সূচনা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ভারতে শিল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে ভারতে শিল্প শ্রমিকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রতিষ্ঠিত ৫৬টি সুতাকলগুলিতে প্রায় ৪৫ হাজার এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ২০টি পাটকলগুলিতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করত। ভারতের শিল্প-শ্রমিকরা প্রথম থেকে পুঁজিপতি মালিক ও ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের শােষণের শিকার হয়। ক্ষুব্ধ এই শ্রমিকরা পরবর্তীকালে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।

[1] ভারতের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ শ্রমিক আন্দোলনে মদত জোগায়।

  • [i] ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে ঐক্যবােধ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি জাতিগত বিভেদ ভুলে গিয়ে ব্রিটিশবিরােধী সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়।

  • [ii] বালগঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা হােমরুল আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে।

  • [iii] জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের (১৯১৯ খ্রি.) ঘটনা শ্রমিক শ্রেণিকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ করে।

[2] রুশ বিপ্লবের প্রভাব: রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হয়। এই সাফল্য ভারতীয় শ্রমিকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে।

[3] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশি আন্দোলনের সময় ভারতে কারখানার সংখ্যা এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে শিল্পক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। ফলে ভারতের শিল্পকারখানাগুলি থেকে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয় এবং প্রচুর শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। বাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেয়। এরূপ নানা কারণে ভারতের শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

[4] অর্থনৈতিক দুরবস্থা: শ্রমিকদের মজুরি ছিল খুবই কম। আর্থিক অনটনের ফলে তাদের জীবন-জীবিকা চালানাে মুশকিল হত। এই সঙ্গে তাদের ওপর বিপুল পরিমাণ করের বােঝা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি ঘটনা শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তােলে।

[5] শােষণ: ভারতের শিল্পকারখানাগুলিতে শ্রমিকদের অবস্থা মােটেই ভালাে ছিল না। দরিদ্র শ্রমিক পরিবারগুলি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের ফলে তাদের রােগভােগ লেগেই থাকত। এরূপ সীমাহীন শােষণের ফলে শ্রমিকরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল।

[6] শ্রমিক সংগঠনগুলির ভূমিকা: ১৯১৮-১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। বি. পি. ওয়াদিয়ার নেতৃত্বে এবং সিঙ্গারাভেল্লু চেট্টিয়ার, রামনাজ্জলু নাইড়, ভি. কল্যাণসুন্দরম্ মুদালিয়ার-এর সহযােগিতায় প্রথম শ্রমিক সংগঠন মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন (১৯১৮ খ্রি.) গড়ে ওঠে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম বৃহত্তর শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে অন্তত ১২৫টি শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে। শ্রমিক সংগঠনগুলির ছত্রছায়ায় শ্রমিকরা তাদের আন্দোলনের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে সক্ষম হয়।

[7] কমিউনিস্টদের সহযােগিতা: শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা জীবনযাত্রার মানােয়ন্নন ও শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারে ভারতে কমিউনিস্ট দলগুলি যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনে হেমন্ত সরকার, পি. সি. যােশি, মিরাজকর, মুজাফফর আহমেদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেল্লু চেটিয়ার প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা বিশেষভাবে সহায়তা করে। শ্রমিক শ্রেণিকে কমিউনিস্টরা সাম্যবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত করে শ্রমিক আন্দোলনকে তীব্রতর করে তােলে।

উপসংহার: বােম্বাই, বাংলা, বিহার, মাদ্রাজ, আসাম প্রভৃতি প্রদেশে শ্রমিক আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে।