প্রশ্নঃ প্রাচীন সভ্যতায় গ্রিকদের অবদানসমূহ চিহ্নিত কর।

অথবা, প্রাচীন সভ্যতায় গ্রিকদের অবদানসমূহ মূল্যায়ণ কর।

ভূমিকাঃ এশীয় ও প্রাচ্য দেশিয় সমাজ চিন্তাধারা, সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার থেকে পৃথক এক ইউরােপীয় সভ্যতার অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে বর্তমান সময়ে। এ সভ্যতার আদি উৎপত্তি ছিল গ্রিস। কিন্তু ইউরােপীয় বা গ্রিসীয় বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ গ্রিসীয়দের জাতিগত বা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত নেই। এর স্বরূপ নিহিত রয়েছে গ্রিসীয় সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে। এই সমাজব্যবস্থা প্রাচ্য সমাজব্যবস্থা থেকে পৃথক হলেও তারই অনুসৃত স্বরূপ মিশর, ব্যাবিলন, ক্রিট ও ফিনিশিয়ার সভ্যতার মধ্যে দিয়ে যে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তারই পরিণত রূপ ছিল গ্রিসীয় সভ্যতা।

সভ্যতায় গ্রিকদের অবদানঃ মানবসভ্যতার বিকাশে গ্রিকদের অবদান অপরিসীম। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন ও স্থাপত্য ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিকরা কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

(১) সমাজব্যবস্থাঃ প্রাচীন গ্রিসের সমাজব্যবস্থা ছিল পরিবারকেন্দ্রিক। সেখানে নানা উপজাতি ও গােত্র বাস করতাে। কয়েকটি পরিবার মিলে একটি গোত্র এবং কয়েকটি গোত্র মিলে একটি উপজাতি তৈরি হত। অর্থাৎ তখন তাদের সমাজব্যবস্থা ছিল আদিম গােষ্ঠীভিত্তিক।

(২) ধর্মঃ প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীরা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করতাে এবং প্রকৃতিকে ভয় করতাে। তারা বিশ্বাস করতাে সূর্যদেব অশ্ববাহী স্বর্ণরথে আকাশে প্রবেশ করলে দিন হয়। তাদের দেবতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও শক্তিমান ছিলেন জিউস, যিনি আকাশের দেবতা এবং বস্ত্র ও বৃষ্টির মালিক।

(৩) রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ ক্লাসিক্যাল গ্রিকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবদান হচ্ছে নগররাষ্ট্র সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা প্রদান। দেশের ভূ-প্রকৃতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ফলে গ্রিসে নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। নগররাষ্ট্রের মধ্যে এথেন্স, থিবস ও মেশারা, দক্ষিণে পেলাে, সেনসাস অঞ্চলে স্পার্টা ও কোরিন্থ ছিল প্রধান। নগররাষ্ট্রের আকৃতি ও প্রকৃতি এক ছিল না। এগুলাের মধ্যে স্পার্টা ও এথেন্স রাষ্ট্র ছিল শীর্ষস্থানীয়।

(৪) স্পার্টা নগররাষ্ট্রঃ দক্ষিণ গ্রিসের (বা পেলাে পন্নেসস) লাকোনিয়া প্রদেশ দোরীয়রা জয় করে সেখানে স্পার্টা নামে নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। দখলকারীরা স্পার্টান নামে পরিচিত ছিল। পরাজিত অধিকাংশকে স্পার্টানরা দাসে পরিণত করে। দাসদের বলা হতাে হিলােতেসর। হিলােতেসরা অত্যাচারী স্পার্টানদের ঘৃণা করত, সুযােগ পেলেই বিদ্রোহ করত। শাসকেরা স্বৈরাচারী এবং প্রগতিবিরােধী ছিল। শাসনব্যবস্থা ছিল একনায়কত্বমূলক। স্পার্টার শাসন পরিচালনা করতেন দু’জন রাজা, একটি অভিজাত পরিষদ ও একটি সাধারণ পরিষদ। স্পার্টা একটি সামরিক রাষ্ট্র ছিল।

(৫) এথেন্স রাষ্ট্রঃ গ্রিক সভ্যতায় এথেন্স নগররাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বেশি। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৮ম শতাব্দীতে গ্রিসে এথেনীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন পৃথিবীতে এথেন্স নগররাষ্ট্রে প্রথম গণতন্ত্রের সূচনা হয়। তবে এখানে যে গণতন্ত্র এসেছিল তা একদিনে আসেনি। সামাজিক স্তর বিন্যাসে এথেন্সের অধিবাসীরা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। উচ্চ শ্রেণিতে ছিল অভিজাত সম্প্রদায়। অভিজাতবর্গ ছাড়া স্বাধীন এথেন্সবাসীদের বলা হতাে দেমােস। সমাজের সর্বনিম্নে বাস করত দাসশ্রেণি। দেশ শাসনে দাসেরা অংশ নিতে পারতাে না।

(৬) চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যঃ প্রাথমিক যুগে গ্রিক চিত্রশিল্পীরা কলসে জীবজন্তু এবং বিভিন্ন প্রকার চিত্তাকর্ষক বিষয় অঙ্কন করতাে। চিত্রকর ডুরিস আজাক্স ও অডেসাসের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষ সুন্দরভাবে চিত্রিত করে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। এ যুগে কাঠ ও দেয়াল চিত্রিত করা হতাে। মানুষ, শকট, ঘােড়া ইত্যাদি জীবজন্তুর ভাস্কর্য সে যুগের ভাস্করগণ অত্যন্ত সুনিপুণভাবে পাথর খােদাই করে নির্মাণ করতাে। ভাস্করদের মধ্যে মিরন, পলিকলিটাস, ওফিরিপস, স্কোফাস ও প্রাকিসটেলস ছিলেন প্রসিদ্ধ।

(৭) ভাষা ও সাহিত্যঃ সভ্যতা ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে যেসমস্ত মহৎ উপাদান গ্রিকরা অবদান হিসেবে রেখে গেছেন তার মধ্যে তাদের ভাষা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। চিন্তা ও বিবেকশক্তির জটিলতম পর্যায়ের বিকাশসাধনে এটি ছিল যথাযথ নমনীয় এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। হােমারের ‘ইলিয়ড ও ওডেসি’ বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। হেসিয়ড, পিনভার প্রমুখ ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং সােফোলস, ইউরিপাইডস, এরিস্টোফেনস প্রমুখ ছিলেন প্রসিদ্ধ নাট্যকার।

(৮) দর্শনঃ সভ্যতার ইতিহাসে গ্রিকরাই একমাত্র প্রাচীন জাতি যারা দর্শনশাস্ত্রে অমূল্য অবদান রেখে গেছেন। দর্শনশাস্ত্রে তাদের অভূতপূর্ব উন্নতির কারণ দু’টি। প্রথমত, তারা গভীর প্রজ্ঞা ও মুক্ত চিন্তাশক্তির অধিকারী ছিল এবং সমালােচনামূলক জ্ঞান অনুসরণ করতে তারা চিন্তাশক্তির ওপর কোন সীমারেখা টানত না। দ্বিতীয়ত, গ্রিসে এমন কোন পুরােহিত বা অভিজাত সম্প্রদায় ছিল না যাদের অহেতক কৌলীন্যবােধ ও প্রগলভতা ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের সাথে বিবাদের সৃষ্টি করত। এ অবস্থায় গ্রিকরা দর্শনশাস্ত্রকে ধর্মীয় বিশ্বাসের আওতামুক্ত করে একে পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে পরিগণিত করে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগণ ছিলেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী, তাদের অতীত বিষয়বস্ত ছিল প্রাকৃতিক বিশ্বাসের উপর নির্ধারিত। এ শেণির দার্শনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে থেলিস, ডিমােক্রিটাস ও জেনােফোনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

(৯) গণিতশাস্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞানঃ গণিতশাস্ত্রের চেয়ে জ্যামিতিতে গ্রিকদের কৃতিত্ব অনেক বেশি। থেলিস, পিথাগােরাস ও ইউক্লিড ঐ যুগের খ্যাতনামা জ্যামিতিশাস্ত্র বিশারদ। ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’-এর ওপর আধুনিক জ্যামিতিশাস্ত্র প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীন ইতিহাসের সবচেয়ে খ্যাতনামা অঙ্কশাস্ত্র বিশারদ ছিলেন আর্কিমিডিস। তিনি পদার্থ ও যন্ত্রবিদ্যায় সমান কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন।

(১০) জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রঃ জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্রিকদের অবদান সৃষ্টিধর্মী। থেলিসের সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্বন্ধে উৎকষ্ট ধারণা ছিল। আবিস্টার চন্দ্র ও সূর্যের সম্পর্ক নির্ণয় করেন। হিপার সৌরবছরের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেন। টলেমির ‘আল-মাজেস্ট’ জ্যোতির্বিজ্ঞানের অমূল্য গ্রন্থ। টলেমির পদ্ধতি ষােড়শ শতাব্দীতে কোপারনিকাসের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিগদিশারীরূপে পরিগণিত ছিল।

(১১) চিকিৎসা বিজ্ঞানঃ চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ ডিসকোরাইডস গাছ-গাছড়া ও এর ভেষজ প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। প্রাচীন চিকিৎসা বিজ্ঞান, শরীর ব্যবচ্ছেদ ও শল্যবিদ্যার যাবতীয় জ্ঞান গ্যালেন তার বিখ্যাত পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ করেন, যা আধুনিক যুগ পর্যন্ত অত্যুৎকৃষ্ট প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে আসছে।

(১২) ইতিহাস ও ভূগােলশাস্ত্রঃ ভূগােলশাস্ত্রের প্রথম পণ্ডিত হলেন হরপালুস। তিনি মৌসুমী বায়ুর সাময়িক গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করেন। বৈজ্ঞানিক ভূগােলের স্রষ্টা হলেন এরাটুসথিনিস। তিনি পৃথিবীর পরিধি সম্বন্ধে মূল্যবান গবেষণা চালান। তার অনুসারী স্টলে ছিলেন প্রখ্যাত ভূগােলশাস্ত্রবিদ। কিন্তু টলেমি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাচীন ভূগােল-জান্তা। তার গ্রন্থ ‘আল-মাজেস্ট’ প্রাচীন বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলংকার। হিরােডােটাস ছিলেন ইতিহাসের জনক। তার গ্রন্থ ভূগােল, নৃ-তত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের উপাদান মিশ্রিত প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস।

পরিশেষঃ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, দর্শন, ধর্ম ও সাহিত্য আলােচনার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিসে যে স্বর্ণযুগীয় সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার ক্রমবিকাশের মধ্যদিয়ে একদা স্তিমিত হয়েছিল। কিন্তু তার ধারা পৃথিবীতে উচ্ছেদ হয়নি। এই সভ্যতার ধারায় পরবর্তী রােমক সভ্যতা এবং ইউরােপীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটে। অদ্যাবধি গ্রিক দর্শনের দাপট সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে এবং খ্যাতির সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।