কবি সুমিত্রানন্দন পন্ত মহাদেবী সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন – “উনকে কাব্য কা সর্বপ্রমুখ তত্ত্ব বেদনা, বেদনা কা আনন্দ, বেদনা কা সৌন্দর্য, বেদনা কে লিয়ে হী আত্মসমর্পণ হায়। ওয়হ তো বেদনা কে সাম্রাজ্য কী একছত্র সম্রাজ্ঞী হায়…।”
অর্থাৎ – “তাঁর কাব্যের সর্বপ্রধান তত্ত্ব বেদনা, বেদনার আনন্দ, বেদনার সৌন্দর্য, বেদনারই জন্য আত্মসমর্পণ। তিনি বেদনা-সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী।” হিন্দি সাহিত্য-আলোচক শ্রীইন্দ্রনাথ মদান ও মহাদেবী সম্পর্কে মূল্যায়ন করে লিখেছেন – “ভক্তিকালে যে স্থান মীরার প্রাপ্য ছিল, ছায়াবাদ যুগে তা মহাদেবীর প্রাপনীয় বলে লোকে তাঁকে ‘আধুনিক যুগের মীরা’-ও বলে থাকে।…যেখানে দুঃখ-যন্ত্রণা ও বেদনা-পীড়ার সম্বন্ধ, ততদূর পর্যন্ত মীরা ও মহাদেবীর বিশেষ পার্থক্য নেই।” কিন্তু মহাদেবীর এই বিরহচেতনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। কেননা এখানে দুঃখবাদের অন্ধকার অনুপস্থিত। বিবাহপ্রসঙ্গ বাদ দিলে ব্যক্তিজীবনেও মহাদেবী তেমনভাবে দুঃখ বা বেদনার দ্বারা পীড়িত হননি। তিনি নিজেই বলেছেন—“সুখ ও দুঃখের আলো-ছায়ার ডুরে-কাটা জীবনে কেবল দুঃখেরই প্রহর গোনা আমার কেন প্রিয়, এ বহু মানুষের আশ্চর্য হবার কারণ। সংসার যাকে দুঃখ ও অভাব বলে জানে, তা আমার ক্ষেত্রে ছিল না। জীবনে আমি বহু আদর, বহু সম্মান এবং আরো যা কিছু বহু মাত্রাতেই পেয়েছি, তার উপর পার্থিব দুঃখের ছায়া পড়েনি।”
একথাগুলি বলার কারণ এই যে, মহাদেবীর কবিতায় যে বেদনা বা বিরহের আর্তি, তা আসলে তাঁর স্বেচ্ছাগৃহীত জীবনদর্শন। তাঁর জীবনব্রতের মধ্যে একদিকে ছিল জ্ঞানসাধনা। এই জ্ঞানচর্চা দীপালোকের সঙ্গেই তুলনীয়। জ্ঞানের আলোয় জীবনকে উদ্ভাসিত করাই তাঁর ব্রত ছিল বলেই তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে দীপের প্রসঙ্গ। আলোচ্য কবিতায় দীপের প্রসঙ্গ তাই মহাদেবীর সমগ্র কবিস্বভাবের সঙ্গেই অন্বিত। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী করুণা ও আর্তজনের প্রতি দয়া মহাদেবীর জীবনের আর এক ব্রত। এটিও আসলে অন্ধকার জীবনে আশা ও আস্থার প্রদীপ জ্বালাবারই ব্রত। সেদিক থেকেও নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতায় দীপের প্রসঙ্গ স্বাভাবিক।
তবে আলোচ্য কবিতায় মহাদেবীর কবিবৈশিষ্ট্যের মূল কথাটুকু মনে রেখেও বলতে হয় যে, এখানে বিরহ বেদনার ভাবটির পরিবর্তে উজ্জীবনী উদ্দীপনাই অধিক ব্যঞ্জিত হয়েছে। অতএব ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ নামকরণটি এখানে সবথিসার্থক।
কিন্তু এই কবিতার নামকরণ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, আসলে ‘দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থের কোনো কবিতাই নামচিহ্নিত নয়। সমস্ত কবিতাই এই কাব্যগ্রন্থে সংখ্যাচিহ্নিত। ‘দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের ৫ সংখ্যক কবিতা। কবিতাটির বাংলা অনুবাদটির প্রথম পঙ্ক্তিটিকেই তাই এই কবিতার শিরোনাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কবিতার মূল হিন্দি প্রথম পঙ্ক্তিটি আসলে ছিল –“সব বুঝে দীপক জ্বলা লু।”
বিংশ শতাব্দীর সেই দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ যুগপরিবেশ ধূলিঝঞ্ঝার রূপকে প্রকাশিত হয়েছে মহাদেবীর আলোচ্য কবিতায়। কবিতার সূচনাতেই মহাদেবী লিখেছেন, পৃথিবীর অন্ধকার কারাগার ভেঙে আজ উম্মত্ত হয়ে খেয়ে এসেছে ধূলিঝড়। মহাদেবী বিশ্বাস করেন, সেই ঝঞ্ঝালগ্ন লাস্যময় তড়িৎকে আর ঢেকে রাখতে পারবে না কালো মেঘের ঘনঘটা। এই বিক্ষুব্ধ সময়ে নক্ষত্ররাও যেন ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে, বিভ্রান্ত বাতাস আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না, আকাশের কোলে অশুভ উল্কা ছড়িয়ে দিয়ে ধ্বংস যেন নেমে আসছে মত্ত হয়ে। এই ভয়ংকর উপদ্রুত সময়ে কবি কিন্তু ভীত-ব্রস্ত হয়ে মুখ লুকোননি কোনো নৈরাশ্যের অন্ধকূপে। মানবতার লাঞ্ছনা দেখে হতাশার বেদনায় তিনি সমস্ত আশার প্রদীপকেও নিভিয়ে ফেলেননি মন থেকে। বরং তিনি এই দুঃসময়েই তুলে নিতে চেয়েছেন কন্ঠে দীপক রাগিনীর উদ্দীপনার গাঢ় সুর। কবি বলেছেন, এই সময়েই চতুর্দিকে নিভে যাওয়া আশার প্রদীপগুলিকে তিনি জ্বালিয়ে তুলবেন। যে অন্ধকার আজ ঘিরে নেমেছে চারপাশে, তারই মাঝখানে তিনি জাগিয়ে তুলবেন দীপক রাগিনীর উদ্দীপনমন্ত্র। এই সর্বব্যাপ্ত ধ্বংসের মধ্যেই কবি তাঁর মমতাময় আঙুলের আড়ালে বাঁচিয়ে রাখবেন জীবনের সুকুমার স্বপ্নগুলিকে। আজ প্রদীপের মৃদু শিখা দিয়েই কবি বেঁধে রাখতে চান দুর্যোগকালের ছন্দলয়। তিনি প্রতিটি স্বরকে সাজিয়ে তুলতে চান দীপাবলীর আলোকমালার মতো। কবিতার শেষাংশে এক নাবিকের প্রসঙ্গ এসেছে। দুর্যোগের কালে কবি মহাদেবী তাঁর জীবনদেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন যে, তিনি যেন তরী বেয়ে এসে তাঁকে তীরে দেখেও পরিত্যাগ করে ফেলে না যান। তিনি যেন তাঁর প্রবল হুংকারে কবিকে তাঁর ঝঞ্ঝার দোলায় দোলায়িত তরীতে ডেকে নেন। কবি এই জোয়ারের তুমুল খরস্রোতেই দীপক রাগিণী ঝংকৃত করে জীবনের তরণী ভাসাতে চান।
সমগ্র কবিতাটিতে যে দীপ বা দীপাবলীর প্রতীক বারবার উচ্চারিত। আসলে জীবনকে প্রজ্জ্বলিত দীপের সঙ্গে উপমিত করা মহাদেবীর কবিতার একটি প্রিয় বিষয়। ড. সত্রাজিৎ গোস্বামী “হিন্দি কবিতাকাশের দশ নক্ষত্র’ গ্রন্থে মহাদেবীর ‘দীপশিখা’ কাব্য প্রসঙ্গে লিখেছেন—“মহাদেবী দীপশিখাকে এ কাব্যে ব্যবহার করেছেন অবিচলিত আস্থার প্রতীক হিসাবে। তাঁর মতে, ভারতসংস্কৃতিতে আত্মচৈতন্যকে প্রদীপশিখার মতো উজ্জ্বল আলোকময় করে তোলার আহ্বানমন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ মন্ত্র ভারতের ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প ও জীবনচেতনায় নিরন্তর গুঞ্জরিত।” আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তীর্ণ করো, আত্মাকে দীপে পরিণত করো – ইত্যাদি বাণী ঔপনিষদিক যুগ থেকেই উচ্চারিত। উপদ্রুত সময়ে কালগত অন্ধকারে নৈরাশ্যপীড়িত প্রাণগুলিকে দীপাবলীর আলোকমালার মতো প্রজ্জ্বলিত করে তোলার যে সংকল্প মহাদেবীর কবিতায় ধ্বনিত, তা সেই শাশ্বত ভারতেরই বাণী। স্বয়ং মহাদেবীও বলেছেন –“ তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ “আত্মদীপো ভব’ আদি মেঁ দীপ হী বোলতা হায়। অবিদ্যা অন্ধতমস হায় ওঁর জ্ঞান আলোক কা হী পর্যায় হায়। শিব কে আগ্নেয় তীসরে নেত্র কে সমান হী প্রত্যেক মানব কে পাস ভী আগ্নেয় তীসরা নেত্র হায় জো জল উঠে তো গহন আবেগজনিত তমিস্রা ধ্বস্ত হো জাতী হায়।” অর্থাৎ—“ তমসো মা জ্যোতির্গময়’, ‘আত্মদীপো ভব’ ইত্যাদিতে তো দীপের কথাই বলা হয়েছে। অবিদ্যাই অন্ধকার এবং জ্ঞানই আলোক। শিবের আগ্নেয় তৃতীয় নয়নের মতো প্রত্যেক মানুষেরই আগ্নেয় তৃতীয় নেত্র আছে, তা যদি জ্বলে ওঠে, তাহলে গহন আবেগজনিত তমিস্রাও ধ্বস্ত হয়ে যায়।”
বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সংকীর্ণ স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতির গহন তমিস্রালাঞ্ছিত কালে দুর্গম অভিসারের ও প্রার্থিত মুক্ত জীবনকে লাভ করার অপরাজেয় সংকল্পই লক্ষ্য করা যায় আলোচ্য কবিতায়। তিনি নিরাশ্বাস হতচেতন দুর্দশাপীড়িত মানবাত্মাকে সম্মিলিত শক্তির বজ্রস্বরে ধ্বনিত করতে চেয়েছেন দীপক রাগ এবং অন্ধকারপ্রায় মনগুলিতে জ্বালিয়ে তুলতে চেয়েছেন দীপাবলীর উদ্দীপক আনন্দহিল্লোল। অতএব ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটির নামকরণ মহাদেবীর সামগ্রিক কবিপ্রতিভার প্রেক্ষিতে এবং সমকালীন যুগপ্রেক্ষিতে সবার্থসার্থক হয়েছে।
Leave a comment