প্রশ্নঃ সংগঠনের নীতি কাকে বলে? সংগঠনে কি কি নীতি পরিলক্ষিত হয়? 

ভূমিকাঃ একটি সংগঠন কতুটুকু সুষ্ঠু তা নির্ভর করে কত সহজে এবং কিরূপে কর্মদক্ষতাসহকারে সে তার উদ্দেশ্য অর্জন করে তার উপর। উপযুক্ত সংগঠনের মাধ্যমে সরকার তার ঈপ্সিত আকাঙ্ক্ষা সার্থক উপায়ে অর্জন করতে পারে। সংগঠন ত্রুটিপূর্ণ হলে সরকার কিংবা প্রশাসক তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সংগঠনের কতকগুলো মৌল নীতি রয়েছে। সুষ্ঠু সংগঠন গড়ে তোলার স্বার্থে এ সকল নীতি মেনে চলা একান্ত আবশ্যক। তবে সংগঠনের এ নীতিগুলো সম্পর্কে সনাতন এবং নব্য সনাতন মতবাদের অনুসারীগণের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। কারণ সনাতন মতবাদের অনুসারীগণ প্রশাসনিক সংগঠনে নীতিমালার অস্তিত্বকে স্বীকার করে, আর নব্য সনাতন মতবাদের অনুসারীগণ সংগঠনের নীতিগুলোকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন।

সংগঠনের পরিচয়ঃ 

→ সংগঠন সম্পর্কে সনাতনপন্থী বা কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোন প্রশাসনিক সংগঠনের কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে। তাই নীতিগুলোর ভিত্তিতেই বৃহদাকার সংগঠন গঠিত হয়। তাই ইচ্ছে করলেই এ সকল নীতিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এ তত্ত্বের সমর্থক হচ্ছেন উইলোবী (Willoughby), এফ.ডব্লিউ. টেলর (F. W. Taylor), লুথার গুলিক (Luther Gulick), এল. আরউইক (L. Urwick) এবং জেমস ডি. মুনী ( James D. Mooney)। সংগঠনের নীতিসমূহের প্রকৃতি এবং সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে যদিও তাঁরা কোন মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন নি, তথাপি তারা এমন কতকগুলো নীতির কথা বলেছেন, যেগুলো প্রায় সকল সংগঠনেই পরিদৃষ্ট হয়।

→ অপরদিকে নব্য-সনাতন বা মানবিক সম্পর্ক মতবাদের সমর্থকগণ সংগঠনের এরূপ নীতিকে অস্বীকার করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মূলত সংগঠন একটি মানবিক সমস্যা এবং এ সমস্যাকে যান্ত্রিক বা কাঠামোগত নিয়মে বিশ্লেষণ করা যায় না। মেরী পারকার ফলেট (Mary Parker Fottlet), হেনরী ওয়ালেস (Henry Wallas), সি আই. বার্নার্ড (C. I. Barnard), সাইমন (Simon), রবার্ট ডাল (Robert Dahl) এরা হলেন সনাতন সংগঠন নীতির বিরোধী সমালোচকদের অন্তর্গত। হার্বাট সাইমন (Herbert Simon) প্রশাসনের নীতিগুলোকে ‘প্রবচন’ (Proverb) বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা তার মতে, “একটি নীতির বিপরীত আর একটি নীতির উপস্থিতি বিদ্যমান। যেমনঃ সংযুক্তিকরণ নীতির বিরুদ্ধে বিযুক্তিকরণ, কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে বিকেন্দ্রীকরণ এবং আদেশ-ঐক্যের বিপরীত কার্যগত নির্দেশনা।” সাইমন (Simon) বলেছেন, “প্রশাসনিক তত্ত্বমালার মধ্যে পরিলক্ষিত অধিকাংশ প্রস্তাবনাই আজ দুর্ভাগ্যবশত প্রবচন দোষে দুষ্ট। অধিকাংশ নীতিসূত্রের প্রায় প্রত্যেকটিতেই যে কেউ প্রশংসনীয় গ্রহণযোগ্য ও পরস্পর বিরোধী নীতি লক্ষ্য করতে পারেন। জোড়ায় জোড়ায় নীতিসূত্র নিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটি সূত্র সম্পূর্ণ বিপরীত প্রশাসনিক সুপারিশ উপস্থাপন করে। কোন তত্ত্বটি বেশি উপযুক্ত তা নির্দেশ করার মত তত্ত্বে কোন নির্দেশিকা নেই।” [Herbert Simon, The Proverbs of Administration, Public Administration Review-6.,1946.]

বস্তুত একথা সত্য যে, লোক প্রশাসনের নীতিসমূহ স্বতঃসিদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আইন নয়, যা সর্বদাই ও সকল ক্ষেত্রেই সত্য বলে প্রতিপন্ন হবে। সংগঠনের এ সকল নীতি সম্পর্কেও একই কথা সত্য। এগুলো স্বতঃসিদ্ধ নয় এবং এগুলো প্রশাসনিক বিষয়াদি দীর্ঘকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করারই ফলস্বরূপ। সংগঠনের এ সকল নীতি চূড়ান্তও নয় বা অনমনীয়ও নয়। এ সকল নীতি নমনীয় ও প্রত্যেক প্রয়োজনের সাথে এদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়ে যেতে পারে। এল. ডি. হোয়াইট (L. D. White)-এর ভাষায়, “Administrative principles suggest only working rules of conduct which wide experience seems to have validates.” অর্থাৎ প্রশাসনিক নীতিসমূহ কেবল কর্ম পরিচালন বিধি নির্দেশ করে ব্যাপক ও দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার নিরিখেই এগুলো পরীক্ষিত হয়েছে। দায়িত্বশীল প্রশাসকগণকে অবশ্যই এ সকল নীতি সম্পর্কে জানতে হয় এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে সে নীতিগুলো তাদেরকে প্রয়োগ করতে হয়। হেনরী ফেয়ল (Henry Fayol) লোক প্রশাসনের এ সকল নীতি সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন যে, সংগঠনের এসব নীতি “প্রমাণিত বলে দৃষ্ট স্বীকৃত নির্ভরযোগ্য সত্যমালা” (“acknowledged truths regarded as proven on which to rely.”)

প্রশাসন ও সংগঠনে বিভিন্ন প্রকারের নীতিঃ সংগঠনের নীতিগুলোকে যদিও নব্য সনাতনপন্থী লেখকগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু সনাতনপন্থী লেখকদের লেখনীতে এ সকল নীতি সাধারণভাবে কমবেশি পরিলক্ষিত হয়। সংগঠনে সাধারণত নিম্নবর্ণিত নীতিসমূহের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়—

১। পদসোপান নীতি;

২। নিয়ন্ত্রণ পরিধি;

৩। আদেশগত ঐক্য;

৪ । কর্তৃত্ব অৰ্পণ;

৫। একীভূতকরণ বনাম বিখণ্ডীকরণ নীতি;

৬। লাইন ও স্টাফ নীতি;

৭। সমন্বয় সাধন নীতি;

৮। নিয়ন্ত্রণ। 

[উল্লেখিত নীতিসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের ওয়েবসাইটে সার্চ দিন]

উপসংহারঃ যখন কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অধস্তন কর্তৃপক্ষের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তখন তিনি সে ক্ষমতাকে যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করে দেন। কেবল পদসোপানের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। সংগঠন ক্ষুদ্র হলে এতে কর্ম-নির্দিষ্টকরণ সহজসাধ্য এবং প্রত্যক্ষ রূপ ধারণ করে। পক্ষান্তরে, সংগঠনের আকার বৃহৎ হলে তাতে কর্ম-নির্দিষ্টকরণ অপেক্ষাকৃত জটিল ও পরোক্ষ হয়ে থাকে।