রাজনীতিক দলের কাজকর্ম পরিচালনার পদ্ধতি এবং দলের আচরণ দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। রাজনীতিক দলের কার্যাবলী দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। কারণ দলীয় ব্যবস্থার মধ্যেই রাজনীতিক দলকে তার কাজকর্ম সম্পাদন করতে হয়। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Parties operate within party systems and the type of system will have profound effects on party behaviour.” তাঁর অভিমত অনুসারে বিভিন্নভাবে রাজনীতিক দলের শ্রেণী বিভাজন করা হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন একটি মানদণ্ডের সাহায্যে রাজনীতিক দলের শ্রেণীবিভাজন দুরূহ ব্যাপার। তবে দলীয় ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে কার্যকর তিনটি ভিত্তি হল:-

  • (১) দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে দলের সংখ্যা (“numbers of parties within the party system”); 

  • (২) দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে রাজনীতিক দলগুলির সাংগঠনিক কাঠামো (“The structures of parties within the party system”); এবং 

  • (৩) দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে রাজনীতিক দলগুলির আনুপাতিক শক্তি (“The relative strengths of the political parties within the party system”)। 

তবে রাজনীতিক দলের শ্রেণীবিভাজনের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত তিনটি মানদণ্ডের যে কোনটি এককভাবে ত্রুটিযুক্ত এবং বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ। বল বলেছেন: “… each of these taken as the sole criterion of classification reveals major weakness.”

রাষ্ট্রনীতিক দলের সংখ্যাগত শ্রেণী-বিভাজন:

সংখ্যাগত বিচারে দলীয় ব্যবস্থা তিন ধরনের হতে পারে। এই তিন ধরনের দলীয় ব্যবস্থা হল:

  • এক দলীয় ব্যবস্থা,
  • দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা এবং
  • বহু দলীয় ব্যবস্থা।

সংখ্যার দিক থেকে দলীয় ব্যবস্থার এই শ্রেণীবিভাজনই ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কিন্তু সংখ্যাগত বিচারে রাজনীতিক দলের এই শ্রেণীবিভাজনের নানা সমস্যা আছে। কোন দেশের দলীয় ব্যবস্থায় একই সংখ্যক রাজনীতিক দল থাকতে পারে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য থাকতে পারে। বল বলেছেন: “…it is important to remember that there are important differences amongst party systems with the same member of parties.” এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কিন ও ব্রিটিশ দলীয় ব্যবস্থার কথা বলা যায়। এই দুটি দেশেই জাতীয় পর্যায়ে দুটি প্রধান রাজনীতিক দল বর্তমান। এতদসত্ত্বেও উভয় দেশের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

এক-দলীয় ব্যবস্থা:

সংখ্যাগত বিচারে দলীয় ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনের সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধা অনস্বীকার্য। রাজনীতিক দলের সংখ্যার দিক থেকে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইজিপ্ট ও তাঞ্জানিয়ায় একদলীয় ব্যবস্থা বর্তমান। তাঞ্জানিয়ায় নির্বাচনে একটি মাত্র রাজনীতিক দলকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ঐ একটিমাত্র দলের কাঠামোর মধ্যেই প্রতিন্দ্বিতার সুযোগ সীমাবদ্ধ। কিন্তু নির্বাচকরা নির্বাচনে বিশিষ্ট দলীয় নেতাদের পরাস্ত করতে পারে। তাঞ্জানিয়ায় এই রকম এক দলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক-দলীয় ব্যবস্থার তুলনা চলে না। কারণ পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক-দলীয় ব্যবস্থা ছিল অনেক বেশী কর্তৃত্বমূলক এবং সামগ্রিকতাবাদী। বস্তুত বিভিন্ন দেশের এই এক-দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে কার্যগত ও প্রকৃতিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাঞ্জানিয়ার মত কেনিয়াতেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি মাত্র রাজনীতিক দলের কাঠামোর মধ্যেই নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ সীমাবদ্ধ। মিশরেও একমাত্র স্বীকৃত রাজনীতিক দল হল সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন। এবং ফ্রাঙ্কোর ফ্যালাঞ্জেই হল স্পেনের একমাত্র স্বীকৃত রাজনীতিক দল। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসাবে হিটলারের নাৎসি দল এবং মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দলের কথা বলা যায়। কিন্তু এই দুটি দলের এক-দলীয় ব্যবস্থা হল সামগ্রিকতাবাদী। তখন এই দুটি দেশে উল্লিখিত দুটি দলের রাজনীতিক মতাদর্শই ছিল চরম ও চূড়ান্ত। সমগ্র দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থা দলের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। সকল রাজনীতিক নিয়োগও শাসকদলের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। এ ক্ষেত্রে তুলনীয় হিসাবে অনেকে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট দলের কথা বলে থাকেন। সুতরাং বিভিন্ন দেশে এক-দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলী ও প্রকৃতিগত পার্থক্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।

দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা:

কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় সুস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বর্তমান থাকলে দলীয় কাঠামোতে এককেন্দ্রিক প্রবণতা দেখা দিতে পারে। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলগুলি শ্রেণীভিত্তিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের দলীয় ব্যবস্থায় অন্যান্য ছোট ছোট রাজনীতিক দল থাকতে পারে। তবে তাদের সাহায্য সমর্থন না নিয়েই বড় একটি দল সরকার গঠনে সমর্থ হয়। অ্যালান বল-এর অভিমত অনুসারে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় দুটি প্রধান রাজনীতিক দল থাকে। কিন্তু তৃতীয় এবং ছোট রাজনীতিক দলগুলি আইনসভায় রাজনীতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে। উদাহরণ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “The small West German Free Democratic Party, holding the balance between the larger Social Democrats and Christian Democrats in the Bundestag, provides one example.” তিনি আরও বলেছেন: “Australia is an example of two-party system, but the largest party, the liberal party, is in permanent alliance with the small Country Party, and this alliance has been usually successful against the Australian Labour Party.” বলের মতানুসারে ব্রিটিশ ব্যবস্থাকেও একটি সুস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা হিসাবে অভিহিত করা যায় না। গ্রেট ব্রিটেনে ১৯৭৪ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়। এই মধ্যবর্তী নির্বাচনে উদারনীতিক দলের প্রভাব প্রতিপত্তি অতি মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা ব্রিটেনের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার অনুপন্থী ছিল না। তা ছাড়া গ্রেট ব্রিটেনে রক্ষণশীল দল এবং শ্রমিক দল ছাড়াও অন্যান্য রাজনীতিক দলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থাও দ্বি-দলীয় প্রকৃতিযুক্ত। কিন্তু মার্কিন দলীয় ব্যবস্থায়ও গণতন্ত্রী এবং সাধারণতন্ত্রী দল ছাড়াও অন্যান্য রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব বর্তমান।

বহু-দলীয় ব্যবস্থা:

বহু-দলীয় ব্যবস্থায় দু-এর অধিক রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত। এই ধরনের দলীয় ব্যবস্থায় দু-এর বেশী রাজনীতিক দল আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব অর্জন করে। বহু-দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ইতালী, ফ্রান্স, ভারত প্রভৃতি দেশের রাজনীতিক দল-ব্যবস্থার কথা বলা যায়। দুটির বেশী রাজনীতিক দল থাকলেও বহুদলীয় ব্যবস্থা অনেক সময় সুস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা হিসাবে প্রতীয়মান হয়। বহু-দলীয় ব্যবস্থা যদি অস্থায়ী হয়, তাহলে সরকারের স্থায়িত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বহু-দলীয় ব্যবস্থায় অনেক সময় কোয়ালিশন সরকার, আবার অনেক সময় এক-দলীয় সরকার গঠিত হয়। অ্যালান বলের অভিমত অনুসারে সংখ্যাগত বিচারে বহুদলীয় ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাজনও কম বিভ্রান্তিকর নয়। তিনি বলেছেন: “…the difficulty of classification by members is most apparent here.” ডেনমার্ক ও নেদারল্যাণ্ডে যথাক্রমে দশটি ও চৌদ্দটি রাজনীতিক দল বর্তমান। এই সমস্ত দেশে কোয়ালিশন সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করে। বল বলেছেন: “… the Swedish Social Democrats often governed alone, opposed by the three right-of-centre parties, the Liberals, Conservative and Agrarian Parties. Italy has a multi party system, but in terms of distribution of seats and votes there are similarities with the British party system;….”

সংখ্যার ভিত্তিতে রাজনীতিক দলের এই শ্রেণীবিভাজন বর্তমানে অবৈজ্ঞানিক, অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। রাজনীতিক দলের সংখ্যাগত বিচারে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, ফ্যাসিবাদী ইতালী, মিশর, তানজানিয়া প্রভৃতি দেশের দলব্যবস্থা হল এক-দলীয়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা দ্বি-দলীয় এবং ভারত ও ফ্রান্সের দলীয় ব্যবস্থা বহুদলীয় কিন্তু এক দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে যে সকল দেশের দলীয় ব্যবস্থার কথা বলা হল সেই সমস্ত দেশের দলীয় মতাদর্শ, সাংগঠনিক কাঠামো, জনসমর্থন প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য বর্তমান। এই সমস্ত দেশের দলীয় ব্যবস্থাকে একই শ্রেণীভুক্ত করা যায় না। যেমন, সাম্যবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থা এবং ফ্যাসিবাদী এক দলীয় ব্যবস্থা এক নয়। উভয়ের মধ্যে আকৃতি ও প্রকৃতিগত মৌলিক পার্থক্য আছে। সুতরাং গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের এক দলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের এক দলীয় ব্যবস্থাকে এক করা যায় না। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও প্রকৃতিগত পার্থক্যকে অস্বীকার করা যায় না। তেমনি ভারত ও ফ্রান্সের বহু-দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

ব্যাপক ভিত্তিতে রাষ্ট্রনীতিক দলের শ্রেণীবিভাজন:

অনেকে ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলীয় ব্যবস্থাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন। প্রতিযোগিতামূলক (Competitive) এবং অপ্রতিযোগিতামূলক (Non-competitive)। আবার অনেকে দলীয় ব্যবস্থাকে উদারনীতিক দলীয় ব্যবস্থা (Liberal Democratic Party System) এবং সর্বাত্মক দলীয় ব্যবস্থা (Totalitarian Party System)—এই দু’ভাগে বিভক্ত করেন। কিন্তু রাজনীতিক দলের এই শ্রেণীবিভাজনও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। কারণ শ্রেণীবিভাজনের এই ভিত্তি অতিমাত্রায় ব্যাপক।

অ্যালমণ্ডের শ্রেণীবিভাগ:

অ্যালমণ্ড (G. A. Almond) দলীয় ব্যবস্থাকে নিম্নলিখিতভাবে শ্রেণীবিভাগ করেছেন।

  • (ক) অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা: অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আয়ারল্যাণ্ড; 

  • (খ) সুস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা : এই ধরনের দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হল ইংল্যাণ্ড ও অস্ট্রেলিয়া; 

  • (গ) কার্যকরী বহু-দলীয় ব্যবস্থা : কার্যকরী বহুদলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হল নরওয়ে ও সুইডেন; 

  • (ঘ) অস্থায়ী বহু-দলীয় ব্যবস্থা : এই ধরনের দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হল ফ্রান্স ও ইতালী; 

  • (ঙ) প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থাঃ প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হল ভারত ও মালয়; 

  • (চ) এক-দলীয় ব্যবস্থা: এই ধরনের দলীয় ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত হল মিশর ও স্পেন; এবং 

  • (ছ) সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থা : সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত হল গণ প্রজাতন্ত্রী চীন।

অ্যালমণ্ডের এই শ্রেণীবিভাজনও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। বর্তমানে দলীয় ব্যবস্থাকে সাধারণত চারভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এই চারটি ভাগ হল 

  • (১) এক-দলীয় ব্যবস্থা (Single- Party System), 

  • (২) দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (By-party System), 

  • (৩) বহু-দলীয় ব্যবস্থা (Multi-party System), এবং 

  • (৪) প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থা (Dominant Party System)।

রাজনীতিক দলের আধুনিক শ্রেণীবিভাজন:

আধুনিক কালের রাজনীতি বিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতিক দলের শ্রেণীবিভাজন করা হয় বিভিন্নভাবে। তার মধ্যে কতকগুলি শ্রেণীবিভাজন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি হল: 

  • (এক) সাংবিধানিক ও বৈপ্লবিক রাজনীতিক দল (Constitutional and Revolutionary Parties); 

  • (দুই) প্রতিনিধিত্বমূলক ও সংহতিমূলক রাজনীতিক দল (Representa tive and Integrative Parties); 

  • (তিন) দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী রাজনীতিক দল (Right-wing and Left-wing Parties) এবং 

  • (চার) গণ-ভিত্তিক ও ক্যাডার-ভিত্তিক রাজনীতিক দল (Mass-based and Cadre-based Parties)।

(এক) সাংবিধানিক ও বৈপ্লবিক রাজনীতিক দল

উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল ধারার রাজনীতিক দলসমূহ শাসনতান্ত্রিক রাজনীতিক দলের প্রকৃতিসম্পন্ন। শাসনতান্ত্রিক রাজনীতিক দলসমূহ নির্বাচনী প্রতিযোগিতার যাবতীয় বিধি-ব্যবস্থা স্বীকার ও সমর্থন করে। এই দলগুলি জানে যে ভোটের মাধ্যমে তারা যেমন সহজে ক্ষমতাসীন হতে পারে; তেমনি আবার অভিন্ন পথে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। এই দলগুলি স্বীকার করে যে, দল এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজন বর্তমান। ক্ষমতাসীন দল এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বতন্ত্র। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ বলতে বিচারব্যবস্থা, পুলিশী ব্যবস্থা, আমলা ব্যবস্থা প্রভৃতিকে বোঝায়। এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়মানুগ স্বাধীনতা এবং রাজনীতিক নিরপেক্ষতাযুক্ত। সাংবিধানিক রাজনীতিক দলসমূহ নির্ধারিত শাসনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার পরিধির মধ্যে যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে। এই দলগুলি সব সময় অন্যান্য রাজনীতিক দলের বিধিসম্মত অস্তিত্ব এবং আইনানুগ অধিকারসমূহকে স্বীকার করে।

বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী নির্বিশেষে বৈপ্লবিক রাজনীতিক দলমাত্রেই শাসনতন্ত্র বিরোধী বা বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধী। বৈপ্লবিক রাজনীতিক দল মাত্রেরই উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা দখল করা এবং ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোকে উচ্ছেদ করা। বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে উৎপাটিত করার লক্ষ্যে বৈপ্লবিক রাজনীতিক দলসমূহ বিবিধ পথে অগ্রসর হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল প্রচলিত শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, গণ-বিপ্লব, আধা-আইনী কার্যকলাপ প্রভৃতি। এই সমস্ত দল ক্ষমতা দখলের পর বা ক্ষমতাসীন দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনীতিক দল বা শক্তিকে দমিয়ে রাখে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে এক স্থায়ী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। ক্ষমতাসীন দল এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যবধান বহুলাংশে মুছে যায়। ক্ষমতাসীন দলই সরকারের বিকল্প হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। একদলীয় ব্যবস্থায় এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই একদলীয় ব্যবস্থা কমিউনিস্ট, ফ্যাসিবাদী বা জাতীয়তাবাদী যাইহোক না কেন, কমিউনিস্ট একদলীয় ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সরকারের প্রধান বা শাসকপ্রধান হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেন। অনেক সময় বিপ্লবী রাজনীতিক দলকে চরমপন্থী বা গণতন্ত্রবিরোধী বলে আনুষ্ঠানিকভাবে অবৈধ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে জার্মানীতে এ রকম ঘটনা ঘটেছে।

(দুই) প্রতিনিধিত্বমূলক ও সংহতিমূলক রাজনীতিক দল

রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী নিউম্যান তাঁর Modern Political Parties শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক দলকে প্রতিনিধিত্বের দল এবং সংহতির দল—এই দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতিক দল জনমতকে প্রতিফলিত করে, জনমত গঠন করে না। নির্বাচনে ভোট সংগ্রহই হল এই সব দলের প্রাথমিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতিক দল বিবিধ ধরনের উপায় পদ্ধতি অবলম্বন করে। এ রকম রাজনীতিক দল স্বভাবতই বাস্তববাদিতাকে নীতিবোধের ঊর্ধে ঠাই দেয়। আধুনিককালের রাজনীতিক ব্যবস্থায় এ ধরনের রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব প্রতিপন্ন করে যে, রাজনীতিকরা হলেন অতিমাত্রায় ক্ষমতালোভী। নির্বাচনী সাফল্যের জন তাঁরা সর্ববিধ পথে পদচারণা করতে পিছুপা হন না।

বিপরীতক্রমে সংহতিমূলক রাজনীতিক দল অতিসক্রিয়তার পরিবর্তে পেশাদার রাজনীতিক কৌশল অবলম্বন করে। সংহতিমূলক দল কেবলমাত্র জনসাধারণের বিষয়াদিতেই সাড়া দেয় এমন নয়; আমজনতাকে শিক্ষিত, পরিচালিত ও উজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Although Newmann saw the typical mobilizing party as an ideologically disciplined cadre party, mass parties may also exhibit mobilizing tendencies. For example, until they became discouraged by electoral failure, socialist parties set out to ‘win over’ the electorate to a belief in the benefits of public ownership, full employment, redistribution, social welfare and so on.”

(তিন) দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী রাজনীতিক দল

মতাদর্শগত ভিত্তিতে রাজনীতিক দলের শ্রেণীবিভাজন করা হয়। মতাদর্শগত আনুগত্য অনুযায়ী দু’ধরনের রাজনীতিক দলের কথা বলা হয়: দক্ষিণপন্থী দল এবং বামপন্থী দল। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক দল স্থিতাবস্থা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী। দক্ষিণপন্থী দল বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে বজায় রাখার পক্ষে। সাধারণত রক্ষণশীল এবং ফ্যাসিবাদী দল দক্ষিণপন্থী দল হিসাবে পরিগণিত হয়। সাধারণভাবে ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহের মধ্যে দক্ষিণপন্থী দলের সমর্থকদের দেখা যায়। বামপন্থী দলসমূহ পরিবর্তনের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। সামাজিক সংস্কার সাধন বা সামগ্রিক আর্থনীতিক রূপান্তর সাধন বামপন্থী রাজনীতিক দলের বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়। সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং প্রগতিশীল দলগুলিই বামপন্থী দল হিসাবে পরিগণিত হয়। সমাজের অসুবিধাজনক অবস্থায় অবস্থিত, দীনদরিদ্র এবং শ্রমজীবী জনতার মধ্যেই বামপন্থী দলের সমর্থকদের পাওয়া যায়।

রাজনীতিক দলকে এভাবে সম্পূর্ণভাবে দক্ষিণপন্থী এবং পুরোপুরি বামপন্থী এই দুইভাগে ভাগ করাটা হল অতি সাধারণীকৃত বিভাজন। এই বিভাজন বিভ্রান্তিকরও বটে। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী রাজনীতিক দলসমূহের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য অনেকাংশে আবছা হয়ে যায়। নির্বাচনী সাফল্য এবং ভোট জোগাড়ের দায়বদ্ধতার কারণে মতাদর্শগত আনুগত্য অনেকাংশে অস্পষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা হয় যে, গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিক দল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নির্বাচনী সমর্থন সংগ্রহের বাসনায় মতাদর্শগত বিচারে মধ্যপস্থা গ্রহণ করেছে এবং নিজেকে নতুন শ্রমিক দল হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে। বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী সম্পর্কিত সাবেকি বিভাজনের ভিত্তি বর্তমানে বহুলাংশে বাহুল্য বলে বিবেচিত হয়। আগেকার শ্রেণী মেরু করণ অধুনা অনেকাংশে অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। সাম্প্রতিক কালে অনেক নতুন নতুন রাজনীতিক ইস্যুর সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মানবাধিকার, পরিবেশ, নারীবাদ, প্রাণীদের অধিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: “Not only are both the left and the right often divided along reformist/revolutionary and constitutional/insurrectionary lines, but also all parties, especially constitutional ones, tended to be ‘broad churches in the sense that they encompass their own left and right wings.”

(চার) গণ-ভিত্তিক ও ক্যাডার-ভিত্তিক রাজনীতিক দল

গণ-ভিত্তিক রাজনীতিক দল সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে সদস্যপদের পরিধির সম্প্রসারণ এবং ব্যাপকতর নির্বাচনী ভিত্তি গড়ে তোলার উপর। এই সমস্ত রাজনীতিক দল রাজনীতিক মতাদর্শ বা বিশ্বাসের উপর খুব বেশী জোর দেয় না। জোর দেয় সংগঠন ও নিয়োগের উপর। আনুষ্ঠানিক বিচারে এই সমস্ত দলের সাধারণত গণতান্ত্রিক সংগঠনসমূহ থাকে। বাস্তবে মুষ্টিমেয় ক্রিয়াকারীর কথা বাদ দিলে রাজনীতিক অংশগ্রহণের ব্যাপারে সদস্যপদের করণীয় খুববেশী কিছু থাকে না। নীতি এবং উদ্দেশ্যের ব্যাপারে এই সব রাজনীতিক দলের সাধারণ স্বীকৃতি থাকে। ভোটাধিকারের ভিত্তি সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে উদারনীতিক ও রক্ষণশীল নির্বিশেষে সকল রাজনীতিক দল জনসাধারণের কাছে আবেদন-নিবেদনে বাধ্য হয়। গণ-ভিত্তিক রাজনীতিক দলের প্রাচীন উদাহরণ হিসাবে ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দলগুলির কথা বলা হয়। এ রকম নজির হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল গ্রেটব্রিটেনের শ্রমিক দল এবং জার্মানীর সামাজিক গণতান্ত্রিক দল। প্রধানত শ্রমিক শ্রেণীর সমর্থন সংগ্রহের জন্য এই সমস্ত রাজনীতিক দল সাংগঠনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলে।

ক্যাডার-ভিত্তিক রাজনীতিক দলের বড় বৈশিষ্ট্য হল যে, এই সমস্ত দল রাজনীতিকভাবে সক্রিয় এলিট গোষ্ঠীর উপর অতিমাত্রায় আস্থাশীল। এই গোষ্ঠী জনসাধারণকে রাজনীতিক মতাদর্শগত নেতৃত্ব প্রদানে সমর্থ। ক্যাডার-ভিত্তিক দলের শৃঙ্খলার বিষয়টি আধা-সামরিক পর্যায়ের। দলীয় সদস্য পদের জন্য কঠোর রাজনীতিক গুণাবলীর মানদণ্ড নির্ধারণ করা থাকে। জীবনে উন্নতি সাধন ও সাধারণ সুযোগ-সুবিধা লাভের বাসনা ক্যাডার-ভিত্তিক দলের সদস্যপদ গ্রহণের পিছনে প্রবণতা হিসাবে কাজ করে। এই সব দলের সদস্যদের মধ্যে অতি উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিক অঙ্গীকার এবং নীতিগত শৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। ক্যাডার-ভিত্তিক রাজনীতিক দলের উদাহরণ হিসাবে সাধারণভাবে কমিউনিস্ট দলগুলির কথা বলা যায়। নজির হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি।