পরিবেশবাদ

পরিবেশবাদের বিষয়টি সাম্প্রতিককালের। পরিবেশবাদ নতুন একটি মতাদর্শ হিসাবে পরিগণিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কিত বিপ্লব বা সুবজ বিপ্লবের উদ্ভবের সঙ্গে পরিবেশবাদের ধারণা সংযুক্ত। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পায়ন বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে পরিবেশবাদের মূল নিহিত আছে। ক্রমবর্ধমান আর্থনীতিক উন্নয়নমূলক প্রক্রিয়ার পরিণামে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি পরিবেশবাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কতকগুলি ঘটনার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর দূষণের বিরূপ প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই বিষয় বা ঘটনাগুলি হল পারমাণবিক প্রযুক্তি, অ্যাসিড বর্ষা, ওজোন (Ozone)-এর ক্ষয়ক্ষতি, পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি প্রভৃতি। মানবজাতির অস্তিত্বের মান হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ এবং চূড়ান্ত বিচারে মানবজাতির অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আশংকা পরিবেশবাদের আলোচনায় প্রতিফলিত হয়।

পরিবেশবাদের এই সমস্ত বিষয়াদি অনেক সময় প্রচলিত মতাদর্শসমূহের মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, পুঁজিবাদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার জন্য উদ্যোগ-আয়োজনের কারণে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বাস্তুসংস্থানমূলক সমাজতন্ত্রে (eco-socialism) ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়। বাস্তুসংস্থানমূলক নারীবাদ (ecofeminism) আলোচনায় বাস্তুসংস্থান (ecological) সমস্যার কারণ হিসাবে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দায়ি করা হয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয় যে, প্রকৃতি-বিশ্ব বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার প্রতি পুরুষদের থেকে মহিলারাই অধিক অনুভূতিপ্রবণ। অ্যানড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Eco conservatism links the cause of conservation to the desire to preserve traditional values and established institutions.”

অন্যান্য মতাদর্শসমূহের আলোচনা মূলত মানব-কেন্দ্রিক। পরিবেশবাদ এ রকম নৃতাত্ত্বিক প্রধান আলোচনার সীমানাকে অতিক্রম করে গেছে এবং একটি র‍্যাডিক্যাল অবস্থান গ্রহণ করেছে। পরিবেশবাদে প্রাকৃতিক বিশ্বকে কেবলমাত্র মানুষের প্রয়োজন পূরণের সুবিধাজনক উপায় বা উৎস হিসাবে দেখা হয় না। পরিবেশবাদের বাস্তুসংস্থান বা ইকোলজি (ecology)-র গুরুত্বের বিষয়টিকে বড় করে দেখান হয়। এই কারণে অনেকে পরিবেশবাদকে ‘বাস্তুসংস্থানবাদ’ (ecologism) হিসাবে পরিচিত করার পক্ষপাতী। বাস্তুসংস্থানবাদে বাস্তুসংস্থানমূলক একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানবজাতিকে প্রকৃতিরই অংশমাত্র হিসাবে দেখা হয়। অ্যান্ড্রু হেউড মন্তব্য করেছেন: “ ‘Deep’ ecologists, or ‘dark Greens’, on the other hand, insist that nothing short of a fundamental reordering of political priorities, and a wellingness to place the interests of the ecosystem before those any individual species, will ultimately secure planetary and human survival.”


পরিবেশগত নৈতিকতা

পরিবেশ সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ বহু ও বিভিন্ন। এই সমস্ত সমস্যাদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। আবার কতকগুলি সমস্যা একেবারে আন্তর্জাতিক প্রকৃতির। এই সমস্ত সমস্যা আন্তর্জাতিক প্রকৃতির হলেও এগুলির অধিকাংশেরই উৎস হল এক বা একাধিক দেশ। এই সমস্ত সমস্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি শুধুমাত্র পার্শ্ববর্তী অধিবাসীদের উপর বর্তায়, তা কিন্তু নয়। এই সমস্ত সমস্যার কুফল সমগ্র সমাজ, মানবজাতি এবং এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপরও পড়ে। পরিবেশগত এই সমস্ত সমস্যার প্রকৃতি এমনই যে, এ সবের মোকাবিলা করা কোন একটি দেশের পক্ষে এককভাবে সম্ভব হয় না। এ ধরনের সমস্যা হল বিশ্বের সাধারণ সমস্যা।

বিশ্বের সাধারণ সমস্যাসমূহের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলি হল: সমুদ্র ও সমুদ্রপৃষ্ঠে দূষণ; আন্টার্কটিকা অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ; বনাঞ্চলের নির্বিচার ধ্বংস- সাধন ও মরুকরণ; দীর্ঘস্থায়ী দূষক পদার্থসমূহের জৈবিক বর্ধন; জৈব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ; ওজোন-এর ক্ষয়ক্ষতি, সাধারণভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভৃতি। পরিবেশগত এই সমস্ত সমস্যার সংকট বা কুফল থেকে কোন দেশই পৃথকভাবে মুক্ত থাকতে পারবে না। সকল দেশের মানুষই সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির বিপদ এড়াতে ব্যর্থ হবে। আবার এই সমস্ত সমস্যার কার্যকর ও অর্থবহ সমাধান আবশ্যক। অন্যথায় সামগ্রিক ও স্থায়ী উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, জলবায়ুর পরিবর্তন বা খামখেয়ালিপনার কারণে কৃষিপ্রধান ও উন্নয়নশীল দেশগুলির কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কৃষি অর্থনীতি মার খাবে। পরিবেশগত বিশ্বের সাধারণ সমস্যাদির সম্যক সমাধানের জন্য আবশ্যক হল পৃথিবীব্যাপী প্রতিরোধ কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রয়োগ।

‘গ্লোবাল কমন্স’ (Global Commons) এর ক্ষয়ক্ষতির জন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশই দায়ী। সাধারণভাবে বলা হয় যে, পৃথিবীব্যাপী পরিবেশগত বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টির জন্য পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলির দায়িত্ব সর্বাধিক। স্বভাবতই বলা হয় সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির সমাধান সম্পর্কিত ব্যয় নির্বাহের মূল দায়িত্ব সেই দেশগুলিকেই পালন করতে হবে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলিও এ ক্ষেত্রে তাদের দায়-দায়িত্ব একেবারে অস্বীকার করতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশগুলিও ‘গ্লোবাল কমন্স’-এর কিছু ক্ষতি সাধন করেছে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না। উন্নয়নশীল দেশগুলি সমুদ্রে নির্বিচারে মাছ ধরার যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। তাছাড়া এই সমস্ত দেশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও মাত্রাতিরিক্ত নগরায়ণ ঘটে। আবার উন্নয়নশীল দেশসমূহে বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে এবং প্রবাল প্রাচীরসমূহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই অবস্থায় এ কথা অনস্বীকার্য যে, সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির মোকাবিলার দায়ভার উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় শ্রেণীর দেশসমূহের উপর বর্তায়। পরিবেশগত সমস্যাসমূহের সম্যক ও দীর্ঘকালীন সমাধানের স্বার্থে উভয় ধরনের দেশেরই সহযোগিতামূলক ভূমিকা আবশ্যক। বিশ্বব্যাপী যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। তারফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে অল্পবিস্তর সহযোগিতামূলক উদ্যোগ আয়োজনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আধুনিককালে পৃথিবীর পরিবেশগত সমস্যাদির সমাধানের ব্যাপারে কমবেশী বহুজাতিক কাঠামোর মাধ্যমে সদর্থক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করার চেষ্টা হচ্ছে। এই সমস্ত উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সমস্যার প্রতিকারের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ কর্মসূচী অবলম্বন করা আবশ্যক।

পৃথিবীর পরিবেশ সমস্যার সমাধান এবং পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সকল দেশের সমবেত উদ্যোগ-আয়োজন আবশ্যক। এর জন্য দরকার পরিবেশগত নৈতিকতা বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা আছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অধিকাংশ পরিবেশগত সমস্যাদির জন্য সাধারণত শিল্পোন্নত দেশগুলিকে দায়ী করা হয়। বায়ুমণ্ডলে বর্তমানে গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারজন্য শিল্পোন্নত দেশগুলির দায়-দায়িত্বই সর্বাধিক। কারণ এই দেশগুলিই সর্বাধিক শক্তির ব্যবহার করে। আর্থনীতিক উন্নয়নের উপর এই দেশগুলি মাত্রাতিরিক্ত জোর দেয়। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক মংস ক্ষেত্রগুলির উপর নির্বিচার শোষণ কায়েম করে। এবং এই দেশগুলি নানাভাবে জীব বৈচিত্র্যের অনেক অংশকে ধ্বংস করে।

পৃথিবীর পরিবেশগত সাধারণ সমস্যাসমূহ সত্যই খুবই চিন্তার বিষয়। এই সমস্ত সমস্যার সত্বর ও সম্যক সমাধানের ব্যাপারে সর্বাঙ্গীন সক্রিয়তা আবশ্যক। তার জন্য সহযোগিতার যৌথ ক্ষেত্র গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু একাজে কিছু প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয়। কতকগুলি বিতর্কিত বিষয়ের মীমাংসা ব্যতিরেকে এ ক্ষেত্রে অসুবিধা আছে। এই সমস্ত বিষয়গুলি উল্লেখ করা আবশ্যক। পৃথিবীর পরিবেশগত সমস্যাদির মোকাবিলার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের ক্ষমতার মধ্যে তারতম্য আছে। তা বিচার-বিবেচনা করা দরকার। এবং তদনুসারে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দায়-দায়িত্ব বন্টন করা দরকার। আবার সাধারণভাবে আশংকা করা হয় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলি পৃথিবীর পরিবেশগত সমস্যাসমূহের সমাধানের কর্মসূচীতে আন্তরিকভাবে সক্রিয় হবে না বা অগ্রবর্তী ভূমিকা গ্রহণ করবে না। এর কারণ হিসাবে বলা হয় যে, পরিবেশ-সমস্যার মোকাবিলায় সদর্থক ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের গতি মন্থর হয়ে পড়বে। সমাজবিজ্ঞানীদের সুপারিশ অনুযায়ী পৃথিবীর পরিবেশগত সমস্যার সম্যক সমাধানের স্বার্থে সম্পদশালী দেশগুলি থেকে দীন-দরিদ্র দেশসমূহে সম্পদ-সামগ্রীর বন্টন বাঞ্ছনীয়। দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশসমূহের সমক্ষে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় হল দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়ন।