‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় গোপাল এমনই এক বিশিষ্ট চরিত্র যে আদ্যন্ত উপন্যাসের মধ্যে থেকে উপন্যাসে তার ব্যক্তিত্বের প্রভাকে বিকীর্ণ করেছে। গোপাল দাস শশীর পিতা। শশী চরিত্রের ওপর তার প্রভাব আছে যথেষ্ট। গোপাল দাস দালালি ও মহাজনি কারবার করে জীবিকা নির্বাহ করত। এ ব্যাপারে তার সুনাম অপেক্ষা দুর্নাম ছিল বেশি। জনশ্রুতি আছে, সে নাকি বার তিনেক মানুষ কেনাবেচার দালালি করেছে। ব্যাপারটা হল সে তিনটি বৃদ্ধের পত্নী সংগ্রহ করে দিয়েছে। যাদের জন্য সে বৌ সংগ্রহ করে এনে দিয়েছে তারা সব ইতিহাসের অতলে লীন। শুধু সাক্ষ্য হিসেবে বেঁচে আছে যামিনী কবিরাজের স্ত্রী সেনদিদি। সেনদিদির ইতিহাসের সঙ্গে গোপাল তাই সুনাম-দুর্নাম নিয়ে জড়িয়ে আছে। সেনদিদির কলঙ্কের দুর্নাম গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। শশীকে সেনদিদি স্নেহ করে। যামিনী গোপালকে অভিশাপ দেয়। যামিনী বলে এককাঁড়ি টাকা নিয়ে গোপাল তার যে উপকার করেছে, তাতে সে যেন উচ্ছন্নে যায়। তুচ্ছ কিছু টাকার জন্য গোপাল প্রতিমার মতো সুন্দরীকে বুড়ো, পাগলাটে যামিনী কবিরাজের বৌ করে তুলেছিল। তার নীতিবোধ যে কতখানি কলঙ্কিত এই সব ঘটনা তার সাক্ষ্য। গোপাল নীতিবোধের দিক থেকে শ্রদ্ধেয় চরিত্র নয়। সংসারে গোপালের একমাত্র ছেলে শশী আর তিন মেয়ে। বড় মেয়ের নাম বিন্ধ্যবাসিনী, খোঁড়া মোহনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। মেজমেয়ে বিন্দুবাসিনীর বিয়ে হয়েছিল নাটকীয় ভাবে। কলকাতার নন্দলালের সঙ্গে। নন্দলাল এন্ড কোং-এর নন্দলাল। এই বিয়ে গোপালের জীবনের এক স্মরণীয় কীর্তি। পাট সংগ্রহ করতে এসে নন্দলাল হঠাৎ গাওদিয়া গ্রামে এসে পড়েছিল। গোপাল লুব্ধ হয়ে তাকে ডেকে এনে নিজের বাড়িতে আদরযত্ন করেছিল। নন্দলালকে ঘরে স্থান দেবার পশ্চাতে তার অন্য কোন পরিকল্পনা ছিল কিনা কে জানে। কিন্তু দিন তিনেক পরে গাঁয়ের লোকেরা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে বিন্দুর সঙ্গে নন্দলালের বিয়ে দেয়। নন্দলালের চাকরটা রাতারাতি বাজিতপুরে পালিয়ে গিয়েছিল। শেষে ফিরে এসেছিল পুলিশ নিয়ে। নন্দলাল গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে পুলিশকে বিদায় দিয়েছিল। তারপর সেই যে নন্দলাল বৌ নিয়ে কলকাতায় চলে গেল তার আর দেখা নেই। বিন্দু-নন্দলালের এই কাহিনী গোপালের জীবনে আর এক কলঙ্কিত অধ্যায়। নন্দলালের অন্য স্ত্রী ছিল। চরিত্রও ভাল নয়। এই দুঃখের ভূমিকা গোপালকে অনুতপ্ত করেনি।

শশীর সঙ্গে সাংসারিক নানা ব্যাপারে পিতার সংঘাত বাঁধত। কিন্তু শশী সব ব্যাপারে শাস্ত ও সুভদ্র। শশীর ভদ্রতায় গোপাল খুশি হয়। কারণ বয়স্ক সন্তানকে বশ করার মতো সুখ আর নেই। শশীর সঙ্গে গোপালের তর্ক হয়, মতান্তর হয়, শশী যামিনী কবিরাজের বাড়িতে এত ঘন ঘন যায়, সেনদিদির জন্য এত ব্যাকুল হয়, এটাও গোপাল পছন্দ করে না। এই নিয়ে শশীর সঙ্গে প্রায়শই তার তর্ক বাধে।

গোপাল ও শশীর বিরোধ দুই প্রজন্মের বিরোধ নয়, এখানে বিরোধ দুই দৃষ্টিভঙ্গির। শশীর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে উদারতা, যে সামাজিক মঙ্গল সম্পর্কে সচেতনতা বর্তমান, গোপালের মধ্যে তা অনুপস্থিত। গোপাল নেতিবাচক দিক থেকে সাংসারিক বুদ্ধিকে ব্যবহার করেছে এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রে হঠকারিতার প্রমাণ দিয়েছে। শশী চরিত্রে সৌকুমার্য ও রসবোধ, কল্পনা ও মানববোধ কোনো কিছুই গোপাল চরিত্রে লক্ষ্য করা যায় না। লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, শশীর ওপর গ্রাম্য গৃহস্থের সঙ্কীর্ণ চিত্র কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজের পাঠের সময় কুমুদের প্রভাবে বা নাগরিক জীবনের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। শশী সেনদিদির বাড়ি থেকে চিকিৎসার্থে ডাক পায়। এ ব্যাপারে পিতা হয়ে স্থূলভাবে গোপাল প্রতিবাদ করে। গোপাল পুত্রকে সতর্ক করে দেয় এই বলে, “যুবতী স্ত্রীলোক নানারকম কুৎসা শুনতে পাই”—শশী অবাক হয়—“গোপালের মুখে এই কথা?” মৃদুস্বরে সে বলে “এসব আপনার বানানো কথা বাবা।” গোপাল পুত্রের ক্রমবর্ধমান পসারের কথা বলে তাকে সাবধান করে দেয়, বলে, “এই তোমার উঠতি পসারের সময়, এখনই একটা বদনাম রটে গেলে—এও কি তোমায় বলে দিতে হবে।” শশী শৈশব ও কৈশোর থেকেই পিতাকে যমের মতো ভয় করত। তাই গোপালের তীক্ষ্ণ ও অপলক দৃষ্টির সামনে সে তার দৃষ্টি নত করে। তবে শশী বোঝে সাংসারিক বুদ্ধিতে সে বাপের চেয়ে কাঁচা। গোপাল এখনও তাকে পরিচালনা করতে পারে।

গোপাল ধুরন্ধর ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। শশীর পসার ও জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। অথচ সেনদিদির চিকিৎসার জন্য শশী দূরের ‘কল’ ত্যাগ করে প্রাণপণে তার আরোগ্য সাধন করে চলেছে। গোপাল এসব সহ্য করতে না পেরে যামিনী কবিরাজকে উস্কানি দিয়ে শশীকে অপমানিত করেছে। যামিনী ও গোপাল দুজনেই শশীকে ভয় করতে শুরু করে। “মনে পাপ থাকার এই একটা লক্ষণ। মনে হয়, সকলে বুঝি সব জানে। সাপ উঠিয়া পড়ার আশঙ্কায় কেঁচো খুঁড়িবার চেষ্টাতেও মানুষ ইতস্ততঃ করে। পৃথিবীটা চিরকাল ঈশ্বরের রাজ্য। মানুষের এই বদ্ধমূল সংস্কার সহজে যাইবার নয়। হাজার পাপ করিলেও নয়।”

গোপালের মনের গভীরে পাপ ও সংশয় দানা বেঁধে উঠেছে, গোপালের মতে নিজের সর্বনাশ করে পরের উপকার করে বেড়ানো যে শশীর বুদ্ধিহীনতার পরিচয়, এইসব ঘটনায় তা বোঝা যায়। শশীর প্রতি তার অনাস্থা অগাধ—“যে কীর্তি সব তোমার, তুই উচ্ছন্নে যাবি শশী।” যামিনী কবিরাজের বৌ বেঁচে ওঠে, আর গোপাল ‘বিপজ্জনক গাম্ভীর্য’ নিয়ে শশীকে কাজে যেতে বলে। শেষে শশীকে জানায় “যামিনী খুড়োর ইচ্ছে নয়, তুমি ওদের বাড়ি যাও।” শশীর ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে গোপাল সংখ্যার ত্যাগ করে কাশী যেতে চায়। শশী ভেবে পায় না যে সে কী অন্যায় কাজ করেছে। গোপাল বলে যে শশী তার মুখে চুনকালি মাখিয়েছে। যামিনীর বৌ-এর অসুখে শশীর এত দরদ কেন, এই নিয়ে চারিদিকে শোরগোল উঠেছে। এই কারণে গোপাল এত অসুখী, এত বিরক্ত। শশীর মতে এটা গোপালের বানানো কথা। গোপাল মনে করে এ অভিযোগ সত্য। তাই সে শশীর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করে।

যামিনী কবিরাজ শশীর নিন্দা করে বেড়ায়। এসব কথা গোপালের কর্ণগোচর হয়। গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকে গোপালের কাছে এসব ব্যাপারে অভিযোগ করে, বলে যামিনী কবিরাজের নিমকহারামীর দৃষ্টান্ত এসব। গোপাল এসব খবরে ক্রুদ্ধ হয়। এইখানেই গোপাল চরিত্রের ব্যতিক্রমী দিক। গোপাল যামিনীকে শশীর নিন্দা করতে নিষেধ করে। যামিনী চরিত্রের দ্বন্দ্ব এখানে ধরা পড়ে। গোপালের বাৎসল্য যেমন সত্য, তার বিপরীত শক্তিও তেমনি সত্য। গোপাল যখন বোঝে শশী শহরে গিয়ে ডাক্তারী করতে চায়, তখন গোপালের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। একদিক থেকে গোপালের সাফল্যও উল্লেখযোগ্য। গাওদিয়ার গ্রামে কুঁড়ে ঘরে গোপালের জন্ম, পরের দুয়ারে সে ছিল অন্নের কাঙালী আজ সেখানে দালান কোঠা। এ-সবই গোপালের সাফল্যের স্মারক। প্রতিদিন খান ত্রিশেক পাত পড়ে। সকলকে নিয়ে তার সংসার এক আদর্শ বাঙালীর সংসার। শশীকে এই পথে চলতে হবে, হতে হবে এই জীবনের উত্তরাধিকারী। শহরের ডাক্তারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় শশী হয়তো দাঁড়াতে পারবে না, কিন্তু এখানে সে যথেষ্ট প্রভাবশালী। শশী যদি ডাক্তারিতে অর্থকরী সাফল্য নাও পায়, তবু তার অসুবিধে হবে না। জমিজমা, সুদ গুণে তার দিন চলে যাবে। শশীর শহরে যাওয়াকে স্বার্থপরতার সংকেত বলে মনে করেন। গোপাল। “বড়ো তুই স্বার্থপর শশী।” এসব মহত্ত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকে গোপালের স্নেহান্ধ মন।

এইভাবে শশীর সঙ্গে গোপালের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে এগোয়। মতান্তর হলেই কথা বন্ধ, মনাত্তর হয়, বাৎসল্যের জগতে হয় মন্বন্তর। আবার তুচ্ছ ছুতো করে গোপাল শশীর ঘরে ঢুকে চাবি খুঁজতে চায়। শশী দেখিয়ে দেয় যে তার পকেটেই চাবি। গোপাল অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। এইভাবে হারজিতের খেলা পিতাপুত্রের মধ্যে শুরু হয়। পিতাপুত্রের সম্পর্কের জটিলতা গোপালকে বিমূঢ় করে—“ছেলে বড় হইলে কি কঠিন হইয়া দাঁড়ায় তার সঙ্গে মেশা–সে বন্ধু নয়, খাতক নয়, উপরওয়ালা নয়, কি যে সম্পর্ক দাঁড়ায় বয়স্ক ছেলের সঙ্গে মানুষের ভগবান জানেন।” গোপাল চরিত্রের জটিলতা তার পুত্রের সঙ্গে সম্পর্কে, তার গোপন আসক্তির দ্বন্দ্বে। সেনদিদি সেই আসক্তির কেন্দ্র।

যাদবের উইল যখন সকলকে বিস্মিত করে তোলে, গোপাল কিন্তু এত সহজেই বিচলিত হয় না। এখানে বাৎসল্যের সম্পর্ক দুশ্চিন্তায় শশীর কর্তৃত্ব গোপাল নিজে নিয়ে নিতে চায়। যাদবের উইল অনুযায়ী গাঁয়ের হাসপাতালে শশীর কর্তৃত্ব সকলকে বিরোধী করে তুলবে। শত্রুতা করে সব পণ্ড করে দেবে। গোপাল শশব্যস্ত হয়ে বাজিতপুরে গিয়ে উইলটা দেখে আসায় শশী বিরক্ত হয়। সে হাসপাতাল সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে গোপালকে হস্তক্ষেপ করতে দেয় না। গোপালের মধ্যে অভিমান প্রবল, উদ্ধত্যের সঙ্গে অভিমানের যোগসূত্র। গোপালকে করুণ করে তোলে। গোপালের নিজের জীবন শ্রদ্ধেয় নয়। তাই শশীর কাছে সে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেনি। অসহায় গোপাল অদৃষ্টকে দোষী করে। এ-সব দুঃখ সে পাপের শাস্তি হিসেবে মেনে নেয়। গোপাল শশীকে অভিযুক্ত করে এই বলে যে তার মহত্ত্ব, আসলে গোপালকে ক্ষুদ্র করে তোলার চক্রান্ত। “বাবা পাপিষ্ঠ, উনি মহৎ”—এই তুলনার সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় শশী। পিতাপুত্রের এই ব্যক্তি দ্বন্দ্ব আসলে উপন্যাসে অন্য মাত্রা এনে দেয়। জীবন সম্পর্কে এনে দেয় এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। গোপাল সামান্য সুবিধার জন্য মানুষের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। এর জন্য কোনো অনুতাপও তার হয়নি। সেই গোপাল ভাবপ্রবণতার বশে হয়তো হাসপাতালের জন্য পাঁচশত টাকা তুলে দিতে চায়। গোপাল তার দুঃখে বড় একা। সেনদিদির কাছে গোপাল খুঁজে ফেরে সান্ত্বনা।

গোপালের ট্র্যাজেডি এই যে সেনদিদির চিকিৎসার জন্য সে একদা পুত্র শশীকে নিন্দা ও তিরস্কার করেছে। সেই সেনদিদির সন্তান প্রসবের যন্ত্রণার সময় গোপাল নিজে গিয়ে শশীকে ডেকে তোলে। শশী প্রশ্ন করে “পুত্র বলিয়া এভাবে তাকে ডাকিবার অধিকার কে দিয়াছে গোপালকে? সেনদিদি মরুক বাঁচুক শশী কী গ্রাহ্য করে?” এই প্রশ্ন শশীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গভীর থেকে উঠে এসেছে। পুত্র সন্তান প্রসব করে সেনদিদি মারা গেল, তা গোপালকে আদ্যন্ত মুহ্যমান করে তুলল। এই দুঃখ ঘাত সকলের নজরে পড়েছে, শশীর কাছে তা লজ্জাজনক হয়ে গেল। সেনদিদির চিকিৎসা রীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে গোপাল যখন কৌতূহলী ও সপ্রশ্ন হয়ে উঠল, তখন শশী আরও বিস্মিত হয়ে গেল। গোপাল বিষয়ী, সংসারী, কিন্তু এর দুর্বলতার প্রকাশ রহস্যময় হয়ে উঠল। সেনদিদির ছেলের জন্য গোপাল যথেষ্ট ব্যবস্থা করে রেখেছে। মা-মরা শিশুকে বুকে করে নিয়েছে, এ-ব্যাপারও অভূতপূর্ব। গোপালের ব্যবহারের ছলনায় শশী আশ্চর্য হয়ে যায়। এসবের ফলে শশী ও গোপালের মধ্যে ব্যবধান হয়ে ওঠে দুস্তর।

গোপালের বাৎসল্য প্রবল। তাই সে শশীকে নানা ছলনায় ধরে রাখতে চায়। শশী দেশছাড়া হয়ে যাবে চিরকালের মতো, এ কথা শোনার পর গোপাল নতুন চাল দেয়। সাতদিনের জন্য কাশীতে বাবার আশ্রমে গিয়ে ওঠার কথা বলায় শশীর মনে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। গোপাল সংসারী, গৃহে মানুষ। মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দায়িত্ব সব শশীর হাতে তুলে দিয়ে গোপাল কোথায় চলে গেল। গোপালের জীবনের পরিণাম ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র আর এক ট্র্যাজেডির স্বাক্ষর।