প্রশ্নঃ ফলিত নৃ-বিজ্ঞান কী? ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের গুরুত্ব আলােচনা কর।

অথবা, ফলিত নৃ-বিজ্ঞান কাকে বলে? ফলিত নৃ-বিজ্ঞান পাঠের তাৎপর্য বর্ণনা কর।

অথবা, ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। ফলিত নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীতা আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ নৃ-বিজ্ঞানের ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কিত বিজ্ঞান হচ্ছে ফলিত নৃ-বিজ্ঞান। সাধারণত কোনাে সামাজিক সমস্যাকে ঘিরে সৃষ্ট নৃ-তাত্ত্বিক মতবাদের যথার্থতা যাচাই বা মানব কল্যাণের জন্য কোনাে সমস্যার প্রকৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে সমাধানের পথ নির্দেশ করে থাকে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা গবেষণা চলছে। ফলিত নৃ-বিজ্ঞান উন্নয়নমূলক কর্মপন্থা বাস্তবায়নে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের সংজ্ঞাঃ কোনাে তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুর ব্যবহারিক প্রয়ােগ হচ্ছে ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের কাজ। মানব সমাজ সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞান যেকোনাে বিষয়বস্তুর পেশাদার বা ব্যবহারিক প্রয়ােগকে ফলিত নৃ-বিজ্ঞান বলা হয়। বহু পূর্ব থেকেই নৃ-বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুর ব্যবহার শুরু হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন Applied Anthropology প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। অন্যান্য নৃ-বিজ্ঞানিরা একে Practta Anthropology ও Action Anthropology নামে অভিহিত করলেও বিষয়টি শেষ পর্যন্ত Applied anthropology নামে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করিয়াছে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন নৃ-বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।

নৃ-বিজ্ঞানী লুসি মেয়ার (Lucy Mair) বলেন, নৃ-বিজ্ঞানের যে অংশে মানব জীবনের ব্যবহারিক বিষয়াদি আলােচিত হয় তাকে বলা হয় ফলিত নৃ-বিজ্ঞান।

মার্গারেট মীড তার Applied Anthropology গ্রন্থে ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, যে কোনাে বিষয়বস্তুর পেশাদার তথা ব্যবহারিক প্রয়ােগই হলাে ফলিত নৃ-বিজ্ঞান। তিনি আরাে বলেন, ‘ফলিত নৃ-বিজ্ঞান হলাে সমাজবিজ্ঞানের একটি অভিধান।

সার্বিক সংজ্ঞাঃ মানব জীবনে অগণিত সমস্যায় পড়তে হয়। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন ব্যবহারিক কলা কৌশল প্রয়ােগ করা হয়। আর এ সকল ব্যবহারিক কাজ মানুষের বাস্তব জীবনকে সমস্যা থেকে পরিত্রাণে সহায়তা করে থাকে। তাই মােদ্দা কথায় বলতে পারি, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত ব্যবহারিক প্রয়ােগই ফলিত নৃ-বিজ্ঞান।

ফলিত নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব/প্রয়ােজনীয়তাঃ বর্তমান আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগেও ফলিত নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব/প্রয়ােজনীতা অপরিসীম। নিম্নে ফলিত নৃ-বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা আলােচনা করা হলাে-

(১) মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভঃ নৃ-বিজ্ঞান পাঠে মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। নৃ-বিজ্ঞান মানুষের জৈবিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক নিয়ে আলােচনা করে। এভাবে মানুষকে দু’দিক থেকে গবেষণা করে বিধায় নৃ-বিজ্ঞান একটি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মানুষ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে নৃ-বিজ্ঞানের চর্চা অনস্বীকার্য। কেননা জৈবিক ও সাংস্কৃতিক এ দু’টি সত্তার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। নৃ-বিজ্ঞানী পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেন বিধায় মানুষ সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিতে সক্ষম। সে কারণে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।

(২) প্রশাসনিক কাজকর্মঃ নৃ-বিজ্ঞানী তার গবেষণা দ্বারা সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেন তাতে তার পক্ষে প্রশাসনিক কাজকর্ম করা একদিকে যেমন সহজ হয়, অন্যদিকে প্রশাসনিক উন্নতি আনার জন্য কার্যকরী সুপারিশ করা সহজ হয়। দেশ, জাতি, সংখ্যালঘু সমস্যা, সাম্প্রদায়িক মতাে পার্থক্য ইত্যাদিতে জর্জরিত যে দেশ সে সব দেশে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণ অপরিহার্য। কেননা নৃ-বিজ্ঞানী ঐ সকল সমস্যা সমাধানে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাতি ধর্ম ভাষা সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গবেষণা কাজ করে থাকেন। এতে একদিকে যেমন সমস্যা নির্ণয় করা যায়, অন্যদিকে সঠিকভাবে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামােতে উন্নয়ন করা যেতে পারে। যে কারণে বিজ্ঞান পাঠ করা একান্ত প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

(৩) অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানাঃ কোনাে দেশের উৎপাদন, বন্টন, ভােগ, সঞ্চয় প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা নৃ-বিজ্ঞান মানুষের অর্থনৈতিক সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে আলােচনা করে।

(৪) রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণঃ মানব সমাজ থেকে কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা দূর করা যায় কীভাবে দেশের উন্নয়নের গতিকে তরান্বিত করা যায়, রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতার উৎস, নেতৃত্বের কাঠামাে, দলনেতার ভূমিকা ইত্যাদি নৃ-বিজ্ঞান অধ্যয়নে জানা যায়।

(৫) উপজাতি সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানঃ বর্তমান পথিবীতে ক্ষুদ্র জাতি গােষ্ঠির লােকজন নানা সমস্যায় জর্জরিত। একজন নৃ-বিজ্ঞানী ক্ষুদ্র জাতি গােষ্ঠির সমস্যাবলি অতি সহজেই চিহ্নিত করে সমাধানে পারেন। তাই নৃ-বিজ্ঞান পাঠ করা আবশ্যক।

(৬) সমাজ কাঠামাে পাঠঃ নৃ-বিজ্ঞানী বিশেষ করে সামাজিক নৃ-বিজ্ঞানী ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজ সম্পর্কে নিবিড় গবেষণা শেষে সেখানকার সমাজ কাঠামাের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেন। আদিম কিংবা আধুনিক সব সমাজের বাস্তব কাঠামো বিশ্লেষণে নৃ-বিজ্ঞানী অধিকতর যতশীল। আর সমাজ কাঠামাে সম্পর্কে প্রকত জ্ঞান সমাজকে অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম কাঠামাে হল সমাজ কাঠামাের বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে নৃ-বিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে সমাজবিজ্ঞানী বিশেষ ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজ কাঠামাে সম্পর্কে জানতে অক্ষম। সুতরাং সমাজ কাঠামাের পুর্ণাঙ্গ পাঠের নিমিত্তে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিহার্য।

(৭) সামাজিক সমস্যার সমাধানঃ যেকোনাে সামাজিক সমস্যার বাস্তবতা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন এবং ঐ সমস্যা লাঘবে নৃ-বিজ্ঞানী আন্তরিকতার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কোনাে সামাজিক সমস্যা নিরসনে বাস্তব সমস্যার প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে গবেষণা করে সমাধানের পন্থা ও দিক নির্দেশনা দেয়াও তার কাজ। কাজেই সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

(৮) শ্রমিক অসন্তোষ দূরঃ কলকারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণে এবং শিল্পের সাথে জড়িত প্রশাসনিক কাজে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নৃ-বিজ্ঞান যেহেতু মানুষের আচার-আচরণ, ধ্যান ধারণা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে সেহেতু তার পক্ষে সহানুভূতিশীল সমাধানের পথ খােজা সহজ হয়। অতএব শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণ ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে নৃ-বিজ্ঞান জ্ঞান অপরিহার্য।

(৯) পরিকল্পনা বাস্তবায়নঃ কোনাে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানীর বাস্তব জ্ঞান কোনাে পরিকল্পনার উপযােগিতা ও কার্যকরি বিশ্লেষণে সহায়ক হতে পারে। আবার গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হয় এমন প্রচলিত আচার-বিশ্বাস ও সংস্কারের পরিবর্তন এনে জনসাধারণকে পরিকল্পনা গ্রহণে উৎসাহিত করতে পারেন।

(১০) শিক্ষাক্ষেত্রেঃ আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংস্থা দরিদ্র তথা উন্নয়নকামী দেশে শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধিতে নৃ-বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলাফল কে কাজে লাগান। সে কারণে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

(১১) স্বাস্থ্য ও জীবন মান উন্নয়নঃ কোনাে দেশের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন এবং জীবন মান বৃদ্ধিতে নৃ-বিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিসীম। স্বাস্থ্য ও জীবন মান সম্পর্কে সমাজবাসীর আচার বিশ্বাস মনােভাব সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানী প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। তাই এ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবন মান সম্পর্কিত অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে নৃ-বিজ্ঞান পাঠ করা অত্যাবশ্যক।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক ফলিত নৃ-বিজ্ঞানী, আর্থ-সামাজিক প্রশাসনিক রাজনৈতিক প্রভতি সমস্যার মূল প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি প্রয়ােগে গবেষণা করেন। নৃ-বিজ্ঞানী সামাজিক সাংস্কৃতিক সম্পর্কে জরিপ পরিচালনা করেন এবং উন্নয়ন তথা মানব কল্যাণকে কীভাবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠা যায় তার পন্থা বা পদ্ধতি সম্পর্কে সুপারিশমালা তৈরি করেন। তাই উন্নত বা আমাদের মত উন্নয়শীল দেশে ফলিত নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।