১৯ শতকের নবজাগরণের পথিকৃৎ মধুসূদন বাঙালির আলোড়িত জীবনচেতনার সমুদ্র মন্থন করে রচনা করেছেন আর কাব্যসম্ভার বীরাঙ্গনা কাব্য কবির সৃষ্টিবিচিত্রার এক নির্দিষ্ট স্থানের অধিকারী।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শেষ পত্রকাব্য বীরাঙ্গনা। গঠন কৌশলের বিচারে কাব্যটি রোমন কবি ওভিদের রচিত কাব্য হিরোইডস এর কাছে ঋণী। কবি স্বয়ং তাঁর পত্রে এই অনুসৃতির কথা স্বীকার করেছেন। ওভিদের অনুসরণে কবিও তার কাব্যকে ২১টি পত্রে সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন, তার পত্রে এই বাসনার উল্লেখ আছে। হিরোইডস-এর সাথে বহিরঙ্গ- গত সাদৃশ্য থাকলেও বীরাঙ্গনা মধুর একান্ত মৌলিক রচনা। ড. ক্ষেত্রগুপ্ত এ প্রসঙ্গে বলেছেন—“কিন্তু পত্রাকারে রচিত হলেও মধুসূদনের কবিমন নাট্যধর্ম ও গীতোচ্ছ্বাস আর আখ্যান অংশের সংযোগে এক নবতর আঙ্গিক সৃষ্টি করেছেন” (মধুসূদন কবিআত্মা ও কাব্যজিজ্ঞাসা) পৃথিবীর সকল দেশেই সর্বকালে সাহিত্য বিবিধ আঙ্গিককে অবলম্বন করে রচিত হয়ে থাকে। একসময়ে চিঠির ঢঙে কবিতা লেখারও প্রচলন হয় যার অন্যতম নিদর্শন ওভিদের কাব্য আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যেও ‘মেঘদূত’ কাব্য পাঠ করলে মনে হয় মেঘকে দূত হিসাবে সম্বোধন করে বিরহী যক্ষ তার নিভৃত সংলাপগুলি যেন পত্রলেখকের মতোই উচ্চারণ করছেন। তবে মধুর বীরাঙ্গনায় সংস্কৃত কবিদের তেমন প্রভাব চোখে পড়ে না। এইকাব্য রচনায় মধুমূলত ওভিদের কাব্যকেই আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
পত্রকাব্যে রচনার কিছু শর্ত আছে। সাহিত্যের এই বিশেষ আঙ্গিকটি বিচারের প্রধান মানদণ্ড হল পত্রলেখকের সঙ্গে প্রাপকের সম্পর্ক ও পারস্পরিক স্বচ্ছতা। পত্রকাব্যে লেখকের মনের গোপন কথাটির সন্ধান মেলে। তবে পত্রকাব্যে তা নিহিত থাকে পরোক্ষভাবে। অপ্রাসঙ্গিক বিষয় অবতারণা বা বাকঅনাড়ম্বর পত্রকাব্যে কাম্য নয় পত্রকাব্যের কবিকে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় যাতে পাণ্ডিত্যের ভারে চিঠির অন্তর্নিহিত অন্তরঙ্গতার সহজরস বিনষ্ট না হয়।
এদিক থেকে বিচার করলে বীরাঙ্গনার পত্রগুলিকে অবশ্যই পত্রকাব্য বা Epistolary Verse বলা যায় । এই কাব্যের প্রতিটি পত্রই পৌরাণিক নারীদের ঈপ্সিত প্রেমাস্পদের কাছে না বলা কথা বা হৃদয়াবেগের উদাহরণ। তা কখনও অনুরাগ কখনও বা অনুযোগও।
বৃহস্পতির পত্নী তার সকল নীতিধর্ম বিসর্জন দিয়ে প্রণয় পত্র রচনা করেছেন স্বামী শিষ্য সোমদেবের উদ্দেশ্যে। গুরুগৃহে বাসকালে প্রতিদিনের কর্মের মাঝে কেমন করে তারার হৃদয় আপনাকে তুলে ধরেছে, পূর্বরাগের সেই কাহিনি তারার পত্রের পটভূমি। গুরুপত্নী হিসাবে তারার এই প্রণয় নিবেদন পুরাণসিদ্ধ না হলেও পত্রের আঙ্গিকেই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে আধুনিক পাঠকের কাছে। পত্রের শেষে তারা লিখেছেন—
“কি আর কহিব
জীবন মরণ মম আজি তব হাতে।”
কেকয়ীর পত্রটি ভিন্ন প্রকৃতির নাট্য চাতুর্য্যের মুন্সীয়ানায় রচিত। নায়িকার হৃদয়ের ঈর্ষা দ্বেষ-জ্বালা বাইরের ব্যঙ্গের আবরণে আবৃত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে পত্রটিতে। একে তাই অনুযোগ পত্রিকা বলা চলে। ভরতকে বাদ দিয়ে রামচন্দ্রের জন্য যৌবরাজ্যে অভিষেকের ব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ কেকয়ী তার বক্তব্যের অস্তিমে অভিমান দগ্ধ কণ্ঠে জানিয়েছেন, তিনি সন্দিপতিব্রতা হন তবে—
“বিচার করুণ ধৰ্ম্ম, ধৰ্ম্ম রীতি মতে”।
কেকয়ীর ব্যক্তিগত অভিসন্ধির বাহন হিসাবে পত্রের আঙ্গিককে সাথকরূপে ব্যবহার করেছেন মধুসূদন।
প্রোষিতভর্তৃকা পাঞ্চালীর স্বামী পার্থের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন ‘অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর পত্রে’। প্রেমরসের বিচিত্র রহস্য উদ্ঘাটনে কবি ব্রতী হয়েছেন বীরাঙ্গনা কাব্যে, দ্রৌপদীর পত্রিকায় বৈপরীত্যবোধ তাকে একটি বিশেষ দিকে আলোকিত করে তোলে। অস্ত্রশিক্ষার্থে সুরপুরে অবস্থিত অর্জুনের জন্য বিরহ আপ্লুতা দ্রৌপদী তার দ্রুত আগমন প্রার্থনার সাথে সাথে স্মরণ করেছেন অতীতের স্মৃতিময় দিনগুলি—
“কে ফেরে বিদেশে
যুবতী পত্নীরে ঘরে রাখি একাকিনী”।
অনুযোগের সুরে ব্যক্তিগত হৃদয়োত্তাপের এক প্রতিবাদী ভঙ্গির প্রকাশ ধ্বনিত হয়েছে নীলধ্বজকে লিখিত জনার পত্রিকাতে। আলোচ্য কাব্যের এটাই একটি মাত্র পত্র যেখানে কবি এমন এক নারী মূর্তি রচনা করেছেন যে মূর্তি প্রেমিকার নয়, কিন্তু আপন মহিমায় ভাস্বর। জনার বাৎসল্য তার সুতীব্র আত্মমর্যাদার উদ্বোধক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। পুত্রের মৃত্যুর বেদনাকে একমাত্র নারীর গৌরববোধের মধ্যে নির্বাচিত করেছেন জনা। পুত্রের ব্যক্ত তীব্র শ্লেষের মাধ্যমে এক্ষেত্রে নায়িকার আবেগ বা অভিনয় নয় ব্যক্তিগত রোষের উৎসারণ ঘটেছে।
আবার দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলার পত্রেও মধুর মিলনের অতীত স্মৃতি ও নস্টালজিক কোলাজ সার্থকরূপে ভাস্বর হয়ে উঠেছে পত্রকাব্যের আঙ্গিকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আখ্যায়িকার বিন্যাস, নাট্যচমৎকারীত্ব ও গীতিকাব্যের মূর্ছনায় নায়িকাদের বক্তব্যগুলি শিল্পমূল্যে অভিষিক্ত হয়েছে বীরাঙ্গনার পত্রকাব্যগুলিতে। শুধু তাই নয় মনন ও আবেগ যেন এক ঐক্যবদ্ধ সূক্ষ্ম পরিণতি লাভ করেছে পত্রকাব্যের সুরে।
সামগ্রিক বিচারে বীরাঙ্গনা কাব্যের গঠন কৌশল প্রশংসার দাবি রাখে। প্রীতি প্রবণতার উচ্ছ্বাসকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করে তার সঙ্গে নাটকীয় চমৎকারিত্বের অপ্রতিহত সমন্বয়ে বীরাঙ্গনা মধুর অসামান্য সৃষ্টি। অবশ্য সুকুমার সেন এ কাব্যের বিশ্লেষণে অধিকাংশ কবিতাকে ভাণিক্যকাব্য বলতে চেয়েছেন তবে স্বর্গতোক্তির মূলক করা জ্ঞাস্বর্গতোক্তির নায়িকাদের উচ্চারণ নাট্যনীতির মতো উচ্চারণ নয়। বরং পত্রলেখিকার সঙ্গোপন গভীরতায় সমাহিত। চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক বা Psycological dimention দিতে গিয়ে ওভিদের মতো মধুও চরিত্রগুলির মুখে নাটকীয় মনোলগ বসিয়েছেন। যার ফলে শুধু নায়িকা নয়— প্রতিপক্ষের পুরুষটিও প্রত্যবক্ষৎ হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। তবে শেষ বিচারের আমরা এটিকে ভাণিক্যকাব্য বা গীতিকাব্য অভিধায় গ্রহণ না করে পত্রকাব্য হিসাবেই চিহ্নিত করব। মধুর আগে বা পরে এ জাতীয় কাব্য রচিত হয়নি। গীতিকাব্যসুলভ রোমান্টিকতা, নাট্যরস, আখ্যানধর্মিতা এবং চরিত্র সর্বস্বতায় মিলনে ভারতীয় পুরাণ নৈতিকতার ফ্রেমে যে নারীদের চরিত্র এখানে তুলে ধরা হয়েছে তা প্রত্যেক স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল। সে হিসাবে প্রতিটি পত্রকবিতাই এখানে আপন গৌরবে সুসম্পূর্ণ। পত্র-আঙ্গিকে সাহিত্য রস ঢালার এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে দুটি নেই। একা দশটি নারী আলেখ্যের এই সজ্জা যে মনোরম ঐক্যতান শুরু করেছে তাকে পত্রকাব্য ছাড়া অন্য কোনো অভিধায় ভূষিত করা উচিত নয়।
Leave a comment