এ পৃথিবীতে একটি অনস্বীকার্য প্রাকৃতিক সত্য এই যে সবই অনিত্য। সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, কোন বন্ধনই চিরন্তন নয়। তবুও মানুষের ভালোবাসা, প্রীতি, স্নেহ, সংসারের অনিত্যতাকে অস্বীকার করতে চায়, কারণ ভালোবাসার ধনকে চিরকালের মত বক্ষলগ্ন করে রাখার আকাঙ্ক্ষাই জীবনের ধর্ম। কিন্তু এ আকাঙ্ক্ষা কখনই পূর্ণ হয় না। স্থিতি ও গতির দ্বন্দ্বে বিশ্বসংসারে নিরন্তর বেদনার সুর বেজে উঠছে, মানুষের ভালোবাসা তাই বিষাদে আচ্ছন্ন। একটি সাধারণ ঘটনার দর্পণে কবি বিশ্বের মর্মগত বেদনাকে প্রতিফলিত দেখেছেন এবং সেই বেদনাকে অনির্বচনীয় কাব্যরূপে ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
কবিতাটির প্রথম অংশে বাঙালি মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বাস্তব জীবনযাত্রার ছবিটি অঙ্কিত হয়েছে অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে। কবি যেন ইচ্ছে করেই অতি সাধারণ গদ্যময় স্তর থেকে কবিতাটি শুরু করেছেন। তারপর দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনাটি অবলম্বন করে একটি গভীর জীবনসত্যকে উদ্ভাসিত করে তুলেছেন। শিশুকন্যার কণ্ঠের প্রবল দর্পিত ঘোষণা যেন বিশ্বের মর্মে নিহিত এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব-বেদনার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে দিয়েছেন। প্রবাসযাত্রীর ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আকুলতার সঙ্গে মিশেছে হেমস্ত দ্বিপ্রহরের উদার নিস্তব্ধ প্রকৃতির চিত্র এবং ঐ নিসর্গ দৃশ্যই প্রবাসযাত্রীর মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করেছে।
যে শিশুকন্যা প্রবাসযাত্রী পিতাকে বলেছে, “যেতে আমি দিব না তোমায়”, তারই মত এ জগতের সকলেই তো ভালবাসার জোরে প্রিয়জনকে চিরকালের মত আপন বক্ষলগ্ন করে রাখতে চায়। কিছুই ধরে রাখা যায় না, এ জগতে সবকিছুই অনিবার্য ভাবে মৃত্যুর দিকে, বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলে। সেই অমোঘ প্রাকৃতিক বিধান থেকে কারও মুক্তি নেই। তবু মানুষের ভালোবাসার এই প্রচেষ্টা বিস্ময়কর, কিন্তু বড় করুণ। প্রেমের শক্তি যত বড়ই হোক–মৃত্যুর কাছে, পরিবর্তনের গতির কাছে তাকে পরাভব মেনে নিতেই হয়।
কবিতাটির শেষ অংশে কবি বসুন্ধরাকে স্নেহব্যাকুল মাতার মূর্তিতে উপস্থাপন করেছেন। মাতা বসুন্ধরা কত স্নেহে, কত ভালোবাসায় তাঁর বুকের প্রাণসম্পদকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রক্ষা করার সাধ্য তাঁর নেই। শিশুকন্যার ছবিটিকে কবি যে অনায়াসে নিপুণভাবে ধরিত্রীমাতার উৎকণ্ঠিতা স্নেহময়ী চিত্রে রূপান্তরিত করেছেন তা অসাধারণ কাব্য-সৌন্দর্যলাভ করেছে। এক ভাবগত সত্যোপলব্ধির সূত্রে একটি সাধারণ মানব-সংসারের বিচ্ছেদ-বিধুরতা বিশ্বের মর্মগত বিচ্ছেদ-বেদনার সঙ্গে গ্রথিত হয়ে গিয়ে অপূর্ব কাব্যসুষমায় মণ্ডিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
কেবল মানবজীবনের সকরুণ ঘটনাটি কবি যদি বর্ণনা করতেন তা হলেও কাব্যরস পরিবেশিত হতে পারত। কিন্তু মানবজীবনের বিচ্ছেদ-বেদনা বিশ্বজীবনের পটে সংস্থাপিত হওয়ায় কবিতাটি গভীরতর ও মহত্তর তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির ওপরে মানবীয় ভাব আরোপের দিক থেকেও কবিতাটি আশ্চর্য সফল। বিদায় মুহূর্তে শিশুকন্যার ম্লান মুখখানির বিষাদময়তা কবি অনায়াসে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির ওপরে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। অপ্রতিরোধ্য নিয়তির আঘাতে কাতর শোকার্তা ধরিত্রীমাতার উদাসিনী মূর্তি পাঠকের চিত্তে গভীরভাবে মুদ্রিত হয়ে যায়। প্রাত্যহিক সংসারযাত্রার মধ্যেই বিশ্বজীবনের এক গভীর রহস্য প্রতিফলিত হয়। কবিতা হিসাবে এখানেই ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটির সার্থকতা।
Leave a comment