খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপের বিশাল জায়গা জুড়ে যে সামন্ততন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটে তাকেই ইতিহাসবিদ এফ. এল. গানশ (F. L. Ganshof) ধ্রুপদি যুগের সামন্ততন্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন৷
উৎপত্তি সংক্রান্ত বিতর্ক: ধ্রুপদি যুগের সামন্ততন্ত্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে রােমান না জার্মানকোন্ উপাদান সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা নিয়ে ফ্রান্সে সমগ্র অষ্টাদশ শতক জুড়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক চলছে। নীচে এবিষয়ে ইতিহাসের পণ্ডিতদের অভিমত দেওয়া হল।
-
আবে দুবো-র অভিমত: ‘রােমান তত্ত্ব-এর প্রবক্তা আবে দুবাে মনে করেন যে, প্রাচীন রােমে ‘অনুগামী পৃষ্ঠপােষক প্রথায় (Client Patronage System) কোনাে সন্ত্রান্ত ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্য, উত্তরসূরি, এমনকি বাইরের কিছু লােকের ওপরও চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। এই পৃষ্ঠপােষক প্রথা থেকেই ধ্রুপদি যুগের সামন্তপ্রথার উদ্ভব ঘটেছিল বলে তার মত।
-
বােলাভিয়ের-এর অভিমত: ‘জার্মান তত্ত্ব-এর প্রবক্তা বােলাভিয়ের (Boulainvilliers) মনে করেন যে, ধুপদি যুগে ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল জার্মানির কমিটেটাস (Comitatus) প্রথা থেকে, যে প্রথায় কিছু স্বাধীন যােদ্ধা স্বেচ্ছায় কোনাে উপদলীয় নেতার অধীনতা মেনে তার স্বার্থপূরণের অঙ্গীকার করত| মন্তেস্কুও মনে করেন যে, ইউরােপে জার্মান আক্রমণের ফলেই সামন্ততন্ত্রের জন্ম হয়েছিল।
বাস্তবিকপক্ষে রােমান ও জার্মান—এই দুটি উপাদানই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ইতিহাসবিদ মার্ক ব্লখ তাঁর ‘ফিউডাল সোসাইটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মধ্যযুগে ইউরােপে পৃথক দুটি সামন্ততান্ত্রিক যুগ এসেছিল- [1] প্রথম সামন্ততান্ত্রিক যুগ, [2] দ্বিতীয় সামন্ততান্ত্রিক যুগ। এই দুটি যুগের মধ্যে যথেষ্ট চরিত্রগত পার্থক্য ছিল।
[1] প্রথম সামন্ততান্ত্রিক যুগের বৈশিষ্ট্য: প্রথম সামন্ততান্ত্রিক যুগে (খ্রিস্টীয় নবম-দশক শতক) ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যার সঠিক হিসেব না পাওয়া গেলেও এই সংখ্যা পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে অনেক কম ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এযুগের বৃহৎ শহরগুলির জনসংখ্যাও মাত্র কয়েক হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং বসতির চারিদিকে ছিল সুবিস্তৃত পতিত জমি, জঙ্গল, বাগান, কৃষিজমি ইত্যাদি। কৃষি উৎপাদনও হত খুবই কম।
[2] দ্বিতীয় সামন্ততান্ত্রিক যুগের বৈশিষ্ট্য: দ্বিতীয় সামন্ততান্ত্রিক যুগে (খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতক) জনসংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় পতিত জমি, জঙ্গল প্রভৃতি স্থানে বসতির প্রসার ঘটেছিল। এসময় সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির উদ্ভব ঘটতে শুরু করেছিল যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। রাস্তাঘাট, সাঁকো প্রভৃতি নির্মাণ, ঘােড়ার ব্যবহার প্রভৃতির ফলে যাতায়াত ব্যবস্থায় গতি এসেছিল। কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতির অগ্রগতি হলেও তা ছিল সামন্তপ্রভুর নিয়ন্ত্রণে।
উপসংহার: মধ্যযুগের ইউরোপে ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের ক্রমিক অবক্ষয় এবং সামন্ততন্ত্রের প্রসার একই সঙ্গে চলতে থাকে। আধুনিক যুগে মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্র একটি সমালােচিত ব্যবস্থা বলে বিবেচিত হলেও একথা স্বীকার করতেই হয় যে, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই মধ্যযুগে ইউরোপের বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে সফল শাসন পরিচালন সম্ভব হয়েছিল।তা ছাড়া এ সময় রাজার দরবারের গুরুত্ব হ্রাস পেয়ে আলিক সামন্তপ্রভুদের দরবারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল।
Leave a comment