উপস্থাপনাঃ কুতুবুদ্দিন আইবেকের পর সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ ছিলেন দিল্লী সালতানাতের সর্বশেষ দক্ষ, যােগ্য ও কৃতী সুলতান। তিনি ক্রীতদাস হিসেবে জীবন শুরু করলেও স্বীয় প্রচেষ্টা, অধ্যবসায়, বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে সাফল্যের সােনালি শিখরে পৌঁছে সালতানাতের ভিত্তি স্থিতিশীল ও সুসংহত করেছিলেন।
ইলতুৎমিশের কৃতিত্বঃ
১. সিংহাসনারােহণঃ ১২১০ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবেকের ইন্তেকালের পর তার অযােগ্য পুত্র আরাম শাহ সিংহাসন লাভ করেন, কিন্তু তার অযােগ্যতার কারণে আমীর ওমরারা তার বিরােধিতা করে ইলতুৎমিশকে ক্ষমতা দখলের জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমীর ওমরাদের আনুকূল্যে ১২১১ সালে তিনি সুলতান শাহ ইলতুৎমিশ নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।
২. দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাঃ সুলতান ইলতুৎমিশ Real founder of the Delhi Sultans. এক সংকটময় মুহূর্তে ক্ষমতায় আরােহণ করে স্বীয় প্রতিভা, সামর্থ্য, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা দ্বারা তিনি পরিস্থিতি মােকাবেলা করে দিল্লী সালতানাতকে রক্ষা করেন। ড. করিম বলেন, ইলতুৎমিশকে উত্তর ভারতীয় মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বললেও অত্যুক্তি হবে না।
৩. বিদ্রোহ দমন ও সংহতি স্থাপনঃ ইলতুৎমিশ সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমীর ওমরাদের বিদ্রোহ এবং গজনীর শাসনকর্তা তাজুদ্দিন ইয়ালদুজের বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও দক্ষতার সাথে দমন করে সাম্রাজ্যে সুদৃঢ় সংহতি স্থাপন করেন। তিনি সকল বিদ্রোহ দমন করে অযােধ্যা, বেনারস, বদায়ুন, সিউয়ালিক প্রভৃতি অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করেন।
৪. সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনঃ তিনি গােটা সালতানাতকে কতগুলাে ইকতায় বিভক্ত করে প্রত্যেক দপ্তরে একজন করে কর্মকর্তা নিয়ােগ করেন। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থা ও অর্থ বিভাগ পুনর্গঠন করেন।
৫. আরবি মুদ্রার প্রচলনঃ সুলতান ইলতুৎমিশই সর্বপ্রথম দিল্লী সালতানাতে খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রচলন করেন। তিনি আধুনিক রূপার টাকার মতাে মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন।
৬. স্থাপত্য শিল্পকলার উন্নয়নঃ ইলতুৎমিশ উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। রাজ্যের অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, প্রাসাদ, অট্টালিকা আজমীরের আড়াই দিনকা ঝােপড়া মসজিদ, বাদায়ুনের ঈদগাহ ও দিল্লীর বিখ্যাত কুতুব মিনার প্রভৃতি ইলতুৎমিশের স্থাপত্য শিল্পকলায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে।
৭. যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ ইলতুৎমিশ যােগাযােগ ব্যবস্থার সুবিধার জন্য রাজ্যে বহু রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ এবং সাম্রাজ্যের বহু বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চোর-ডাকাতদের আশ্রয়স্থল নির্মূল করেন।
৮. খলিফার স্বীকৃতিঃ ইলতুৎমিশের উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব হলাে বাগদাদের আব্বাসী খলিফা আল মুনতাসির বিল্লাহর নিকট থেকে ১২২৯ সালে সুলতানে আযম খেতাবপ্রাপ্তি ও স্বীকৃতি।
৯. মােঙ্গল সমস্যা সমাধানঃ ১২২১ সালে মােঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান ভারত আক্রমণ করতে অগ্রসর হলে ইলতুৎমিশ কূটনৈতিক প্রতিভাবলে মােঙ্গলদের আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করেন।
১০. অন্যান্য গুণাবলিঃ ইলতুৎমিশ অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সাহসী সুলতান ছিলেন। তিনি একে একে সালতানাতের সকল শত্রুকে দমন করেন। তার চেষ্টায় প্রাথমিক দিল্লী সালতানাত সকল আপদ-বিপদ কাটিয়ে উঠে। তিনি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান এবং এর সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তিনি ন্যায়বিচারক ও জ্ঞানী গুণীর পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তিনি ছিলেন দিল্লী সালতানাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান।
ইলতুৎমিশের চরিত্রঃ
১. দাসত্বের জিন্দেগীঃ তুর্কি বংশােদ্ভূত ইলতুৎমিশ প্রাথমিক জীবনে বােখারার প্রধান কাযীর তত্ত্বাবধানে দাসত্বের জীবন শুরু করেন। কাযী পরিবারেই তিনি সাহিত্য, ধনুর্বিদ্যা ও সামরিক বিদ্যায় শিক্ষিত হন।
২. কুতুবুদ্দিনের কন্যাকে বিবাহঃ ক্রীতদাস প্রথার নিয়মানুসারে ইলতুৎমিশ কাযী পরিবার থেকে কুতুব পরিবারে আসেন। স্বীয় মেধা, যােগ্যতা, বিচক্ষণতা ও অন্যান্য প্রতিভা গুণে তিনি আইবেকের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। ফলে কুতুবুদ্দিন নিজ কন্যাকে ইলতুৎমিশের সাথে বিয়ে দেন।
৩. ধর্মভীরুঃ সুলতান ইলতুৎমিশের ধর্মভীরুতা ছিল সর্বজনবিদিত। তিনি আলেমদের আন্তরিকতার সাথে শ্রদ্ধা করতেন।
৪. শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকঃ শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে ইলতুৎমিশের নাম গৌরবােজ্জ্বল। তিনি দিল্লীকে ইসলামী সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে পরিণত করেন।
৫. অনুপম চরিত্রের অধিকারীঃ ইলতুৎমিশ ছিলেন উন্নত ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী। তিনি সুচতুর, নির্ভীক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন।
৬. দয়াপ্রবণ ইলতুৎমিশঃ উদারতা ও মহানুভবতা ইলতুৎমিশের চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল। কুতুবুদ্দিনের চাইতেও তিনি অধিক দানশীল ছিলেন। তিনি শত বিপদ আপদেও জনকল্যাণে ব্যস্ত থাকতেন।
৭. ন্যায়বিচারকঃ ইলতুৎমিশের বিচারকার্য ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে পরিচালিত হতাে। সমাজের উঁচু-নীচু সকলে তার কাছ থেকে সুবিচার পেত।
উপসংহারঃ ইলতুৎমিশ নিঃসন্দেহে একজন আদর্শবান ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন। ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সালতানাতের শৈশবাবস্থায় একে রক্ষা করার কৃতিত্ব ইলতুৎমিশেরই প্রাপ্য।
Leave a comment