বৈদিক সমাজের বর্ণপ্রথা মৌর্য-পরবর্তী যুগ পর্যন্ত প্রচলিত থাকলেও এই সময় বিভিন্ন বৈদেশিক অনার্য জাতি ভারতে প্রবেশ করে ভারতের সমাজজীবনের সঙ্গে মিশে যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল যবন (ব্যাকট্রীয়-গ্রিক), শক, হুন প্রভৃতি। তারা জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় বা যােদ্ধৃজাতি হলেও ভারতের ব্রাহ্মণ্য ধর্মে তাদের স্থান শূদ্রদের ওপরে ছিল না। তারা ব্রাহ্মপ্য ধর্ম গ্রহণ করে ভারতীয় সমাজে ‘পতিত ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত। হয়। শাস্ত্রকার মনু যবন, শক, কুষাণ প্রভৃতি জাতিগুলিকে ‘ব্রাত্য ক্ষত্রিয়’ বলে অভিহিত করেছেন।
মৌর্য-পরবর্তী যুগে, বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপথ দিয়ে বিভিন্ন বৈদেশিক জাতি এদেশে অনুপ্রবেশ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল যবন (ব্যাকট্রীয়-গ্রিক), শক, কুষাগ, পয়ব, ফোন প্রভৃতি।
[1] মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব: ভারতে অনুপ্রবেশকারী যবন, শক, হন ও অন্যান্য বৈদেশিক জাতি যেমন ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন ঐতিহ্য ও রীতিনীতি গ্রহণ করে তেমনি তাদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতিও ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে। ফলে ভারতীয় সমাজে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে এবং এক মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। পণ্ডিত নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী বলেছেন যে, “যারা ভারতবর্ষ অধিকার করতে এসেছিল, হিন্দুসমাজ তাদেরকেই অধিকার করে নেয়।”
[2] ভারতীয়ত্ব গ্রহণ: বৈদেশিক জাতিগুলি ভারতীয় ধর্ম, ভাষা ও বিভিন্ন আচার-আচরণ গ্রহণ করে হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এদেশের সংস্কৃত ভাষাকে তারা তাদের সংস্কৃতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তারা হিন্দু দেবদেবীর উপাসনা শুরু করে এবং ভারতীয়দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
[3] সমন্বয়ের দৃষ্টীন্ত: বহিরাগত এই জাতিগুলির সঙ্গে ভারতীয় হিন্দুসমাজের সমন্বয়ের বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন—[i] ব্ৰায়ণ সাতবাহন রাজবংশ শক-ক্ষত্রপদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। [ii] পশ্চিম ভারতের শক- ক্ষত্ৰপরা প্রথমদিকে চস্টন, নহপান প্রভৃতি বহিরাগত নাম গ্রহণ করলেও তাদের বংশধররা সম্পূর্ণ ভারতীয় নাম, যেমন বুদ্রসেন, বিশ্বসেন, রুদ্ৰসিংহ, বিজয়সেন প্রভৃতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। [iii] ডিমিট্রিয়াসের মুদ্রার এক পিঠে গ্রিক ও অপর পিঠে প্রাকৃত ভাষার লিপির খােদাই সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।
[4] সংকটের উদ্ভব: ভারতীয় সমাজে বহিরাগত জাতিগুলির অনুপ্রবেশের ফলে ভারতের প্রচলিত জাতিভেদ ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা দেয়। শাস্ত্রকার মনু আশঙ্কা করেছিলেন যে, বহিরাগত জাতিগুলির প্রভাবে ভারতে শূদ্রদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং তা ব্রাহ্মণদের সম্মান ও মাজিক মর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর হবে। এজন্য প্রচলিত জাতি ও বর্ণ ব্যবস্থাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কঠোর সামাজিক আইন রচনা করা হয়। শেষপর্যন্ত বিদেশিদের ক্ষত্রিয় জাতিভুক্ত করা হলেও তাদের পতিত ক্ষত্রিয় হিসেবেই গণ্য করা শুরু হয়।
উপসংহার: বৈদেশিক জাতিগুলির ভারতে অনুপ্রবেশের ফলে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক ও বণিকগগও বহির্বিশ্বে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচারের অনুপ্রেরণা পান। তাঁদের মাধ্যমে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
Leave a comment