সংজ্ঞা : প্রহসনকে কোনো কোনো সমালোচক নাটকেরই অন্যতম শ্রেণিরূপে আখ্যাত করতে চেয়েছেন। কিন্তু সমালোচক আব্রাম্স প্রহসনকে কমেডির একটি বিভাগ বলে মনে করেন। সেইভাবেই তাকে যদি বিন্যস্ত করা যায় তাহলে বলতে হয়— “ফার্স বলতে বোঝায় অত্যন্ত লঘু কল্পনাসিদ্ধ, অতিরঞ্জিত এক ধরনের হাস্যোচ্ছল নাটক।” সহজ সরল এইরকম কমেডিতে হাস্যময়তা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত, আসলে এখানে বুদ্ধির খেলা বিশেষ দেখা যায় না এবং বাগ্‌বৈদগ্ধ্য দেখাবার অবকাশ কম বলে একে একটু নিচু ধরনের কমেডি মনে হতে পারে। তবে বিশিষ্ট, ইংরাজ সমালোচক প্রহসন সম্পর্কে বলেছেন: “The type of drama stuffed with low humour and extravagant wit.” আর সংস্কৃতে আলংকারিক প্রহসন সম্বন্ধে বলেন“হাস্যোদ্দীপক কাব্যভু প্রহসনমিতি স্মৃতম্”।

দৃষ্টান্ত : শেকসপিয়রের কোনো নাটককে প্রহসনের স্তরে নামানো না গেলেও, তাঁর— ‘দি টেমিং অব দি শ্ৰু’ কিংবা ‘দি মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর’ নাটকে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দৃশ্য আছে সেগুলি প্রহসন অভিধায় ভূষিত। এছাড়া ফরাসি নাটকের মধ্যে মলেয়রের নাটক – “লে মিসানথ্রোপ”, ইংরাজি নাটকের মধ্যে রিচার্ড শেরিডানের—‘দি স্কিমিং লেফটেন্যান্ট’, আমেরিকান নাটকের মধ্যে ব্রানডন টমাসের—’চার্লিজ আন্ট’, বিশেষ প্রসিদ্ধ। আর বাংলায় প্রহসন বলতে বোঝায়— জ্যোতিরিন্দ্রনাথের—‘অলীকবাবু’, দ্বিজেন্দ্রলালের—‘কল্কি অবতার’, অমৃতলাল বসুর—’তাজ্জব ব্যাপার’ প্রভৃতি।

কয়েকটি বাংলা প্রহসন :

দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী : দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাটকটি একখানি উৎকৃষ্ট প্রহসন রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর বিষয়বস্তু নব্য সভ্যতার ধ্বজাধারী ইয়ং বেঙ্গলের হাস্যকর এবং অসংগতি নির্ভর ব্যভিচার। নব্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই সমাজের মধ্য হতে উঠে এসেছে মদ্যাসত্ত নিমচাঁদ ও অটলবিহারী বারাঙ্গনা বিলাসে উন্মার্গগামী অটলবিহারীকে অনুসরণ করেছে নকুলেশ্বর উকিল ও কেনারাম ডেপুটি।

আবাল্য পিতামাতার শাসনহীন অপরিণামদর্শী যুবক হল অটলবিহারী। মূর্খ, নির্বোধ ঘটিরাম ডেপুটি একটি অনবদ্য হাস্যকর চরিত্র। পূর্ববঙ্গের কথ্যভাষা রাম মানিক্যের মুখে বসিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি-প্রবণতাকে প্রহসনের উপযোগী করা হয়েছে বলা যেতে পারে।

বিষয়বস্তুতে কোনোও জটিলতা নেই; রহস্যময়তাও নেই, আকস্মিক ঘটনার ঘনঘটাও নেই, ঘটনার বিক্ষিপ্ততাও নেই, দৃশ্য সংযোজনায় অসংগতিও নেই; নাট্যরস সৃষ্টিতে কোনো অসংলগ্নতাও নেই। এ প্রহসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সরস ও প্রাণবান সংলাপ এবং ব্যঞ্জনময় কথাবার্তা। নিমচাঁদের wity-এ বাচনভঙ্গি যেমন হাস্যরস সৃষ্টি করে, তেমনি তার চরিত্রের বিশেষ দিকও ফুটিয়ে তোলে, ঘটিরাম-অটল-ভোলা-কানদের কথোপকথনেও অভ্রান্ত ভাবেই তাদের মানসিক ও সামাজিক অবস্থানের স্বরূপ প্রকাশ পায়। এইসব প্রহসন সুলভ হাস্যরসের উদ্ভবস্থল। তৃতীয় অঙ্কের শেষ দৃশ্যে মোগলবেশী অটলবিহারী কুমুদিনী-হরণ- বৃত্তান্ত উচ্ছ্বসিত হাস্যরসের কেন্দ্রস্থল।

সমাজ-সংশোধনের ইঙ্গিতবাহী হয়েছে মদ্যপান নিবারণী সভা ও ব্রাহ্মসমাজের উপস্থিতি। কিন্তু এসব নীতি ও সভাবের দিক, অন্ধকারের পাশে আলো মতো। এই দুই-ই থাকবে পাশাপাশি। আলো স্বপ্রকাশ হলেই, অন্ধকার সরে যায়, আলোর অভাবই অন্ধকার। নীতি ও সভাবের অভাব বলেই নিমচাঁদ এই দুই সভাকে ব্যঙ্গ করতে চায়, কিন্তু তাতে সভাবের কোনো বিকৃতি হয় না, নিমচাঁদবাই হাস্যকর চরিত্রে পরিণত হয়।

অটল বিহারী নায়ক, নিমচাঁদ তার ইয়ার। অটলবিহারী সতত কুকর্মে রত–তার কোনো পরিবর্তন নেই ; কিন্তু নিমচাঁদ এক বিবর্তিত চরিত্র। নিমচাঁদ ইয়ার, কিন্তু বিদূষক নয়, নির্বোধও নয়। তার প্রকাণ্ড পাণ্ডিত্য, অনাসক্তি, কর্মে অনীহা ও আভিজাত্যবোধ তাকে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে ৷ নিমচঁাদ যেন ভুয়োদর্শী। মদ্যপান ‘নিবারণী সভার’ যারা হোতা, তাদের গোপন কুকর্মের সংবাদ জানে বলেই নিমচাঁদ তাদের ব্যঙ্গ করে, তাদের প্রতি তার কোনো আস্থা নেই। রামমানিক্য, ঘটিরাম ডেপুটির মতো নির্বোধ ব্যক্তিদের প্রতি তার করুণা মিশ্রিত কৌতুক। সে মাতাল, উচ্ছৃঙ্খল, কিন্তু ইন্দ্রিয়পরায়ণ নয়। সে যেন বাউল গানের যুবতীর মতো— জলে নামে, স্নান করে, কিন্তু চুল ভেজায় না। কাঞ্চনের সঙ্গে ইয়ার্কি করে—ওই পর্যন্তই তার সীমানা, বন্ধুদের সঙ্গে জঘন্য ইয়ার্কি দেয়, কিন্তু অটল কর্তৃক পরস্ত্রী হরণে অসম্মতি জানায়। সে নীতি নষ্ট নয়, কিন্তু পাপ-কর্মপরায়ণও নয়। সকলের মধ্যে সে স্বতন্ত্র—শেকসপিয়ার-অনুরক্ত এবং অভিজাত্যগর্বী।

নিমচাঁদের চরিত্রে অনেকেই মধুসূদনের চরিত্রের প্রাধান্য লক্ষ্য করেছেন। তবে, নিমচাঁদের চরিত্র অঙ্কনে, দীনবন্ধু মধুসূদনকে ভেবেছিলেন কিনা—তার কোনো প্রমাণ নেই। নিমচাঁদের অসাধারণ পাণ্ডিত্য, শেকসপিয়ার-অনুরক্তি, ইংরাজ ভাবাপন্ন মনোভাব এবং শেষ জীবনে অনুতাপ ও খেদোক্তি মধুসূদনকে স্মরণ করিয়ে দেয়, জীবনের শান্ত ধারা হতে বিচ্ছিন্ন বলেই নিমচাঁদ নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে। জীবন সম্পর্কে সে উদাসীন; নিজের অবস্থা বিপাকের দায়ে দায়বদ্ধ বলে মনে করে, এবং নিজের ব্যঙ্গের মধ্যে নিহিত থাকে এক প্রবল হৃদয়ভেদী অনুতাপ। নিমচাঁদ এক অনবদ্য ট্র্যাজিক চরিত্র। এখানে হিউমার স্যাটায়ার এর পাশাপাশি অবস্থান। সে লায়ারের মতোই অনুভব করে– ‘I am more sinned against than sinning’.

মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ : মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ একখানি নিখুঁত প্রহসন। এর নামকরণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র–বোধহয় বিষয়বস্তুর বিস্ময়করতা দেখেই এই নামকরণ। মধুসূদনের প্রথম প্রহসন—’একেই কি বলে সভ্যতা’ ব্যঙ্গের লক্ষ্য ছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যুবা সম্প্রদায়, বর্তমান প্রহসনে ব্যঙ্গের লক্ষ্য ভণ্ড, অত্যাচারী, কুপমণ্ডুক প্রাচীন সমাজ। প্রথম প্রহসনের পরিবেশ নাগরিক জীবন, এই প্রহসনের পরিবেশ গ্রাম জীবন। ব্যঙ্গের প্রধান লক্ষ্য ভক্তপ্রসাদ। গ্রাম্য জমিদার, নির্মম চরিত্র এই ভত্তপ্রসাদ প্রজাদের খাজনা এক পয়সা মাফ করে না, কাউকে সাহায্য দেয় না, কিন্তু পরকীয়ায় সিদ্ধহস্ত, রূপসী পরস্ত্রী দর্শনে ভারতচন্দ্র আবৃত্তি করে। হানিফের স্ত্রী ফতেমার রূপ ব্যাখ্যান শুনে ভক্তপ্রসাদ তার কাছে কুটিনী পাঠিয়েছে এবং নিজ মনোবাসনা সিন্ধি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই যুবার বেশে অভিসারে বেরিয়েছে।

ভক্তপ্রসাদ মধুসূদনের ব্যঙ্গের পাত্র হয়েছে প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত নিজে সে যাবতীয় কুকর্মে রত হয়েও পুত্রের ধর্মাচরণের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি এবং হিন্দুধর্মের রক্ষার জন্য উদ্গ্রীব। দ্বিতীয়ত মুসলমান রমণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে তার আপত্তি নেই, যত বাধা মুসলমান সংস্পর্শজাত কোনো খাদ্যগ্রহণ করায়।

ভক্ত প্রসাদের যৎপরনাস্তি শাস্তি হয়েছে। মাত্রা কিঞ্চিৎ হলেও ‘Poetc Justice’-এর বিষয়টাই এখানে বড়ো। তবে ভক্ত প্রসাদের মানসিক পরিবর্তন কিছুটা অস্বাভাবিক। অন্যান্য চরিত্রগুলি সবই টাইপ, কিন্তু বাস্তবানুগ।

এই প্রহসনে মাত্রাতিরিক্ততা ও অস্বাভাবিকতার জন্য প্রথম প্রহসন অপেক্ষা কিছুটা নিকৃষ্ট। কিন্তু এই প্রহসনে মধুসূদন চরিত্রগুলির পরিবেশ চিন্তা করে তাদের মুখে যে কথ্য ভাষার সংলাপ দিয়েছেন তা অপূর্ব। এদিক থেকে তিনি রামনারায়ণ ও দীনবন্ধুর পূর্বসূরী।