পত্র ও সাহিত্য গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমধারা, পত্র তখন হয়ে ওঠে সাহিত্য রসের বাহক। যখন পত্র রচনা রীতির গুণে, বলবার সরলতায় ও স্পষ্টতায় এবং ভাবের রসময় উপলব্ধি প্রকাশের বহুমাত্রিকতায় সাহিত্য গুণান্বিত হয়ে পড়ে তখন সাধারণ পত্রসাহিত্যে পরিণত হয়। যে যে বৈশিষ্ট্যে পত্রসাহিত্য কৌলিন্য অর্জন করে সেগুলি নিম্নরূপ—

  • (i) ব্যক্তিগত ভাবনার বাহক সাধারণ পত্র যখন সর্বজনীনত্ব প্রাপ্ত হয় তখন পত্রসাহিত্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

  • (ii) ব্যক্তির ভাবনা পত্রাকারে পরিবেশিত হওয়ার পথে যখন দেশ-কাল-সময়-সমাজের প্রতীতিকে মূর্ত করে তোলে তখন সাধারণ পত্রসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করে। 

  • (iii) পত্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাব বিনিময় যখন দার্শনিকতার স্তরে উন্নীত হয়, তখন পত্রসাহিত্য পদবাচ্য হয়ে ওঠে।

  • (iv) নিতান্ত কেজো কথার প্রকাশের সাথে সাথে পত্র লেখক যে কথাকে যখন শাশ্বত সত্যের চিরন্তনতত্ত্বে আলিম্পিত করে তোলেন তখন সে পত্রসাহিত্যের সর্বজনীন রসাবেদনার পর্যায়ভুক্ত হয়।

  • (v) পত্রের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা যখন গল্পরসে জারিত হয় তখন তা সাহিত্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়।

পত্র লেখক সাহিত্য রচনার সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে চিঠি লেখেন না। প্রয়োজনীয় বর্ণিত ঘটনাবহুল পরিবেশন নৈপুণ্যে ও ভাব গভীরতায় কখনো কখনো সাহিত্য হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের পত্র বিশ্লেষণে এ সত্য প্রমাণিত হয়ে পড়ে।

পত্র লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনা বিশ্বগত হয়ে যে সাহিত্যিক অভিব্যক্তি লাভ করে তার প্রমাণ পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ লিখিত ছিন্নপত্রের বহু জায়গায়। উদাহরণ হিসাবে ১০৮ নং পত্রের কিয়দংশ উদ্ধার করা যায়।

“অন্ধকারের আর রসের মধ্য দিয়ে এই লোকালয়ের একটি সজীব স্পন্দন আমার বক্ষের উপর এসে আঘাত করতে লাগল। বৃহৎ জনতার সমস্ত ভালো মন্দ, সমস্ত সুখদুঃখ এক হয়ে তরুলতা বেষ্টিত ক্ষুদ্র বর্ষা নদীর দুই তীর থেকে একটি সকরুণ সুন্দর সুগম্ভীর রাগিনীর মতো আমার হৃদয়ে এসে প্রবেশ করতে লাগল।”

ব্যক্তিগত এই অভিজ্ঞতাটি যেন সূর্যাস্ত সময়কালীন পদ্মাতীরকে নিয়ে গীতি-কবিতার আবহে মেজাজে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠেছে। সাধারণ পত্রের বর্ণনা অনেক সময় দেশ-কাল পাত্রের বাহক হয়ে বিশ্বগত হয়ে ওঠে। ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করে সর্বজনীনতা। রামকৃথ্বকে লেখা বিবেকানন্দের পত্রাংশ এখানে উদাহরণ যোগ্য— “যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে, আর দশ-বিশ লাখ সাধু ক্রোড় দশেক ব্রাক্ষ্মণ ওই গরিবদের রক্ত চুষে খায় আর তাদের উন্নতির কোনো চেষ্টা করে না, সে —এ যেন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির ভাব বিনিময় নয়, যেন কোনো ঔপন্যাসিকের বাস্তবসম্মত সমাজ বিশ্লেষণ।

সাধারণ পত্রে যেসব কেজো কথা থাকে সেগুলিও অনেক সময় শাশ্বত সত্যে অভিসিক্ত হয়ে সাহিত্য গুণান্বিত হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে অগ্রজ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-কে লিখিত বঙ্কিমচন্দ্রের চিঠির খণ্ডাংশ উদ্ধার করা যেতে পারে। সতীশের বিবাহ উপলক্ষ্যে সঞ্জীবচন্দ্র ঋণ করতে চাইলে তার বিরোধিতা করে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন—

“যে ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবেন না মনে জানিতেছেন তাহা গ্রহণ করা পরকে ফাঁকি দিয়া টাকা লওয়া হয়, আপনি যদি এখন ১৫০০ টাকা কর্জ করেন, তবে ঋণ গ্রহণ করাকে বঞ্চনা বলিতে হইবে। বরং ভিক্ষাবৃত্তি ভালো তথাপি বঞ্চনা ভালো নহে। পিতৃ আজ্ঞা পালনার্থ অথবা পিতার সুখদানের জন্য তাহা কর্তব্য নহে।”

স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে দু’ভাই-এর মধ্যেকার পত্র বিবরণটি জাগতিক সত্যের প্রকাশক হয়ে উঠেছে। এ বর্ণনা সাহিত্য ভিন্ন আর কিছু নয়।

আবার ব্যক্তিগত ভাব বিনিময় দার্শনিক সত্যে উত্তরিত হলে কিংবা ব্যক্তিক উপলব্ধি গল্পরসে জারিত হলে তখন তা সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে ওঠে। ছিন্নপত্রের ৩০ সংখ্যক চিঠিতে এক পল্লি বালিকার বিদায় দৃশ্যের বর্ণনায় তেমনিই গল্প রসের চিত্র মূর্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠিটি যেন একটি ছোটোগল্পের ব্যঞ্জনায় রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক সত্যে উত্তরিত করায়। সাধারণত এইভাবে পত্রের মধ্যে শিল্পী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে।

পত্রে লেখক ও প্রাপক এই দুজনকে ঘিরে সৃষ্টি হয় এক অন্তরঙ্গ সুর। আর এই দিক দিয়ে সাহিত্য হিসাবে পত্রসাহিত্য রচনাসাহিত্যের সঙ্গে নিকট সূত্রে সম্বন্ধ যুক্ত। উভয় মধ্যে বিশাল মিল এখানে সে মূলত রচনাসাহিত্য যেমন বারোয়ারি নয়, অনেকখানি ঘরোয়া, পত্রসাহিত্যও তাই। বরঞ্চ পত্রসাহিত্যে এই গুণ রচনাসাহিত্য থেকেও বেশি থাকবার কথা, কারণ এগুলি বিশেষভাবে একটি লোকের জন্য লেখা। সে লোকটি হচ্ছে এমন একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি যার সঙ্গে লেখকের অন্তরের যোগ একান্তই ঘনিষ্ঠ ও অকৃত্রিম। তাই সাহিত্যরসস্বাদী পত্র রচনার প্রেরকের সঙ্গে সঙ্গে প্রাপকেরও ভূমিকা থাকে। না থাকলে পত্রটি সাধারণই হয়ে থাকবে সেটি সাহিত্য হবে না।