প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোট গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের একজন। তিনি ছয়দশক ধরে অসংখ্য ছোটোগল্প রচনা করেছেন। তার মধ্যে কিছু কিছু গল্প অনবদ্য। তাঁর গল্পের বিষয় ও লিখনশৈলী অত্যন্ত আধুনিক। কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এদেশে যে কল্লোলগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন সেই কল্লোল গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য। আমাদের জীবনের বাস্তবতা, আধুনিকতা আনয়নে এই গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেঁনেসাসের ফলে ইউরোপীয় সাহিত্যে যে রূপ পরিবর্তন বা সূচিত হয়েছিল তা অনুসরণ করেই কল্লোল গোষ্ঠী অগ্রসর হয়েছিল। ব্যক্তির মূল্যায়নই এ সময় হয়ে উঠে প্রধান। প্রেমেন্দ্র মিত্র সেই চেতনাকে ধারণ করে বিভিন্ন নামকরণে অনেক গল্প রচনা করেছেন।
প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের ক্রান্তিরেখা চিহ্নিতকারী এক নান্দী গল্পকার বিশ শতকের বিশ্বাসের আশ্রয়হারা মানুষের আত্মার যন্ত্রণা কখনো আর্তি, কখনো বিক্ষোভের আকার ধারণ করেছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটোগল্পে। নগরজীবনের ভাঙন ও অবক্ষয়ের স্বরূপ উন্মোচনে প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখনী তাই আকস্মিক জীবনের জটিলতার বিশ্লেষণে নিপুণ ব্যবচ্ছেদক। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘পঞ্চশর’ [১৯২৯), ‘বেনামী বন্দর’ [১৯৩০], ‘পুতুল ও প্রতিমা’ [১৯৩২], ‘মৃত্তিকা’ (১৯৩২], ‘অফুরন্ত’ (১৯৩৫), ‘নিশীথ নগরী’ (১৯৩৮), ‘ধূলিধূসর’ [১৯৪৩), ‘মহানগর’ [১৯৪৩], ‘কুড়িয়ে ছড়িয়ে’ (১৯৪৬), ‘সামনে চড়াই’ (১৯৪৭), ‘সপ্তপদী’ [১৯৫৫), ‘জল পায়রা’ (১৯৫৭), ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘নানা রঙে বোনা’ (১৯৬০) প্রভৃতি।
এখানে স্মরণীয়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে দ্রুত পরিবর্তত হয় মানুষের জীবনের মূল্যবোধ। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি সব কিছুই পরিচালিত হতে থাকে ধনিক শ্রেণির দ্বারা। নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হতে থাকে শ্রমিক শ্রেণি, নিম্নবিত্ত শ্রেণি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতিষ্ঠার ফলে ভেঙে পড়ে যৌথ পরিবার। বিংশশতাব্দীতে সভ্যতার কারণে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, অস্তিত্ব সচেতনতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে নিরাশ্রিত, নিঃসহায় হয়ে পড়ে বিভিন্ন মানুষ। প্রেমেন্দ্র মিত্র সেই নিরাশ্রয়তার নিঃসহায়তার ছবি এঁকেছেন তাঁর বিভিন্ন গল্পে। তাঁর রচিত বিভিন্ন গল্পের বিষয় আলোচনা করলে এ সত্য কথাটি স্পষ্টরূপে ধরা পড়বে নিঃসন্দেহ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের ক্রান্তিরেখা চিহ্নিতকারী এক নান্দী গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর মননের সাথে যুক্ত হয়েছে কল্লোলের আদর্শ, পাশ্চাত্য শিল্প সাহিত্য ভাবনা, কবির কবিত্ব বিজ্ঞানীর নিরাসক্তি, সর্বোপরি গল্পকারের সহমর্মিতাবোধ। তিনি ছিলেন একজন Naturalist লেখক কলোনীয়াল কাঠামোর মধ্যে যেসব লেখক বস্তুনিষ্ট জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে – জীবনের বস্তুসত্যের অনুপুষ্ক বর্ণনা দিয়েছেন; প্রেমেন্দ্রমিত্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাই নগর জীবনের ভাঙন ও অবক্ষয়ের স্বরূপ উন্মোচনে তাঁর লেখনী অকম্পিত জীবনের জটিলতা বিশ্লেষণে নিপুণ ব্যবচ্ছেদক।
গল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র বিষয়বস্তুকে তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন বিধায় প্রকরণের চেয়ে বিষয়বস্তুকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তবে বস্তুনিষ্ঠ লেখক হওয়ায় বিষয়ের ক্ষেত্রে তেমন বৈচিত্র্য দেখাতে পারেননি। বরং সমসায়িককালের লেখকদের থেকে তাঁর গল্পের উপকরণে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তিনি উপকরণগুলোকে বিভিন্ন মাত্রা দেবার চেষ্টা করেছেন। জীবনের বস্তুসত্য উন্মোচন করতে গিয়ে বিশ্লেষণের পরিবর্তে Narrationকে প্রাধান্য দিয়েছেন প্রতিটি গল্পের Narration প্রায় একই রকম হলেও উপকরণগুলোকে বিভিন্ন মাত্রা দেবার চেষ্টা করেছেন। শুধু কেরানী, মহানগর, মৃত্তিকা, পুন্নাম, বেনামী বন্দর প্রভৃতি গল্পে কখনো নিরীহ বর্ণনা আবার কখনো কখনো বর্ণনার মধ্যে চিত্রময়তা লক্ষ করা যায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র মূলত নগর জীবনের কথা, নাগরিক জীবনের আলো আঁধারী নগরবাসীর মানব অস্তিত্বের স্বরূপ জটিলতম মনস্তত্ত্ব, নাগরিক জীবনের বণ্টন বৈষম্য, সুস্থ দাম্পত্য প্রেমের মধ্যে বৈষম্যের বিষাক্ত বীজ, মানব মানবীর সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় তাঁর একাধিক গল্পের নাগরিক চেতনার অভিজ্ঞান। প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেতনার জগৎ একান্তভাবেই মানব অস্তি ত্বের বাস্তবমুখী সমস্যার আবর্তে আবর্তিত। নাগরিক জীবনের বিভিন্ন প্রান্তকে তুলে ধরার জন্য তাই তিনি ক্লেদাক্ত মন্ময় জীবনকে বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখকের উক্তি-
“যাদের কথা কেউ লেখে না, যাদের জীবনে চোখ ধাঁধানোর ছড়াছড়ি নেই, তাদের কথা লেখার একটা তাগিদ আমার মধ্যে ছিল।” [গল্প লেখার গল্প: প্রেমেন্দ্র মিত্র]
অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর হতাশার যুগযন্ত্রণাকে সর্বাংশে গ্রহণ করে প্রেমেন্দ্র মিত্র দেখেছেন সমকাল নগরজীবনের কদর্যতা, নিষ্ঠুরতা বীভৎসতা, কদাকার অহংকার, রুগ্ণ গলিত শব শুধু কেরানী, পুন্নাম, সংসার সীমান্তে, বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে, পোনাঘাট পেরিয়ে মহানগর প্রভৃতি গল্পে ফুটে উঠেছে নগর জীবনের কঠোর কঠিন বাস্তবতা, দাম্পত্য সম্পর্কের জটিলতা, প্রেম, প্রেমহীনতা। তবে এসব গল্পে নাগরিক জীবনের জটিল মনস্তত্ত্ব আঁকা হলেও লেখক সর্বত্র এক কল্যাণ সুন্দর জীবন ও জীবনাতীতের সন্ধান করেছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment