দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়কালের নিদারুণ অপচয় থেকে উঠে আসা এক নায়কের নাম শশী। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র শশীডাক্তার। উপন্যাসে অদ্ভুত ভূমিকা তার। ডাক্তার হিসাবে যার লড়াই-ক্রমাগত মৃত্যুর বিরুদ্ধে। আর শশীর নিজের গ্রাম গাওদিয়ার মানুষজনের বিশ্বাস—“সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক। চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছে”। অর্থাৎ গোটা গ্রামই আত্মসমর্পণ করে আছে সংস্কারের কাছে, অবিদ্যার কাছে, অদৃষ্ট বা নিয়তির কাছে। সুতুরাং শশীর লড়াই শুধুমাত্র শরীরের রোগের বিরুদ্ধে নয়। আর নয় বলেই সে বলে—“তাকে একবার হাতে পেলে দেখে নিতাম”। সুতরাং শশী ডাক্তার হয়ে গ্রামে আসার অর্থ কুসংস্কারে মৃত গ্রামটিকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার মাধ্যমে নতুন করে প্রাণদান। অথচ ভেতরে ভেতরে তুষের আগুনের মতো ধিক ধিক করে জ্বলছিল—“জীবনকে বৃহত্তর ব্যাপ্তি দেবার পিপাসা”। এবং সে প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি—“গ্রামে বসিয়া এই আত্ম-বিরোধময় সংকীর্ণ জীবনযাপন করিতে হইবে” ; যেমনটা ঘটেছিল ‘পল্লিসমাজ’ উপন্যাসের রমেশের ক্ষেত্রেও। গ্রাম্য কোন্দল, নীচতা, সংস্কার ইত্যাদির দ্বারা নিজের কাছেও যে একদিন হার মানতে শুরু করেছিল যার জন্য সে বিশ্বেশ্বরীর কাছে গিয়ে দৃঢ়ভাবে বলেছিল—“এখানে আমি আর এক দণ্ড টিকতে পাচ্ছিনে”। বিশ্বেশ্বরী রমেশের বেদনার উৎস মূলটা বুঝেছিলেন। তাই তাকে বলেছেন—
“তোরেই এখানে থাকা সবচেয়ে দরকার। রাগ করে যে
জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিস রমেশ, বল দেখি তোর
রাগের যোগ্য লোক এখানে আছে কে? আহা, এরা যে
কত দুঃখী, কত দুর্বল…………তোর মত বাইরে থেকে যারা
বড় হতে পেরেছে, তারা যদি তোর মতই গ্রামে ফিরে
আসত, সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চলে না যেত, পল্লিগ্রামের
এমন দুরবস্থা হতে পারত না”।
যে রমেশ মনে করেছিল—“এদের মঙ্গলের চেষ্টা করা শুধু পণ্ডশ্রম”—সেই রমেশ গ্রামে থেকে গেল। হয়ে গেল ক্রমে ক্রমে গ্রামের সক্রিয় কর্মী। গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খুলে দিয়েছে শিক্ষার দরজা। আর যে শশী মনে করেছিল—“জোর করিয়া না গেলে সে কোনোদিন এই সংকীর্ণ আবেষ্টনী হইতে মুক্তি পাইবে না” সেই একদিন যাদব পণ্ডিত প্রদত্ত দানের টাকায় গ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে। সুতরাং যে গ্রাম ছেড়ে সে চলে যেতে চেয়েছিল সেই সবথেকে বড়কর্মী হয়ে গেল। সে গ্রাম কেমন ? গাওদিয়ার গ্রামীণ জীবনের চালচিত্রই এখন আলোচনার মুখ্য বিষয়।
আলোচ্য উপন্যাসে গাওদিয়ার গ্রাম জীবনের সংকীর্ণ চৌহদ্দির মধ্যে মলিন প্রাত্যহিক জীবনচর্চার প্রণালী, অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত, গেঁয়ো পুকুরের ঢেউ” ও মানুষের হঁকে বাঁধা জীবনের ইতিকথার আলোকেই শশীর দ্বন্দ্বসংঘাত ও শেষ পর্যন্ত নির্বেদে পৌঁছানোর ইতিহাস বর্ণনা করেছেন লেখক।
উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র মানুষ। সেই মানুষের যেমন ব্যক্তি পরিচয় আছে তেমনি তার সামাজিক পরিচয়ও আছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই গ্রামীণ সামাজিক পরিবেশ এ উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর প্রবাহমান জীবনধারার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে তাদের ভালোমন্দ সংস্কার। বিশ্বাস প্রভৃতির পরোক্ষ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। মোটকথা শশীর অস্তিত্বের সংকট, নিঃসয়তা ক্লান্তিবোধের মূলে হয়েছে গ্রামজীবনের জট।
শশীর অস্তিত্বের সংকটের মূল কারণ গ্রাম ও শহরের মাঝামাঝি মানসিক অবস্থান। জন্ম তার গাওদিয়া গ্রামে। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য শহরে যায়। সেই গ্রামীণ চরিত্র কয়েক বছর কলকাতায় থেকে ডাক্তারি পড়ার পর ফিরে আসে গ্রামে। আর গ্রামে ফেরার পর থেকেই শুরু হয়েছে শশীর মনে জন্মসূত্রে পাওয়া গ্রাম্যতা ও শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত নাগরিকতার দ্বন্দ্ব। সংকীর্ণ হৃদয়, ভোঁতা চিন্তা শক্তি এক স্থূল রস রোধ যুক্ত শশীর কল্পনার জগতকে প্রসারিত করল নাগরিক জীবনের বৈচিত্র্য। মূলত তাকে করে তুলল পলায়ন প্রত্যাশী। স্বপ্নহীন, আদর্শহীন গাওদিয়ার জীবনকে স্বপ্নদর্শী শশী তা যখন গড়তে চাইল তখন সে নিজের সাথে নিজের যুদ্ধেই ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। গাওদিয়া প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ মহাজন গোপালের জগৎ—“অশিক্ষিত নর-নারী, ডোবা পুকুর বন, জঙ্গল মাঠ, বাকি জীবনকে তাহাকে এইখানেই কাটাইতে হইবে”—এই রকম ভাবনায়—“প্রথমে সে যেন হাঁপাইয়া উঠিল। জীবনটা কলিকাতায় যেন বন্ধুর বিবাহের বাজানার মতো বাজিতেছিল, সহসা স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে”।……. গোপালের সম্মান মানসগন্ডি, সামন্ততান্ত্রিক পারিবারিক সামাজিক বিন্যাসের বিচিত্র অভিপ্রায়, যেমন সম্পত্তি মালিকানা প্রভুত্ববোধ উত্তরাধিকারের দায় নিয়ে শশীর জীবনকে আরও দায়বদ্ধ করে তুলে। কিন্তু কলকাতা ফেরত স্বপ্নবিলাসী, যুক্তিবিজ্ঞান চেতনায় বলিষ্ঠ শশী গ্রামজীবনের প্রশ্নহীন অন্ধ আধিভৌতিক, আধিদৈবিক সংস্কারাচ্ছন্ন মাসিকতাকে মেনে নিতে পারে না বলেই “গ্রামজীবনে শশীর বিতৃষ্ণা আসিয়াছে”।
শশীডাক্তার বলে সকলশ্রেণির মানুষেরই প্রয়োজনভিত্তিক সম্পর্কও আছে। আর এইজন্য সর্বস্তরের মানুষের শ্রেণি পরিচয়ও বিন্যস্ত। একদিকে যেমন আছেন শশীর বাবা কুসীদজীবী মহাজন গোপাল দাস—যাদব পণ্ডিত কবিরাজ যামিনীর মতো উচ্চবিত্তের গ্রামীণ মানুষ তেমনি আছে কায়েত শ্ৰীনাথ মুদি বাগদী, সদগোপ ইত্যাদি নিম্নবিত্তের মানুষ জন। আছে কৃষিভিত্তিক পদাধিকারীর শ্রেণিবিন্যাস—যেমন জমিদার শীতলবাবু তার ভাই বিমল বাবু। অন্যদিকে চাষি মুনিব সকলেরই প্রসঙ্গ আছে, আছে শশীর সঙ্গে সম্পর্কের নানা ধারা। আছে এদের কর্মবিভাজনের উল্লেখ—কায়েত পাড়া গোয়াল পাড়ার পাশাপাশি সতিঘর বাগদী আছে। মৃত হারু ঘোষের ছেলে পরাণ চাষবাস করে। চণ্ডীর মার ছেলে ঘাটের পাটচালার ধারে পথচারির জন্য পানবিড়ি সাজিয়ে বসে থাকে। নবীন দিনরাত সেই পুলের তলায় মাছ ধরার কঠোর সংগ্রামে ব্যস্ত। গাওদিয়ার যে ভৌগোলিক পরিচয় পাওয়া যায় তাতে গ্রামে যেতে পুল পার হতে হয়। কলাবাগান সুপারিবাগানে ঘেরা সম্পন্ন মানুষের বসতি। সেখানে থেকে ভেসে আসে কামিনী, জবা, গন্ধরাজের সুবাস, গ্রামে ঢোকার পথ চওড়া হলেও কাঁচা। বর্ষীয় রাস্তায় হাঁটু কাদা হয়, শীত এলে শুকোয়।
এই পরিবেশে গ্রামীণ জীবন যাপনের সঙ্গে শশী সম্পৃক্ত হয়ে ক্রমে গ্রামের পরম আত্মীয় হয়ে ওঠে। আর এটাই তার অস্তিত্বের সংকট। নানা সম্পর্কের অভিঘাত দ্বিধান্বিত শশীর জন্ম দিয়েছে। গ্রামকে শশী মেনে নিলেও বন্ধু পত্নী কুসুমের অকপট কামনার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি, শিক্ষিতের কুণ্ঠা তাকে সামাজিক দোলাচলে ফেলে দিয়েছে।
উভয়ে তালবনকে মুক্তির স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছে। আবার কখনো কুসুম অভিসারিকা হয়ে শশীর ঘরের পিছনের জানালায় ছুটে এসেছে। শশী অবৈধ প্রেমে লিপ্ত হয়েও সংযত আসক্তির সীমানায় বন্দি থেকেছে গ্রাম সমাজের সামনে।
আবার গ্রামীণ মানুষের কাছে শ্রদ্ধা ভক্তি লোভে স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘোষিত দিনকে বাস্তবতাদানের জন্য আফিং খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর পাগলদিদি সেই সঙ্গে অন্নসৃতা হয়ে সাধারণ মানুষের অন্ধ ভক্তির জগতে সিদ্ধারমণীতে পরিণত হন।
অন্যদিকে আছে গোপনে সেনদিদি সম্পর্ক যা গ্রামীণ কলঙ্ক আর লোকনিন্দার একশেষ। সেনদিদির স্বামী যামিনী কবিরাজ যেমন ক্ষেপে ওঠে তেমনি গোপালের জীবন সুখকর থাকে না। আর শশীর নিজের বোন বিন্দু বীভৎস কীর্তির জন্য জনমানসের যে কানাকানি তা গ্রাম্যলোকের কৌতুহলের অন্যতম বিষয়।—“গ্রাম হইতে গ্রামে রটনা হইতেছে এজন্য শশী নিজেকে অপরাধী মনে করে।” যামিনী কবিরাজের আত্মহনন, এবং বিন্দুর ব্যভিচারী আচরণ শশীর সামাজিক জীবনে অন্যতম প্রশ্ন হয়ে ওঠে। যার কারণে গোপাল সেনদিদির শিশুসন্তানকে নিয়ে কাশী চলে যেতে বাধ্য হয়।
এইসব গ্রাম্য মানুষজন শশীর চোখে—
-‘ওরা প্রত্যেকে রুগ্ন অনুভূতির আড়ৎ সংকীর্ণ সীমার মধ্যে ওদের
মনের বিস্ময়কর ভাঙাগড়া চলে, পৃথিবীতে ওরা অস্বাস্থ্যকর
জলাভূমিতে কবিতা ; ভাপসা গন্ধ আবছা কুয়াশা, শ্যামল শৈবাল
বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা, কলমি ফুল। সতেজ উত্তপ্ত জীবন ওদের
সহিবে না ।”…….রোগে ভুগিয়া অকারণে মরিয়া ওরা
বড় আনন্দে থাকে….. এই স্থিতাবস্থাই হল গাওদিয়া গ্রামের চরম অভিশাপ।”
এসব দেখেই গ্রাম ছেড়ে নূতন জগতের নূতন করে জীবন আরম্ভ করবার কল্পনা শশীর মনে জোরালো হয়ে আসে। পাশাপাশি শহর কলকাতায় কল্পনা আছে বলেই গ্রামীণ জীবনের ছবি এত জীবন্ত। গ্রামের সচল নিবিড় ভাবে জড়িত গোপাল, বাসুদেব বাড়ুয্যে কুসুম ও তার পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেও যেতে পারে না শশী। গোপালের বাজীজীবনের মন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়—“গাঁয়ে আর ডাক্তার নেই, অচিকিচ্ছেয় মরে গাঁয়ের লোক, সেটাও তো দেখতে হবে ?” আর কুসুমের সপ্রেম সজীব আকর্ষণের মুহূর্তে ভেবেছে–“একদিন কেয়ারি করা ফুলবাগানের মাঝখানে বসানো লাল টাইলে ছাওয়া বাংলোয় শশী খাঁচার মধ্যে কেনারি পাখির নাচ দেখিবে। দামি ব্লাউজ ঢাকা বুকখানা শশীয় বুকের কাছে স্পন্দিত হইবে।” আর যে—“রমণীর গায়ে ব্লাউজ নাই, নাই সুগন্ধি তেল, তার জন্য বিবর্ণ মুখে এত কষ্ট পাইতে নাই। ওর আবেগ তো গেঁয়ো পুকুরের ঢেউ”। শশীর সেই পরিশীলিত মনও শেষ পর্যন্ত নিয়ত যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েও গাওদিয়ার গ্রামের গাছপালা, বাড়িঘর, ডোবাপুকুর, সংস্কারে ভক্তিতে জড়িয়ে থাকা মানুষজন সবই তাকে এক মায়াবী আকর্ষণে জড়িয়ে রাখে ৷
Leave a comment