ধর্মমঙ্গল কাব্যে রূপরাম চক্রবর্তী:
সপ্তদশ শতকে আবির্ভূত ধর্মমঙ্গল কাব্যের এক উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর কাব্যের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। লাউসেনের জন্ম থেকে আখড়ায় তাঁর মল্লবিদ্যা শিক্ষা পর্যন্ত কাহিনী-অংশ বর্ণিত হয়েছে। কাব্যটির নাম ‘অনাদিমঙ্গল’।
কবির জন্ম বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত কাইতি শ্রীরামপুর গ্রাম (এই শ্রীরামপুর হুগলী জেলার শ্রীরামপুর নয়)। কবির পিতা শ্রীরাম চক্রবর্তী ছিলেন বড় পণ্ডিত।
কৈশোরে কবির পিতৃবিয়োগ হয়। দাদা রামেশ্বরের রুক্ষ মেজাজে কবি অতিষ্ঠ হয়ে গৃহত্যাগ করে পাষণ্ডা গ্রামে উপস্থিত হন। সেখানে এক ভট্টাচার্যের টোলে আশ্রয় নিয়ে বিদ্যাচর্চা করেন। কোন এক কারণে গুরুর সঙ্গে বিবাদ বাধে এবং কবি গুরুগৃহ থেকে বহিষ্কৃত হন। সেখান থেকে তিনি উপস্থিত হন নবদ্বীপে পলাশনের বিলের কাছে। সেখানে ব্যাঘ্ররূপী ধর্মঠাকুর কবিকে দেখা দিয়ে কাব্যরচনার আদেশ করেন। অসম্মত দ্বিধাগ্রস্ত কবি এরালবাহাদুরপুর গ্রামে আসেন এবং সেখানে গোপভূমের এক গোস্বামী গণেশ রায়ের গৃহে আশ্রয় পান। এই আশ্রয়ে থেকে রূপরাম ‘কাব্য রচনা’ করেন।
এই কাব্যে বর্ণিত কবি রূপরামের আত্মজীবনীতে তৎকালীন সমাজের পরিচয় আছে। কাব্যের কোন কোন পুঁথিতে আছে শাহ সুজার উল্লেখ। কাব্যের রচনাকাল সংশয়াচ্ছন্ন। সমালোচকেরা ১৫৪৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৭১৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের উল্লেখ করেছেন। সেক্ষেত্রে মনে হয় সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে বা অষ্টাদশ শতকের প্রথমে কবি কাব্যরচনা করেছিলেন। এমন কি ‘আদি রূপরাম’ নামে আর এক কবির নাম পাওয়া গেছে।
রূপরামের কবিপ্রতিভা ছিল। তাঁর কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য, ঘরোয়া সুরে কথা বলা। সেইজন্য পাঠক বা শ্রোতা তাঁর কাব্যে সহজেই আকৃষ্ট হয়। আবার পাণ্ডিত্যের পরিচয়ও আছে–
“কপালে সিঁদুর পরে তপন উদয়।
চন্দন চন্দ্রিমা তার কাছে কাছে রয় ।
চন্দ্র কোলে শোভা যেন করে তারাগণ।
ঈষৎ করিয়া দিল বিন্দু বিচক্ষণ ৷৷”
চরিত্রচিত্রণেও তিনি নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ইছাই ঘোষের ভবিষ্যৎ পরাক্রমের কথা যেমন তার বাল্যচিত্রে আভাসিত হয়েছে, তেমনি মহামদ-চরিত্রের বিকৃতি না দেখিয়ে তার মনস্তাত্ত্বিক কারণ নির্দেশ করেছেন। মহামদ তাঁর প্রিয়পাত্রী রঞ্জাবতীর সঙ্গে বৃদ্ধ কর্ণসেনের বিবাহে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর অভিমান-সঞ্জাত স্নেহই তাঁকে লাউসেনের সর্বনাশ সাধনে প্রবৃত্ত করেছিল।
রূপরামের কাব্যে সপ্তদশ শতকের বাংলাদেশের সমাজ-ইতিহাসের আঞ্চলিক পরিচয় পাওয়া যায়; যেমন বিনিময়-মাধ্যম হিসাবে তখন কড়ির প্রচলন ছিল। বাংলাদেশের পণ্ডিতদের টোলে অভিধান, ব্যাকরণ, কালিদাস, পিঙ্গলের ছন্দসূত্র, নব্যন্যায়, মাঘ, মহামতি যাস্কের নিরুক্ত ইত্যাদি কবি ও লেখকের রচনা পড়ানো হত। শিক্ষার কেন্দ্ররূপে প্রসিদ্ধ ছিল নবদ্বীপ, শান্তিপুর, জৌগ্রাম। সামাজিক তির পরিচয় পাওয়া যায় ‘ষেটের ব্রত’, একুশশা এবং অন্নপ্রাশনের উল্লেখে। সংস্কার বা বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় কর্ণসেন ও রঞ্জাবতীর বিবাহ উপলক্ষে মেয়েদের রঞ্জাবতীর চোখে পুরুষ-আকর্ষণকারী মন্ত্রপুতঃ কাজল (দুর্গা পূজায় সংগৃহীত) দানে।
ধর্মমঙ্গল কাব্যে ঘনরাম চক্রবর্তী:
ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার সর্বজনপরিচিত কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর জন্ম পরিচয় স্বল্প, তুলনায় তার ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্যের আয়তন এবং ইতিবৃত্ত সুবিস্তৃত। অষ্টাদশ শতকে আবির্ভূত এই কবি সম্পর্কে সবিশেষ সংবাদ দিয়েছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন এবং ড. সুকুমার সেন। বর্ধমান জেলার দামোদর নদের তীরে অবস্থিত কইয়ড় পরগনা অন্তর্গত বাঁকুড়া কৃষ্ণপুর গ্রামে ১৬৬৯ খ্রীস্টাব্দে কবির জন্ম হয়। পিতার নাম গৌরীকান্ত, মাতার নাম সীতাদেবী। কবি শৈশবে অত্যন্ত দুরস্ত ছিলেন। কবির পিতা গৌরীকান্ত তাকে রামপুরের টোলে পাঠান। সেখানে সুসংসর্গে ঘনরামের স্বভাবের পরিবর্তন হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন :–
“অখিল বিদ্যার কীর্ত্তি মহারাজ চক্রবর্তী
কীর্ত্তিচন্দ্র নরেন্দ্র প্রধান।
চিন্তি তার রাজোন্নতি কৃষ্ণপুর নিবসতি
দ্বিজ ঘনরাম রস গান ।”
মহারাজা কীর্তিচন্দ্র ছিলেন সম্ভবত কবির পৃষ্ঠপোষক।
“শক লিখে রাম গুণ রস সুধাকর” ইত্যাদি গ্রন্থে উল্লিখিত শ্লোক দেখে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেন, ঘনরামের কাব্য সমাপ্তির কাল ১৬৩৩ শকাব্দ বা ১৭১১ খ্রীস্টাব্দের ২রা নভেম্বর। অবশ্য এই সময়ের উল্লেখ করা হয়েছিল সমাপ্তির অনতি-পূর্ববর্তী মুহূর্তে। কবি ‘সত্যনারায়ণ পাঁচালী’ও রচনা করেছিলেন বলে জানা গেছে। তিনি ‘কবিরত্ন’ উপাধি পেয়েছিলেন। তার সম্পর্কিত জীবনীকথায় ঘনরামের ব্যক্তি-বিবরণ বিরলদৃষ্ট। সেখানে আছে কবির গুরু ভট্টাচার্যের কথা, নীলাচলগমন, রামচন্দ্রের দর্শনলাভ। গুরুর নির্দেশমতো রামায়ণ রচনার চেষ্টা, শেষে ধর্মমঙ্গল লেখার নির্দেশ প্রাপ্তি ইত্যাদি তথ্য সমূহ।
ঘনরামের কাব্যের নাম ‘অনাদিমঙ্গল’। তবে অনেক স্থলে ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘মধুরভারতী’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত। কাব্যটি ২৪টি সর্গে ও বিভিন্ন পালায় বিন্যস্ত। মোট শ্লোক সংখ্যা ৯১৪৭। কাহিনী দুটি অংশে বিভক্ত (ক) হরিশ্চন্দ্র-লুইচন্দ্রের কাহিনী। (খ) লাউসেনের কাহিনী। কাব্যের আয়তন প্রায় মহাকাব্যের মতো বিশাল। যদিও ভাবগাম্ভীর্যে ও রচনার ভঙ্গীতে পাঁচালীর চিহ্ন সুস্পষ্ট।
কাব্যের স্থাপন-পালায় “নবীন নীরদশ্যাম জিনি কত কোটি কাম” ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে তার প্রেম, জলরাশির উপর তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং শেষ প্রস্থানের চিত্ররূপ বর্ণনায় জীবন্ত। কিন্তু কবি-দৃষ্টি রোমান্টিক কল্পনায় ভাবস্নাত হয় নি। বরং লাউসেনের পৌরুষদীপ্ত জীবনের পরিচয়ে, তার যোদ্ধারূপের বিবরণে এই কাব্য উদ্দীপ্ত হয়েছে। যুদ্ধ বর্ণনায় কবি ঘনরামের শব্দ সচেতন কল্পনাশক্তি পাঠককে বিস্মিত করে–
“টন্ টান্ ঠন্ ঠান্ঢা ল চাল ঢন ঢন
ঝন ঝান্ ঘন রণ নাদ।
দেখিতে বিপরীত চৌদিকে চমকিত
মামুদা ভাবে পরমাদ ৷৷”
ধর্মের বরপুত্র লাউসেন যেমন বীর যোদ্ধা তেমনি মানবিক গুণে মণ্ডিত। পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা, ধর্মপক্ষে নিষ্ঠা, নির্ভীকতা এবং চরিত্ররক্ষার শুচিতায় সদা-ভাস্বর। লাউসেন জননী রঞ্জাবতী স্নেহময়ী পুত্রের কল্যাণ কামনায় মগ্ন মাতৃমূর্তি–
“কালি অতি শুভদিন গৌড়ে তুমি যাবে।
অভাগীর রন্ধন বাপু আজি কিছু খাবে ।”
পক্ষান্তরে, লাউসেন-জায়া কলিঙ্গা ও কানাড়ার মধ্যে বীরত্বের দিকটিকে যথোচিত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শঠতা, ক্রূরতা ও প্রতিহিংসায় মহামদ চরিত্রটিও চিত্তাকর্ষক হয়েছে। দুর্মুর্খা দাসী, কালুসেন, লখাই ডোম, হরিহর বাইতি প্রভৃতি অপ্রধান চরিত্র নির্মাণেও কবি ঘনরাম বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যেমন অর্থলোভী হরিহরের স্ত্রীর প্রতি উক্তি–
“হরিহর বলে শুন বাইতির ঝি।
বসে কর বিলাস তোমার লাগে কি !!
ধন হতে ধরম ধরণী ধন্য লোকে।
অবলা অবোধ জাতি কি বুঝাব তোকে ৷৷
অধর্মের বাধ্য বসু ধর্মের অকার্য।
আগে পেলাম এত ধন পিছে পাব রাজ্য ।”
লাউসেন-ভ্রাতা কর্পূর সেনের চরিত্র নির্মাণেও কবি দক্ষতা দেখিয়েছেন। জামতিনগরে বন্দী লাউসেনকে দেখে স্বার্থপর কর্পূর পালিয়ে যায়, পরে লাউসেন মুক্ত হলে সে ফিরে এসে দাদাকে বলে :–
“কাদিয়া কর্পূর সেনে করেন জিজ্ঞাসা।
কালি কোথা ছিলে ভাই কিবা দশা ৷৷
কর্পূর বলেন যবে বন্দী হলে ভাই।
রাতারাতি গেছিনু ধাওয়া ধাই ।।
রাজার আদ্দানা করি জামতি লুঠিতে।
লয়ে আসি লক্ষ সেনা পথে আচম্বিতে ৷৷
পথে শুনি বিজয়, বিদায় দেনু ভাই।
লাউসেন বলে তোরে বলিহারি যাই !!”
ধর্মমঙ্গল মুখ্যত বীররসাত্মক কাব্য। তাই বীররসের প্রাধান্য এই কাব্যে বিশেষভাবে দেখা যায়; যেমন–
“মার মার বলি ডাক ছাড়েন ভবানী।
সেনাগণ দানাগণ সমরে নিদারুণ
দুদল করে হানাহানি ॥”
বীভৎস রসের বর্ণনায়ও শক্তিমত্তার পরিচয় আছে। যেমন ডাকিনী প্রেতিনীরা–
“কাঁচা মাংস খায় কেহ ভাজা ঝোলে ঝালে।
মানুষের গোটা মাথা কেহ ভরে গালে ॥”
কিন্তু করুণ রসের বর্ণনায় আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস–
“শিঙ্গাদার ওরে ভাই এই ছিল আমার কপালে।
নিশায় নিধন রণে, পিতামাতা বন্ধুগণে
দেখিতে না পেনু শেষকালে ॥”
ঘনরামের রচনারীতি সংস্কৃত-নির্ভর ও মার্জিত। তাঁর কৌতুকরসে স্থূলতা থাকলেও ভাড়ামী বা ইতরতা নেই, বরং তির্যকতা আছে।
“চঞ্চল চরণ চারি চলনি”
নির্মল বরণ বাড়ী বিনোদমন্দির”
প্রভৃতি অনুপ্রাস অলঙ্কারে তাঁর কল্পনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
উপরোক্ত দৃষ্টান্ত যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া গেলেও দেখা যায় ঘনরামের কাব্য ত্রুটিমুক্ত নয়। এই কাব্যের ত্রুটি দেখা যায় :–
- (ক) বিশাল আয়তন এবং সুবিপুল ঘটনাসমূহ সুগ্রথিত করে প্রকাশের মতো উপযুক্ত কবিত্ব শক্তি ও নৈপুণ্যের অভাব।
- (খ) অলৌকিক ঘটনা সমাবেশের ফলে কাব্যটির প্রধান চরিত্র লাউসেনের বীরত্ব ও শক্তিপ্রকাশ অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলে মনে হয়; যেমন তার মৃত শিশুর মুখ দিয়ে কথা বলানো, নিজের মৃত সৈন্যদের পুনর্জীবিত করা, পশ্চিমে সূর্যোদয় দেখানো ইত্যাদি।
- (গ) শাস্ত্রের অতিরিক্ত দৃষ্টান্তদানে কবির নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা অব্যক্ত থেকে যায়।
- (ঘ) বর্ণনার মধ্যে এক যুদ্ধপ্রসঙ্গ ছাড়া অন্যত্র ক্লান্তিকর নীরস বিবৃতি চোখে পড়ে।
তবে সমকালের রাঢ়বঙ্গের সমাজজীবনের বাস্তব পরিচয়ে এই কাব্যের ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। ধর্মমঙ্গল কাব্যসমূহের মধ্যে ঘনরামের গ্রন্থই প্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে।
Leave a comment