প্রথম মহেন্দ্রবর্মন (৬০০-৬৩০ খ্রিস্টাব্দ):

পিতা সিংহবিষ্ণুর মৃত্যুর পর প্রথম মহেন্দ্রবর্মন কাঞ্চীর সিংহাসনে বসেন। তাঁর রাজ্যসীমা উত্তরে কৃষ্ণা নদী থেকে দক্ষিণে কাবেরী নদী পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। কপোতেশ্বর মন্দিরে প্রাপ্ত মহেন্দ্রবর্মনের একটি লেখ থেকে তাঁর এই রাজ্যসীমা সম্পর্কে জানা যায়। উত্তর ভারতে পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধন এবং দক্ষিণ ভারতে শক্তিশালী চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন মহেন্দ্রবর্মনের সমসাময়িক। তবে হর্ষবর্ধনের রাজ্য বহুদূরে হওয়ার কারণে মহেন্দ্রবর্মনের সাথে তাঁর মৈত্রী বা শত্রুতা কোনটাই ছিল না। কিন্তু চালুক্যদের সাথে পল্লবদের বৈরিতা ছিল তীব্র। পল্লবদের সাথে চালুক্যদের এই শত্রুতা ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পিছনে একাধিক কারণ ছিল। যেমন—(ক) উভয় রাজ্যই দক্ষিণ ভারতে ভৌমিক সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেছিল। তাই উভয়ের সংঘাত ছিল অনিবার্য। (খ) চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর পূর্বপুরুষগণ কদম্বদের অধীন সামন্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে চালুক্য ও কদম্বদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়, কিন্তু পল্লবদের সাথে কদম্বদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে, পল্লবদের উপর চালুক্যরা রুষ্ট হয়। (গ) পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলে চালুক্যরাজ্য অবস্থিত ছিল। আর পল্লবরাজ্য ছিল নীচের দিকে উপকূল অঞ্চলে। এখানকার নদীগুলি পশ্চিমদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছিল। এই নদীগুলির মধ্যে কৃষ্ণা ও গোদাবরী, ব-দ্বীপের ওপর স্থাপিত বেঙ্গীকে প্রদক্ষিণ করে সমুদ্রে এসে পড়েছিল। এই দুটি মূল নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী ছিল দুটি রাজ্যই। তাই এদের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য।

পল্লব চালুক্য সংঘর্ষ :

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, পল্লবরাজ মহেন্দ্রবর্মনের সম্প্রসারণনীতি এবং বেঙ্গীর উপর আধিপত্য স্থাপনের প্রচেষ্টার পাল্টা চেষ্টা হিসেবে চালুক্যরাজ্য দ্বিতীয় পুলকেশী কাঞ্চী আক্রমণ করেন। কাঞ্চীপুরমের ১৫ মাইল উত্তরে পুল্ললুর যুদ্ধে মহেন্দ্রবর্মন পরাজিত হন। কাঞ্চী রক্ষা করতে সমর্থ হলেও মহেন্দ্রবর্মন তাঁর রাজ্যের উত্তরাংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় পুলকেশীর মারুতুরু দানপত্র এবং আইহোল প্রশস্তির বক্তব্য থেকে এই যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করা হয়েছে। কিন্তু মহেন্দ্রবর্মনের কাশাকুড়ী পট্টে বলা হয়েছে যে, মহেন্দ্রবর্মন তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাই মহালিঙ্গম্ এই যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, আইহোল-প্রশস্তিতে মহেন্দ্রবর্মনের নামের উল্লেখ নেই। আছে পল্লবদের রাজা কথাটি। তাই তিনি মনে করেন, সম্ভবত পরবর্তী রাজা প্রথম নরসিংহবর্মনের রাজত্বের গোড়ার দিকে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

অন্যান্য গুণাবলী : বিচিত্র চিত্ত, সত্যসন্ধ, চৈতকারী, শত্রুমল্ল প্রভৃতি অসংখ্য অভিধাধারী মহেন্দ্রবর্মন বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সময়ে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পে নবযুগের সূচনা হয়েছিল। সাহিত্য ও ধর্মের ক্ষেত্রেও তাঁর উদারতা ছিল নবজাগরণের বার্তাবাহী। তিনিই প্রথম প্রচলিত ইট ও কাঠের পরিবর্তে পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর আমলে নির্মিত গুহামন্দিরগুলির মধ্যে ত্রিচিনোপল্লী, বল্লম, দলবানুর ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। তিনিই প্রথম পাহাড় কেটে লেখ খোদাই করান। তাঁর আমলে দক্ষিণ ভারতে সাহিত্যেরও ব্যাপক উন্নতি ঘটে। তিনি নিজে ছিলেন কবি ও নাট্যকার। তাঁর রচিত ব্যঙ্গ-নাটক ‘মত্ত-বিলাস প্রহসন’সংস্কৃত ভাষার এক অমূল্য সম্পদ। সঙ্গীতশাস্ত্রের উপরেও তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। ভারবি, দক্ষিণ প্রমুখ বহু গুণী ব্যক্তি মহেন্দ্ৰবর্মনের পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর আমলে সৃষ্ট ভাস্কর্য কর্মগুলির মধ্যে তিরুচিরাপল্লীর গুহায় উৎকীর্ণ গঙ্গাবতরণ চিত্র বিখ্যাত। কৈলাসনাথ, মুক্তেশ্বর, মাতঙ্গেশ্বর মন্দিরে ভাস্কর্যকর্ম সম্পাদিত হলেও, সেগুলি গুণমানে ছিল নিকৃষ্ট। তাঁর ধর্মীয় উদারতার অভাব ছিল না। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন শাক্ত, পরে শৈবধর্ম গ্রহণ করেন। এই যুগে আলবার ও নায়নার সম্প্রদায়ের সংস্কার আন্দোলনের ফলে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীব ঘটেছিল।