বৈষ্ণব মতে, রাধাকৃষ্ণের প্রেম আদিঅন্তহীন। এর উদয় বিলয় নেই। সেইজন্য এই প্রেমকে কোনও পর্ব বা পর্যায়ে বিভক্ত করে দেখা অর্থহীন। কিন্তু লীলার বৈচিত্র্য প্রকাশের দিক থেকে বিচার করেও পদগুলিকে পর্যায়বদ্ধ করা হয় প্রধানত খেতুরী মহোৎসবের সময় থেকে। বলা বাহুল্য কীৰ্ত্তনীয়ারাই, এই পর্যায় বিন্যাসের নির্দেশক। রাধাকৃষ্ণের সেই পর্যায়বদ্ধ লীলার সূচনা পূর্বরাগ থেকে। ‘উজ্জ্বল নীলমণি’তে পূর্বরাগের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এমন—

রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শন শ্রবণাদিজা। 

তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।”

অর্থাৎ, দেহমিলনের পূর্বে দর্শন, শ্রবণ প্রভৃতির দ্বারা নায়ক-নায়িকার চিত্তে যে রতি এবং উপভোগ রসের সৃষ্টি হয় তাকে বলে পূর্বরাগ। এই দর্শন নানা প্রকারের হতে পারে—চাক্ষুষ দর্শন, চিত্রপটে দর্শন, স্বপ্নে দর্শন ইত্যাদি। আর সখী প্রভৃতির মুখে বা সঙ্গীত ও বংশীধ্বনির মধ্য দিয়ে যে শ্রবণ তাও উৎপন্ন করে রতি ভাব।

বিদ্যাপতির অভিনব সৃষ্টি বয়ঃসন্ধির পদ, যার নেপথ্যে বৈব ভক্তিবাদের কোনো তত্ত্বাভাস নেই, কেবল নারীর উদ্ভিন্ন রূপসৌন্দযের উদ্ভাস আছে। যৌবনে উত্তরণের ফলে কিশোরী রাধার অঙ্গের কেমন করে পরিবর্তন ঘটে, এ সবের বর্ণনায় বিদ্যাপতির কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। কৃষ্ণকে দেখে রাধার কামনা অশান্ত হয়। ‘হেরি হরি না পুরল আশা’। রাধার পথ চলা সহচরী সমভিব্যহারে স্নান বিহার, স্নানোত্তীর্ণ কেশ প্রসাধন ও গৃহপ্রত্যাবর্তন। পদাবলীতে কৃষ্ণকে দেখে রাধার পূর্বরাগের এই ছবিগুলি উদ্ভাসিত হয়েছে। বিদ্যাপতির রাধা কৃষ্ণকে অবিরত দেখার লোভে সখীদের সঙ্গে ছলনা করে মুক্ত হার ছিন্ন করে ছড়িয়ে ফেলে মুক্তগুলি সংগ্রহে সখীদের বাধ্য করে, সেই অবসরে ‘শ্যাম দরশন ধনি লোলি’। কখনো স্নানোত্তীর্ণা রাধা কৃষ্ণের মুখোমুখী ‘অবনত আনন কত্র রহিলহু বারল লোচনলোর। এমনকি দেহ স্বেদে রাধার অঙ্গবসন বিপর্যস্ত “চানি চুনি ভত্র কাঁচলি ফাটালি বাহুক বলআ ভাগ।” এই আনন্দ-ঘন মুহূর্তের আস্বাদনের ভাষা এক মাত্র কবি বিদ্যাপতির জানা ছিল।

রাধা যেন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, বুঝতে পারলেন—“আওল যৌবন শৈশব গেল।” বালিকা মূর্তির অন্তরালে যৌবনের গন্ধমধু যে কীভাবে আবিষ্ট করেছিল তার যথার্থ স্বরূপ রাধাও বুঝতে পারেননি। কস্তুরী মৃগের মতো রাধা আপন নাভিগন্ধে উন্মনা হয়ে পড়লেন:

মনে মনে দশনে ছুটাছুট হাস।

মনে মনে অধরে আগে করু বাস।।

কবি শধু রাধার দেহের পরিবর্তনই আঁকেননি, তাঁর মনের বিচিত্র পরিবর্তনেরও সংবাদ দিয়েছেন। কিশোরী ও যুবতীর মনোভাবটি তিনি চমৎকার ফুটিয়েছেন—

‘চঞ্চল চরণ চিত চঞ্চল ভাণ। 

জাগল মনাসিহ মুদিত নয়ান।।

এই ভাবে বর্ণবিভ্রম সৃষ্টি করে কবি নব রাগিনী কিশোরী রাধার বিচিত্র চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন। রাধার এই জীবন দ্বন্দ্বের চিত্রটি সর্বাগ্রে কৃষ্ণের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। তিনিও দূর থেকে রাধার কৈশোর যৌবনের দ্বন্দ্ব উপভোগ করেছেন—

চঞ্চল লোচন বঙ্কে নিহার এ অঞ্জন শোভাপাত্র। 

জমি ইন্দিবর পবনে পেলল, অলিভরে উলটায় ৷৷

বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা দিয়েছেন তা অন্য কোনও কবির কাব্যে পাওয়া যায় না। বিদ্যাপতির অধিকাংশ পদে যে বৈদগ্ধ্য, যে চাতুর্য, যে ছলাকলার বিস্তার, যে মনস্তাত্ত্বিকতা দেখা যায় তা তাঁর রাধাকে এক অনন্য রসমূর্তি দিয়েছে। যেমন তিনি একটি পদে লিখেছেন—

“নহাই উঠল তীরে রাই কমলমুখী 

সম্মুখে হেরল বর কান।”

সদ্য স্নান করে সিক্ত বসন দ্বারা আবৃত নিজ শরীরকে দেখে রাধা নিজেই মুগ্ধ বিবশ। কারণ তার মনে পড়ে গেছে মাধব’ মধুর কথা বলেন, তাই শুনে তিনি কান দুটিকে ঢাকা দিয়েছিলেন। সেই অল্প সময়েই কামদেব তাঁর পঞ্চবাণে রাধাকে বিদ্ধ করেছিলেন। ফলে—

“তনু পসেদে পসাহনি ভাসালি

পুলক হু তেমন জাগু।”

এবং চুন চুন করে তাঁর কাঁচুলি ছিঁড়ে গেল, আর ভেঙে গেল বাহুবলয়। বিদ্যাপতি প্রত্যক্ষ করেছেন— 

“কম্পিত কর হো বোলল বোল না যায়।”

এখানেই রাধার শেষ নয়, কৃষ্ণকে ভরিয়ে রাখতে রাধা এবার কৃষ্ণময় আপন রূপের প্রতি দৃকপাত করলেন—

“হাথক দরপণ মাথক ফুল। 

নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।

এত সাজসজ্জার পরও তিনি কি করলেন—

হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার

দেহক সরবন গেহক সার ॥

ধাপে ধাপে কল্পের জন্য নিজেকে রাধা এমন ভাবে তৈরি করেও কৃষ্ণকে- “এত করে জেনেও তোমার রহস্যের শেষ দেখতে পাইনা।”

সর্বোপরি, একথা বলতে হয়, মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে কবি বিদ্যাপতি রাধার মনস্তত্ত্বকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। তিনি জানাতে ভোলেননি—রাধা এবং কৃষ্ণ দুজন দুজনের মতো, যাঁকে নিয়ে রাধার প্রেম, তিনি যেমন অসীম রহস্যময় তেমনি রাধার যে প্রেম কৃষ্ণ চায়, সেই প্রেমের রহস্যও অসীম, অর্থাৎ— “ভগবান যেমন অসীম, ভক্তের প্রেমও তেমনি অসীম। একটি অন্যটির চেয়ে কম নয়, কিন্তু শুধু প্রেমিক প্রেমিকার চির অতৃপ্তিময় প্রেমানুভূতির দিক থেকে দেখলেও এই নিত্য নবায়মান প্রেমের মাধুর্য কিছুমাত্র কমে না। এই কথাটি বিদ্যাপতির পদ সম্পর্কে অধিক সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। কারণ রাধাকৃষ্ণের পদরচনার ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি মূলত ভক্ত কবি নন, তিনি সৌন্দর্য্যের রহস্য সন্ধানী মাধুর্যের কবি। কাজেই অনুরাগময় একটি সংহত বিচ্ছুরিত রূপ তাঁর পূর্বরাগের পদে দৃষ্ট হয়।