প্রবাদ ও প্রবচনের সম্পর্ক: প্রবাদের মধ্যে থাকে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর মানবিক আবেদন। সহজ প্রকাশভঙ্গি আর সরল ও সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় তা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। সাধারণভাবে প্রবাদের সমার্থক হিসেবে প্রবচন শব্দটিরও ব্যবহার ঘটে বাংলায়। প্রবচন শব্দের আক্ষরিক অর্থ প্রকৃষ্ট বচন বা সদালাপ। কঠোপনিষদে প্রবচন বিষয়ে বলা হয়েছে- “নায়মাত্ম প্রবচনেন লভ্যঃ”। প্রভাত কুমার মুখােপাধ্যায় অবশ্য প্রবাদ ও প্রবচনের পার্থক্য নির্ণয় করে বলেছেন যে, প্রবাদের মধ্যে একটি গল্পের ভাব আছে, কিন্তু প্রবচন ছাঁটা-কাটা কথা মাত্র, আনন্দ-দুঃখ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই তার সম্বল। কিন্তু বাংলায় বচন বিষয়টির বহুল প্রকাশ দেখা গেলেও (যেমন, ডাকের বচন, খনার বচন ইত্যাদি) প্রবচনের স্বতন্ত্র উপস্থিতি দেখা যায় না। প্রবাদের সঙ্গে সমার্থক এবং পরিপূরক হিসেবেই এর যা কিছু ব্যবহার ঘটে। আশুতােষ ভট্টাচার্যও এ বিষয়ে বলেছেন—“প্রকৃত কথা এই যে বাংলা ভাষায় স্বাধীনভাবে প্রবচন শব্দটির ব্যবহার নাই। কোন কোন সময় ইহা প্রবাদ শব্দটির সঙ্গে যুক্তভাবে বা সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয় মাত্র।” (বাংলা লােকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ)।
চারটি ভিন্ন বিষয়ের ভিত্তিতে চারটি প্রবাদের উদাহরণ নীচে দেওয়া হল-
-
সমাজ-বিষয়ক—‘তেলক কাটলেই বােষ্টম হয় না।’
-
দেবদেবী-বিষয়ক—‘রাখে হরি, মারে কে?’
-
প্রকৃতি-বিষয়ক—‘মেঘ না চাইতেই জল।’
-
মানবদেহ-বিষয়ক—‘কান টানলে মাথা আসে।’
বাংলা প্রবাদের গঠন: কতগুলি সূত্রের উপরে বাংলা প্রবাদের সংগঠন দাঁড়িয়ে আছে-
-
বাংলা প্রবাদ সৃষ্টিতে ‘চিহ্ন’ খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। যেমন- ‘সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে’, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না।’ হাঁচি, পৈতা ইত্যাদি এখানে চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
-
বাংলা প্রবাদ অনেক সময়েই সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট হয়েছে। যেমন- ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’, মরা হাতি লাখ টাকা’ ইত্যাদি।
-
প্রবাদে অনেক সময়েই কার্য-কারণ সম্পর্কের বিস্তার দেখা যায়। যেমন—‘পেটে খেলে পিঠে সয়’, ‘কান টানলে মাথা আসে’ ইত্যাদি।
-
প্রবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। যেমন- ‘মেয়ে বাঁচলে জামাইয়ের আদর’, ‘কনের ঘরের মাসি, বরের ঘরের পিসি’ ইত্যাদি।
-
প্রবাদের মধ্যে থাকে সাধারণীকরণের প্রবণতা। যেমন- ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’।
-
প্রবাদের মধ্যে দুটি বিষয়ের তুল্যমূল্য সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। যেমন—‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’, ‘যেমন বুনাে ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল’ ইত্যাদি
উপরের আলােচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে প্রতিটি প্রবাদই আসলে যুক্তিশৃঙ্খলার ফল।
বাংলা প্রবাদ এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি।
প্রকৃতিগত বৈচিত্র্য: কিছু বাংলা প্রবাদ আছে লৌকিক লােকের মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে তাদের সৃষ্টি এবং টিকে থাকা। এদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু কিছু প্রবাদ লৌকিকভাবে সৃষ্টি হলেও সামান্য পরিবর্তন করে সাহিত্যে তাদের ব্যবহার ঘটেছে।
উৎসগত বৈচিত্র্য: বাংলা শব্দভাণ্ডারে যেমন বেশ কিছু আগন্তুক শব্দ পাওয়া যায় তেমনি আগন্তুক প্রবাদও পাওয়া যায়। সংস্কৃত ‘কণ্টকেনৈব কণ্টকম্’ বাংলায় হয়েছে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তােলা’। অনেক হিন্দি প্রবাদও সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। যেমন ‘বাপ কা বেটা সিপাই কা ঘােড়া’, ‘মারি তাে গন্ডার লুঠি তাে ভাণ্ডার’ ইত্যাদি।
বিষয়গত বৈচিত্র্য: বাংলা প্রবাদের বিষয়গত বিস্তার অসামান্য। সেখানে দেবদেবী, ইতিহাস, মানবদেহ, পুরাণকে আশ্রয় করে যেমন প্রবাদ রচিত হয়েছে : তেমনই পরিবার জীবন, মানুষের আচার-আচরণ, পেশা, অসুখ ইত্যাদি নানাকিছুই প্রবাদের বিষয় হয়েছে।
লােকশিক্ষা: প্রবাদের মধ্য দিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার বা শিক্ষা দেওয়ার একটা পরােক্ষ প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যে-কোনাে পাত্রের হাতেই কন্যা সম্প্রদান করা যে উচিত নয়, প্রবাদ সেই শিক্ষা দিয়ে বলে—“আন্ন দেখে দেবে ঘি, পাত্র দেখে দেবে ঝি”।
লােকসমাজের সঙ্গে নিবিড় সংযােগই প্রবাদের প্রাণ। তাই একদিকে দেশের ভূপ্রকৃতি, অন্যদিকে সমাজের নানাস্তরের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কার, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির কাহিনি বাংলা প্রবাদে প্রকাশিত হয়েছে।
পশুপাখি ও ভূপ্রকৃতি: কুমির, বাঘ, শকুন, বিড়াল, কাক ইত্যাদি পশুপাখির কথা যেমন বাংলা প্রবাদে আছে তেমনই নদী, খাল, বিল নিয়ে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির একটি ছবিও বাংলা প্রবাদগুলিতে পাওয়া যায়। যেমন- ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’।
পেশা-পরিচয়: তাঁতি, বােষ্টম, বামুন, কৃষক, ফকির ইত্যাদি নানা পেশার মানুষের কথা প্রবাদে পাওয়া যায়। যেমন- ‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে/কাল হল এঁড়ে গােরু কিনে’।
স্বাস্থ্যবিধি: স্বাস্থ্যবিধির প্রকাশও ঘটেছে বাংলা প্রবাদগুলিতে। যেমন—‘সকালে শুয়ে সকালে উঠে, তার কড়ি না বৈদ্যে লুটে’।
আবহাওয়া: আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণাও প্রবাদে পাওয়া যায়। যেমন –‘পূর্ব আষাঢ় দখিনা বায়, সেই বৎসর বন্যা হয়’।
সমাজ-মনস্তত্ব: সামাজিক স্বার্থপরতার ছবি বাংলা প্রবাদে রয়েছে- ‘কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরােলে পাজি’।
আচরণবিধি: ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আচরণবিধির ইঙ্গিতও প্রবাদে দেওয়া হয়েছে। যেমন—‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’ কিংবা ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’ ইত্যাদি।
ছড়ার সংজ্ঞা দিয়ে লােকসাহিত্যে ছড়ার বিশিষ্টতা আলােচনা করাে।
বাংলায় ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলির বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে লেখাে।
বাংলা ‘ছেলেভুলানাে ছড়া’ গুলির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা জান লেখাে।
‘খেলার ছড়া’ গুলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।
ধাঁধা বলতে কী বােঝ? ধাঁধার সঙ্গে শিক্ষা ও উপদেশ প্রদানের বিষয়টি কীভাবে জড়িত বুঝিয়ে দাও।
ধাঁধায় বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে।
প্রবাদের সঙ্গে ধাঁধার পার্থক্য কোথায়?
প্রবাদের সংজ্ঞা দিয়ে এর সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।
লােককথার সংজ্ঞা দিয়ে বিভিন্ন প্রকার লােককথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
লােককথার অন্যতম শাখা রূপকথা সম্পর্কে আলােচনা করাে।
লােককথার অন্যতম শাখা ব্রতকথা বিষয়ে আলােচনা করাে।
Leave a comment