মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাখ্যাতা। তিনি জীবনের গভীরে অবগাহন করে জীবনসত্যকে তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানমনস্কতার ফলেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীতে এসেছে আধুনিকতা। এই আধুনিকতার পরিচয় শশী চরিত্র-ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল এক সত্য। রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ বা ধূর্জটিপ্রসাদের ‘অন্তঃশীলা’ ব্যক্তির গহন জটিলতার কাহিনী। উপন্যাস বলতে বোঝায় ব্যক্তি-চরিত্রের দ্বন্দ্বজটিলতাময় কাহিনী। এইখানেই উপন্যাসের আধুনিকতা।

একজন সমালোচক বলেছেন, আধুনিকতার নানা স্বরূপলক্ষণ যে—‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র আগেই বাংলা উপন্যাসে আত্মপ্রকাশ করেছে, রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘অন্তঃশীলা’র (১৯৩৫) স্রষ্টা ধূর্জটিপ্রসাদ পর্যন্ত লেখকের রচনায় তার সাক্ষ্য হিসাবে। বাংলা উপন্যাসের আধুনিক জটিল জীবন-জিজ্ঞাসার সেই বহমান ধারায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এক গূঢ় তরঙ্গবেগ সঞ্চার করেছে। আর জীবনে সেই গভীরস্বরূপ সন্ধানের অনন্যতায় উপন্যাসটি এই অর্থে মহৎ উপন্যাসের দুর্লভ মহিমাকেও যেন স্পর্শ করেছে। বস্তুত তিরিশের দশকের এই উপন্যাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের আধুনিকতার প্রত্যাশিত মৌলিক লক্ষণগুলি নিহিত থাকলেও পাঠকমনে এর সংবেদন কিন্তু গভীরতর এক বোধের দিকে। শেষ পর্যন্ত আধুনিকতা-অনাধুনিকতার সীমিত লক্ষণ পার হয়ে জীবনের গভীরতর উপলব্ধির আভাস এনে দেয় উপন্যাসটি। আপন অস্তিত্বকে ঘিরে ব্যক্তির যে যন্ত্রণা ও সংকট, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুকে মিলিয়ে সবার অনিঃশেষ জিজ্ঞাসা, আধুনিক ব্যক্তিমানুষের চেতনার দর্পণে জীবনরহস্যের সেই চিরায়ত অনুভবগুলি এক অভিনব শিল্পরূপ পেয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে। উপন্যাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তিসত্তার এক অপরূপ ওডিসি জটিল অথচ গভীর চেতনলোকের আলোছায়ার ব্যক্তিমানুষের পথ চলার এক আশ্চর্য ইতিকথা।”—এই বর্ণনা উপন্যাসে আধুনিকতার লক্ষণ সম্পর্কে অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

ব্যক্তির চেতনলোকের আলোছায়া ব্যক্তিসত্তার অপরূপ ওডিসি আধুনিক উপন্যাসের প্রধান লক্ষণ। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে শশী চরিত্র এই ব্যক্তিসত্তার জটিল ওডিসির পরিচায়ক চরিত্র। শশী গ্রামের মানুষ, কিন্তু সে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গিয়ে যে শহুরে আবহাওয়ায় বিকশিত হয়েছে, তার ফলে তার মনে শহর ও গ্রামের এক দ্বন্দ্বময়তা দেখা দিয়েছে। গাওদিয়া গ্রামের মানুষদের সঙ্গে তার আবাল্য পরিচয়। এই পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে যে মমতা, যে হৃদয়-সংরাগ জেগে উঠেছে, তা পরাণদের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মতির চিকিৎসা করতে গিয়ে তার অন্তরে । অদম্য স্নেহ ও পরোপচিকীর্ষা জাগে, তা তাে হৃদয়বান মানুষ হিসেবে উজ্জ্বল করে দেখায়। কিন্তু এই পরাণদের বাড়িতে কুসুমের মুগ্ধ ও লুব্ধ দৃষ্টির সামনে তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত হয়। সে কুসুমের প্রেমাস্পদ হয়ে ওঠে। কুসুম তার সান্নিধ্যের জন্য চাঞ্চল্য অনুভব করে, তালপুকুরের ধারে শশীকে ডেকে নিয়ে আসে। তারা পরস্পরের সান্নিধ্যসুখ উপভোগ করে। লেখক-কৃত শশী চরিত্র বিশ্লেষণ অনুযায়ী আমরা জানতে পারি—–“শশীর চরিত্রে দুটি সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তাহার মধ্যে যেমন কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নাই, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মমতাও তাদের যথেষ্ট। তাহার কল্পনাময় অংশটুকু গোপন ও মুক। অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে তাহার সঙ্গে না মিশিলে একথা কেহ টের পাইবে না যে তার ভিতরেও জীবনের সৌন্দর্য ও শ্রীহীনতায় একটা গভীর সহানুভূতি মূলক বিচার পদ্ধতি আছে। তাহার বুদ্ধি, সংযম ও হিসাবি প্রকৃতির পরিচয়ই মানুষ সাধারণত পায়। সংসারে টিকিবার জন্য দরকারি এই গুণাবলির জন্য শশীকে সকলে ভয় ও খাতির করিয়া চলে।” এইভাবে চরিত্রবিশ্লেষণ করে লেখক ব্যক্তিচরিত্রের বিভাগ সৃষ্টি করেছেন। ব্যক্তিত্বের এই দুই দিকের সঙ্গে আছে নানা স্তরের সবার বিরোধমূলক অবস্থান। এই জটিলতার কেন্দ্র শশী-চরিত্র। শশী চরিত্র এই ব্যক্তি-সংঘাতময় অন্তর্জটিলতার কাহিনী। আধুনিকতা একটা দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গী উপন্যাসের জীবনবীক্ষায় প্রতিফলিত হয়।

উপন্যাসে আধুনিক লক্ষণ বলতে বোঝায় (১) চরিত্রের অন্তরহস্য আবিষ্কার, (২) তার মনের গহনে আলোক প্রবেশ— The task of the novelist is to discover this reality, (৩) এই বাস্তবতা থাকলে অন্তর্বাস্তবতা— বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় ‘অন্তর্বিষয় প্রকটনে যত্নবান হওয়ার প্রমাণ, (৪) প্রকরণগত ক্ষেত্রে প্রতীকের ব্যবহার। এই সব লক্ষণ ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে।

শশী একদিকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। অন্যদিকে তার বিজ্ঞানমনস্ক মনে হারুর মৃত্যুরহস্য, ভূতরহস্য, যাদবের সূর্যবিজ্ঞানের প্রবল ঘোষণার মধ্যে মানসস্বীকৃতি—“বিশ্বাস হয় না তবু শশীর মনের আড়ালে লুকানো গ্রাম্য কুসংস্কার নাড়া খাইয়াছে। এক এক সময় তাহার মনে হয়, হয়তো আছে, বাঁধা যুক্তির অতিরিক্ত কিছু আছে জগতে। মাধব আর যাদবের মত মানুষেরা যার সন্ধান রাখেন। দলে দলে লোক আসিয়া যে যাদবের পায়ে লুটাইয়া পড়িতেছে, এদের সকলের বিশ্বাস কি মিথ্যা? যাদবের জীবনে আচরণে লৌকিক আচরণে অলৌকিকের যে মাহাত্ম্য পরিস্ফুট হয়েছে, তাতে শশীর মত যুক্তিবাদী। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকেও নাড়া দিয়েছে। শশী চরিত্রের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব লেখক নানাভাবে প্রকাশ করেছেন।

শশীর জীবনে পরকীয়া প্রেমের দ্বন্দ্বকে লেখক আলোছায়ার মধ্যে রেখে প্রকাশ করেছেন। শশী-কুসুমের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে লেখক আধুনিকতার মন্ডনকলায় প্রকাশ করেছেন। গাওদিয়া গ্রামে শশী ডাক্তারের সামাজিক পরিচয় যথেষ্ট বিস্তৃত। শশীর ব্যক্তিত্বে এই সামাজিক সত্তার সঙ্গে তার অহং-সত্তার একটা দ্বন্দ্ব আছে। তাই যখন সে নিজের মনকে বুঝতে পারল, তখন তার মধ্যে একটা আত্মসমীক্ষাগত পরিবর্তন এল। আর এই বোধ পরিবর্তনের সময় তার প্রেমাস্পদকে সে হারিয়ে ফেলল। এই ট্র্যাজেডি শশীর জীবনে যেভাবে নেমে আসে, তাকে লেখক আধুনিক রীতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে–“নিজের মন কি মানুষ সব সময় বুঝতে পারে বৌ? অনেকদিন অবহেলা করে কষ্ট দিয়েছি বলে আজ রাগ করে তার শোধ নিতে চলেছ। এমন তো হতে পারে আমি না বুঝে তোমায় কষ্ট দিয়েছি। তোমার পরে কতটা মায়া পড়েছে জানতে পারি নি।” শশী আবিষ্কার করে, “এক একটা ঘটনা চাবির মত মনের এক একটা দুয়ার খুলিয়া দেয়। যে দুয়ার ছিল বলিয়াও মানুষ জানিত না।” শশীর বিবর্তনে এই আত্ম-আবিষ্কার তার মনের ক্রম-পরিণতির স্বাক্ষরবাহী। শশী চরিত্রের বিবর্তনের মধ্যে এই আত্ম-আবিষ্কার প্রাধান্য পেয়েছে। এইখানেই লেখকের অস্তিত্বগত ব্যাখ্যা যা তাঁকে আধুনিক ঔপন্যাসিকে পরিণত করেছে।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে নানা ‘episode’। নানা ‘episode’-এ নানা বৃত্তের মধ্যে দিয়ে চরিত্রমালায় মানবজীবনের এই সংকটগত কাহিনীই রূপ গ্রহণ করেছে। জীবন তার পূর্ণ প্রকাশে ও কর্মশক্তিতে এগিয়ে চলে। তার পশ্চাতে সক্রিয় হয় অদৃশ্য শক্তি। শশী এই উপন্যাসের নায়ক। বিন্দুর ট্র্যাজেডি, মতির স্বপ্ন, কুসুমের প্রণয়স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অন্তরালে অদৃশ্য শক্তির লীলাই সক্রিয় হয়েছে—“পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞে মানুষ যেন শুধু পুতুল। কোন অদৃশ্য হাতের সুতোর টানাপোড়েনে মানুষ নাচে, কাঁদে, কথা বলে। নদীর মত নিজের খুশিতে গড়াপথে তার জীবনের স্রোত বয়ে চলে না। মানুষের হাতে-কাটা খালে তার গতি।”

মানুষ এই উপন্যাসে পুতুলের সঙ্গে উপমিত। “পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যেন শুধু পুতুল।” বিন্দু-নন্দলাল, মতি-কুমুদ, জয়া-বনবিহারী, শশী-কুসুম সকলেই এক একটি পুতুল ঘটনাস্রোতে তরঙ্গায়িত হতে হতে শেষ পর্যন্ত সেখানে এসে উপনীত হয়, তা অচিন্তনীয়। শুরু ও শেষের এই পরিণামগত পার্থক্য মানবজীবনের ট্র্যাজেডি। মানুষের জীবনের বিস্ময়কর এই দিকই অস্তিত্বের চিররহস্য। শশী-কুসুমের সম্পর্ক উপন্যাসের প্রধান বিষয় কেন্দ্র। শশীর জীবনের পরিবর্তন ও জটিলতার মধ্যে দিয়েই উপন্যাসের পরিণতি। যে কুসুম তাকে বলেছে–“এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।” এই আকাঙ্ক্ষার শেষ পর্যন্ত সমাধি ঘটে। শশীর ব্যক্তিত্বের ‘serial ego’ কুসুমের হাস্য-লাস্যের জগৎ থেকে সরে গিয়ে বহুদুরে ব্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঘটনার বিপ্রতীপ বিপরীত রূপ দেখা দেয়—”আমার সঙ্গে চলে যাবে বৌ”। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে কোন এক অদৃশ্য ‘গুতুলওয়ালা’কে। শশীর সমস্ত চেষ্টার ঊর্ধ্বে এক অদৃশ্য শক্তি এসে তাকে পথভ্রষ্ট করেছে। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন, তার পরোপকার বৃত্তি দেখে মনে হয়—“একটা অদৃশ্য দুর্বার শক্তি যেন অহরহ তার বিরুদ্ধে কাজ করিতেছে।” এই ‘অদৃশ্যশক্তি’-ই এই উপন্যাসের ‘পুতুলওয়ালা’। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র বিপর্যস্ত জীবনে মানুষ যেন অসহায় পুতুল, অন্তরালবর্তী অদৃশ্য শক্তি সেই ‘পুতুলওয়ালা’ যাদের হাত থেকে কারও স্বাধীন পথে চলার উপায় নেই। জীবনে অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে কিভাবে মানুষ যান্ত্রিক হয়ে যায়, কিভাবে তার স্বাধীন স্বপ্ন ব্যর্থ হয়। তার করুণ কাহিনী বিন্দু-নন্দলাল, মতি-কুমুদ, এবং শশী-কুসুমের আখ্যানে পরিস্ফুট হয়েছে।