অথবা, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ধরনসমূহ বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি সামাজিক গবেষণার একটি মৌলিক পদ্ধতি। সমাজ গবেষণায় একটি মৌলিক তথ্য সংগ্রহ কৌশল হিসেবে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি পরিচিত। সমসাময়িক জীবন হতে তথ্য সংগ্রহ করার বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে পর্যবেক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এটা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের একটি প্রাথমিক হাতিয়ার। পর্যবেক্ষণ কোনাে একটি বিষয় বা ঘটনার প্রতি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে এবং গবেষণার অনুমান গঠনে সহায়তা করে। এ ছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতির দ্বারা সংগৃহিত তথ্যের বিশ্লেষণে পর্যবেক্ষণ বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পর্যবেক্ষণের প্রকারভেদঃ বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ সমাজ গবেষণা তথা সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের বিকাশে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় পর্যবেক্ষণে নমনীয়তার নীতি বিদ্যমান থাকায় যে, কোনাে পরিবেশে গবেষণা তার অভীষ্ট তথ্যাবলি সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। প্রাপ্ত তথ্যাবলির যথার্থতা ও নির্ভরযােগ্যতার মাত্রা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে এ পদ্ধতি হতে প্রাপ্ত তথ্যাবলি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও বাস্তবধর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় তিনটি উপাদান বিশেষভাবে সক্রিয় এবং সংবেদনশীল। আর এদের অবস্থানগত ও সার্বিক বিবেচনায় পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনা ভিন্নতর হয়ে থাকে। নিম্নে প্রকারভেদগুলাে আলােচনা করা হলাে-
(১) অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ (Non-Controlled observation): অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কাজের প্রাথমিক স্তরবিশেষ যা আজ অব্দি ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ পদ্ধতিতে বহিঃস্থ কোনাে ব্যক্তি বা উপাদানের নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রভাবমুক্ত থেকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বা বাস্তবিক পরিবেশে বিষয় বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এখানে পর্যবেক্ষক সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেন কিংবা নাও পারেন। তবে তিনি ঘটনা তৎপরতার ক্ষেত্রে উপস্থিত বা প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলাের পর্যবেক্ষণ করে থাকেন এবং ঘটনার স্বাভাবিক গতিতে কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপ করা হয় না।
(২) নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ (Controlled observation): অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের দুর্বলতা দূর করে পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের নির্ভরযােগ্যতা বৃদ্ধিকল্পে এবং ঘটনা মধ্যকার কার্যকারণ সম্পর্ক চিহ্নিত করার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ কৌশল প্রয়ােগ করা হয়। এখানে পর্যবেক্ষক তার সমস্ত তৎপরতা পূর্ব পরিকল্পিত কৌশল অনুযায়ী করে থাকেন। একারণে নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ প্রায় সর্বাংশেই কাঠামােবদ্ধ সামাজিক ঘটনার পরিমাপযােগ্য তথ্যাবলি সহ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ পদ্ধতি যথেষ্ট উপযােগী ও সমাদৃত। এখানে কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে কিংবা পরিবেশকে অধিক মাত্রায় নিয়ন্ত্রিণ করে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
(৩) কাঠামােবদ্ধ পর্যবেক্ষণ (Structured observation): পর্যবেক্ষণীয় ঘটনার প্রাসংগিক তথ্যাবলি নির্বাচনে, পর্যবেক্ষণকালে বিভিন্ন অবস্থা পরিমিতিকরণে এবং ধারণযােগ্য তথ্যাবলির শ্রেণিকরণে সতর্ক পরিকল্পনার অধীনে কাঠামােবদ্ধ পর্যবেক্ষণের কাজ পরিচালনা করা হয়। ঘটনার সুশৃঙ্খল বর্ণনা অথবা কার্যকারণ সম্পকীয় প্রলাপ যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রধানত এ ধরনের পর্যবেক্ষণ কাজ করা হয়ে থাকে। অনসন্ধানের উদ্দেশ্য অনুযায়ী প্রাসংগিক কোনাে কোনাে তথ্য কীভাবে ধারণ করতে হবে এখানে পর্যবেক্ষক পূর্ব পরিকল্পনানুসারে তা জ্ঞাত থাকেন। এ ধরনের পর্যবেক্ষণ প্রাকৃতিক মাঠ পর্যায়ে এবং গবেষণাগার পরিবেশে পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে থাকে।
(৪) কাঠামােহীন পর্যবেক্ষণ (Unstructured observation): কাঠামােবদ্ধ পর্যবেক্ষণের বিপরীত অবস্থা কাঠামােহীন পর্যবেক্ষণে পরিলক্ষিত হয়। তথ্য উদঘাটনমূলক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে কাঠামােহীন পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ায় কোন ক্ষেত্রেই পূর্ব-পরিকল্পিত উপায়ে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এখানে পর্যবেক্ষণীয় ঘটনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাবিধ পরিবর্তন দেখা দেয় বলে। পর্যবেক্ষণকে সদা নমনীয় পর্যবেক্ষণ কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।
(৫) সরাসরি অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ (Direct participatory observation): পর্যবেক্ষণ কাজে গবেষকের অংশগ্রহণ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। পর্যবেক্ষণীয় ঘটনা মধ্যস্থ একজন সদস্য হতে শুরু করে ঘটনা সম্পর্কে বহিঃহ তথ্য সংগ্রহকারী পর্যন্ত গবেষকের অংশগ্রহণের মাত্রা বিস্তৃত থাকতে পারে। তবে A.B. Blalock এবং H.M. Blaclock (১৯৮২) এর ভাষায়, যখন একজন গবেষক পর্যবেক্ষণধীন জনসমষ্টির পূর্ণ বিশ্বস্ততা অর্জন করেন, তার উপস্থিতি জনগােষ্ঠীর সাধারণ কর্মতৎপরতায় কোনাে বাধার সৃষ্টি করে না, জনগণ যখন তার যেকোনাে তৎপরতার প্রতি স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়া করে এবং কোন তৎপরতা তার কাছে গােপন করে না তখন তিনি একজন অংশগ্রহণকারী পর্যবেক্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন। বহু নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা এ ধরনের অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
(৬) অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণ (Non-participant observation): অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের বিপরীত অবস্থা অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণে উপস্থিত থাকে। এর সংজ্ঞায় Wilkinson এবং Bhandarkar বলেন, ‘পর্যবেক্ষণীয়দের কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোনাে প্রকার অভিজ্ঞতা ছাড়াই পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে যখন কোনাে বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষক এবং ধারণকারির ভূমিকা গৃহীত হয় তখন তাকে অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণ বলে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, গবেষণার ভিন্নতার কারণে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে সুচারুভাবে ব্যবহার করার জন্য উপযুক্ত প্রকারভেদগুলাে পরিলক্ষিত হয়। সমাজবিজ্ঞানের যে বৈচিত্রময় ক্ষেত্র রয়েছে সেই ক্ষেত্র থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয় সামাজিক সমস্যার বৈজ্ঞানিক বা বাস্তবসম্মত সমাধানেও সহায়তা প্রদান করছে।
Leave a comment