by Hitler’s Germany.”

অ্যালান বল, ফাইনার প্রমুখ চিন্তাবিদ্‌গণ ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করার পক্ষপাতী। সর্বাত্মক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও দেখা যায়। ফ্যাসিবাদী নেতা মুসোলিনী (Benito Mussolini) বলেছেন: “All within the state; none outside the state; none against the state.” ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার আদর্শ হিসাবে সর্বাত্মক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়।

ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য:

ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। বল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন।

  • (১) এই ব্যবস্থায় তত্ত্বগত বিচারে ব্যক্তি ও সমাজের সকল কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত। 

  • (২) এই ব্যবস্থায় রাজনীতিক ও আইনগত দিক থেকে একটি মাত্র রাজনীতিক দলের সর্বব্যাপী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই একমাত্র রাজনীতিক দলটির মাধ্যমেই যাবতীয় রাজনীতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। আবার প্রতিযোগিতা, নিয়োগ ও বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই দলটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। 

  • (৩) এই ব্যবস্থায় তত্ত্বগতভাবে সকল রাজনীতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে একটি ব্যাপক রাজনীতিক আদর্শ।

  • (৪) সরকার কর্তৃক বিচার-বিভাগ ও গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ব্যবস্থায় নাগরিক অধিকারগুলিকে চূড়ান্ত ভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়। 

  • (৫) এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠী জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে জনসাধারণকে সুসংগঠিত করতে এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার একটা গণতান্ত্রিক ভিত্তি সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে।

ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য:

উপরি-উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির কথা বাদ দিলেও ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার আরও কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বর্তমান।

(ক) এই ব্যবস্থায় সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি সব দিক থেকেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় মুষ্টিমেয় বাছাই করা ব্যক্তির (elite) হাতে। এই সমস্ত ব্যক্তির উপর থাকেন দলের সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী একমাত্র অবিসংবাদিত নেতা। এখানে দল ও দেশের সর্বোচ্চ নেতা অভিন্ন। এই রাজনীতিক ব্যবস্থার মূলকথা হল ‘এক দল, এক নেতা, এক রাষ্ট্র। জার্মানীতে নাৎসী দল বলতে হিটলার এবং ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দল বলতে মুসোলিনীকেই বোঝাত।

(খ) এই ব্যবস্থায় একাধিক রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসের দল ছাড়া অন্যান্য সকল দলের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করা হয়। 

(গ) ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থায় বলপূর্বক সভা-সমিতির অধিকার, ধর্মঘটের অধিকারকে দমন করা মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। 

(ঘ) এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বেদীমূলে বলি দেওয়া হয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মানবিকতা প্রভৃতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যক্তিজীবনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলে। মুসোলিনী মন্তব্য করেছেন: “….the Fascist state is itself conscious and itself a will and personality-thus it may be called the ethic’ state.”

(ঙ) ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে হিংস্রতা (violence), সন্ত্রাস (terror) প্রভৃতি। সরকারের প্রতি আনুগত্য আদায়ের জন্য বা রাজনীতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ভীতি প্রদর্শন, দমন-পীড়ন, সন্ত্রাস প্রভৃতির আশ্রয় নেওয়া হয়।

(চ) ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিকৃত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যুদ্ধকে সমর্থন করা হয়। ফ্যাসিবাদী শাসন আসলে সামরিক শাসনের রকমফের মাত্র। এই রাজনীতিক ব্যবস্থা যুদ্ধের পক্ষে এবং শান্তির বিরুদ্ধে। মুসোলিনী বলেছেন: “International peace is a coward’s dream” মানবজীবনের ক্ষেত্রে যুদ্ধের অপরিহার্যতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: “War is to man what maternity is to worhan.”

(ছ) ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা আন্তর্জাতিকতার আদর্শের বিরোধী। এই ব্যবস্থায় অন্ধ, উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সৌভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী প্রভৃতিকে উপেক্ষা করা যায়।

(জ) ফ্যাসীবাদ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক। এই ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদকে জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে গণ্য করা হয়। মুসোলিনী বলেছেন: “Imperialism is the eternal and is the immutable law of life.”

(ঝ) এই অবস্থায় কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে ব্যক্তিগত মালিকানাকে স্বীকার করা হয়। এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা শিল্প-বাণিজ্যের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তাই সামাজিক ও আর্থনীতিক দিক থেকে ফ্যাসিবাদকে একটি প্রতি-বিপ্লবী ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

দৃষ্টান্ত: ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার উপযুক্ত উদাহরণ হল মুসোলিনীর নেতৃত্বাধীন ইতালি এবং হিটলারের শাসনাধীন জার্মানী। আবার অনেকে জেনারেল ফ্রাঙ্কো (Franco)-র অধীন স্পেনকেও ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করার পক্ষপাতী। কিন্তু ফ্রাঙ্কোর স্পেনকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে গণ্য করা যায় না। ফাইনার বলেছেন যে, ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থার একটা প্রবণতা ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত স্পেনে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু একে সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থা বলা যায় না। কারণ ফ্রাঙ্কো সেনাবাহিনী ও গীর্জার সমর্থনের ভিত্তিতে তার স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি মতাদর্শের মাধ্যমে তাঁর সরকারের সমর্থনে জনমত গঠনের চেষ্টা করেননি। সর্বোপরি তাঁর ‘ফালান্জ’ (Falange) দল যাবতীয় রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল বটে, কিন্তু পেশাদারী সংস্থাসমূহ চার্চ প্রভৃতির স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে হরণ করেনি। দলীয় কাঠামো, দলীয় নীতি প্রণয়ন ও পরিচালন পদ্ধতি, নাগরিক স্বাধীনতা ও সামাজিক সংগঠনের অধিকার, রাষ্ট্র সম্পর্কে বক্তব্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী সর্বাত্মক ব্যবস্থাগুলির মধ্যে অনেক পার্থক্য বর্তমান।