ভূমিকা: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে মানুষ এক বিশেষ মর্যাদা অর্জন করে। মানুষের এই বিশেষ রাজনীতিক মর্যাদার নাম হল নাগরিকতা। আভিধানিক বিচারে ‘নাগরিক’ শব্দটি নগরস্থিত, নগরজাত বা নগরবাসী ইত্যাদি ধারণা ব্যক্ত করে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তা নিতান্ত সংকীর্ণ ধারণা হিসাবে গণ্য হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘নাগরিক’ শব্দটি ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রের স্থায়ী ও পূর্ণাঙ্গ সভ্য হিসাবেই একজন মানুষ নাগরিক হয়। সে কেবল নগরবাসী নয়। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে, এমনকি সাময়িকভাবে রাষ্ট্রীয় সীমার বাইরেও অবস্থিত, যে-কোন নগরবাসী ও গ্রামবাসী নাগরিক হিসাবে গণ্য হতে পারে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের প্রকৃতি, রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্যের প্রকৃতি, রাষ্ট্র ব্যক্তিকে কি ধরনের অধিকার প্রদান করে—এই সবের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির নাগরিকত্ব সম্পর্কিত ধারণাটি সুস্পষ্ট হয়।


নাগরিক ও নাগরিকতার সংজ্ঞা

প্রাচীন ধারণা: ‘নাগরিক’ শব্দটি প্রাচীনকালে সীমাবদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হত। প্রাচীনকালে কোথাও কোথাও নগরবাসী অর্থেই নাগরিকতা বলা হত। আবার নগরবাসীদের মধ্যেও পার্থক্য করা হত। অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগী নগরবাসী মানুষকেই প্রকৃত নাগরিক বলা হত। এথেন্সের মত প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাগুলিতে এই ধরনের ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে এক একটি ‘নগরী’ নিয়ে এক-একটি রাষ্ট্র গঠিত হত। এগুলোকে নগর-রাষ্ট্র (city-state) বলা হত। নগর-রাষ্ট্রের সভ্যগণ নাগরিক হিসাবে গণ্য হতেন। কিন্তু নগরের সকল অধিবাসীকে নাগরিক বলা হত না। যারা নগরে বাস করত এবং রাষ্ট্রনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করত, তারাই সরাসরি নাগরিক হিসাবে গণ্য হত। অর্থাৎ প্রাচীনকালে রাষ্ট্রের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করাই ছিল নাগরিকত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতানুসারে যারা ব্যবস্থা বিভাগ ও বিচার কার্যে অংশগ্রহণ করত, তাদেরই কেবল নাগরিক বলা হত ( He who has the power to take part in the deliberative or judicial administration is said by us to be a citizen of that state.”)। সে যুগে ক্রীতদাস, শ্রমিক ও স্ত্রীলোকদের এই সব রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হত না। তাই ক্রীতদাস, শ্রমিক ও স্ত্রীলোকগণ নাগরিক হিসাবে গণ্য হত না। নাগরিকের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল বলেছেন: ‘যিনি ন্যায় প্রশাসনে অংশগ্রহণ করেন এবং যিনি প্রশাসনিক পদের অধিকারী তিনিই হলেন নাগরিক (The citizen is “a man who shares in the administration of Justice and the holding of office.”)।

নাগরিকতা সম্পর্কিত রুশো ও বোঁদা-র ধারণা:

নাগরিকতা সম্পর্কে ফরাসী দার্শনিক রুশো (Rousseau)-র ধারণা অ্যারিস্টটলের ধারণার মতই। রুশোর মতানুসারে নাগরিকের লক্ষণ হল রাষ্ট্রনৈতিক জকর্মে অংশগ্রহণ করা। আর এক ফরাসী দার্শনিক বদ্যা (Bodin) -এর মতানুসারে যাঁরা নগর জীবনের কতকগুলি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তাঁরাই হলেন নাগরিক। বদ্যা নাগরিকের কর্তব্যের ব্যাপারে কিছু বলেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাচীন ধারণায় নাগরিকতাকে একটি অধিকার হিসাবে দেখান হয়েছে। মানুষের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্যমূলক আলোচনার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে এই অধিকার সকলে অর্জন করতে সক্ষম নয়।

নাগরিকতা সম্পর্কিত আধুনিক ধারণা:

বর্তমানে নাগরিক শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য রাষ্ট্রীয় কার্যে অংশগ্রহণ আবশ্যিক নয়। নাগরিকতা সম্পর্কিত আধুনিক ধারণায় সাম্যের নীতির প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। নাগরিকতার আধুনিক ধারণার সঙ্গে সমাজবোধ, কর্তব্যবোধ, আনুগত্য প্রভৃতি যুক্ত। রাষ্ট্রের প্রতি যারা আনুগত্য স্বীকার করে, আইনানুসারে রাষ্ট্রের সভ্য হিসাবে গণ্য হয় এবং রাষ্ট্রের সকল অধিকার ভোগ করে, তাদেরই নাগরিক বলা হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, রাষ্ট্র কর্তৃক সভ্য হিসাবে স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার ভোগ হল নাগরিকের বৈশিষ্ট্য।

নাগরিকতা সম্পর্কিত ল্যাস্কির ধারণা:

রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকগণ আনুগত্য প্রদর্শন করে। তার বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা কতকগুলো সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকার লাভ করে। আনুগত্য প্রদর্শন ছাড়াও অন্যান্য কর্তব্য পালনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সেবা করা নাগরিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই সমস্ত কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করার জন্য নাগরিকের বুদ্ধিবৃত্তি, মানসিক শক্তি ও নৈতিক গুণাবলীর প্রসার প্রয়োজন। নাগরিকের গুণগত যোগ্যতার উন্নয়ন আবশ্যক। তাই বলা হয় যে, উপযুক্ত জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে রাষ্ট্রের মঙ্গলবিধানের সহজাত ক্ষমতাকে বলে নাগরিকতা। অধ্যাপক ল্যাস্কি (Laski) বলেছেন : ‘নাগরিকতা হল জনগণের কল্যাণের জন্য নিজ সুচিন্তিত বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ” “(Citizenship is the contribution of one’s instructed judgement to the public good.”)। ভারতীয় চিন্তাবিদ শ্রীনিবাস শাস্ত্রীর মতে, ‘যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সভ্য এবং রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে পরিপূর্ণভাবে আত্মবিকাশের জন্য সচেষ্ট এবং সমাজের সার্বিক মঙ্গল সম্পর্কে সচেতন, তাকেই নাগরিক আখ্যা দেওয়া হয়।”

নাগরিকের সংজ্ঞা:

নাগরিকরা যেমন রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে, তাদের তেমনি কিছু কর্তব্যও পালন করতে হয়। পরিপূর্ণ অর্থে নাগরিক হল রাষ্ট্রের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী ব্যক্তি, যে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সকল অধিকার ভোগ করে এবং সমাজের সার্বিক মঙ্গলের জন্য তার সুচিন্তিত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে। সংক্ষেপে ‘রাষ্ট্র-সংস্থার সদস্য’-কেই নাগরিক বলা হয়।

সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ নাগরিক: নাগরিকদের আবার ‘সম্পূর্ণ নাগরিক’ (full-fledged citizen) এবং ‘অসম্পূর্ণ নাগরিক’ (semi-citizen) এই দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। পূর্ণ নাগরিকগণ ভোটাধিকার সমেত রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিকের সকল অধিকার ভোগ করেন। আর অসম্পূর্ণ নাগরিকের ভোটাধিকার থাকে না।