প্রশ্নঃ দর্শন পাঠের প্রয়ােজনীয়তা বা গুরুত্ব আলােচনা কর।

অথবা, দর্শন পাঠের উপযােগিতা আলােচনা কর।

অথবা, দর্শন পঠন-পাঠন কতটুকু লাভজনক আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য ও জীবনের অজস্র জটিলতা বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়। দর্শন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দৃশ ধাতু থেকে। বাংলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ হলাে দেখা। দৈনন্দিন জীবনে দেখা বলতে আমরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণকে বুঝি। কিন্তু এখানে দেখা মানে চাক্ষুষ দেখা নয়। দর্শন হচ্ছে জীব ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি।

দর্শনের উপযােগিতা/প্রয়ােজনীয়তা/উপকারিতা/গুরুত্বঃ অনেকের ধারণা, দর্শন একটা অপ্রয়ােজনীয় বিষয়; দর্শন হলাে অর্থহীন কল্পনাবিলাস মাত্র; এটা পড়ে কোনাে লাভ নেই; দর্শনের কোনাে বাস্তব মূল্য নেই। তাদের মতে, দর্শন সহজ বিষয়টিকে জটিল করে তােলে। দর্শন হলাে অন্ধকার ঘরে কালাে বিড়াল খোজা, যা আসলে সে-ঘরে নেই। কিন্তু তাদের এ ধারণা সঠিক নয়। দর্শন সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সীমিত বলে তারা এ ধরনের অভিযােগ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে দর্শনের উপযােগিতা বা পাঠের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। নিম্নে আমরা এ সম্পর্কে আলােচনা করব-

(১) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দর্শনঃ মানবসভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মানুষের স্বাধীন চিন্তার উষালগ্ন থেকেই দর্শন তার নিজের ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিষ্ঠিত কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে অস্বীকার করে আইয়ােনীয়রাই প্রথম মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেন, যদিও আজকের দিনে এর বাস্তব মূল্য কম। সুতরাং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দর্শনের উপযােগিতা অপরিসীম।

(২) জীবনের জন্য দর্শনঃ যেহেতু জীবন ও জগতের দর্শনের প্রধান কাজ সে কারণে প্রতিটি মানুষই কোনাে না কোনাে অর্থে দার্শনিক। কারণ প্রতিটি মানুষই জীবন ও জগতের কোনাে না কোনাে দিকের পর্যালােচনা করে, মূল্যায়ন করে। তাই মানব জীবনের প্রয়ােজনেই দর্শন চর্চা করতে হয়।

(৩) বিজ্ঞানে দর্শনঃ দর্শন বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলোর মূল্যায়ন করে। এজন্যই বলা হয় যে, বিজ্ঞান আবিষ্কার করে, আর দর্শন তার মূল্যায়ন করে। এটম বােমা আবিষ্কার করা বিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু এই এটম বােমা মানব জাতির জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ তার মূল্যায়ন বিজ্ঞান করে না, করে দর্শন। তাই বিজ্ঞানে দর্শনের প্রয়ােজনীয়তা অধিক।

(৪) আদর্শ রূপায়ণে দর্শনঃ দর্শন কেবল জীবন ও জগতের মূল্যায়নই করে না, সাথে সাথে জীবন পরিচালনার সাথক আদর্শের সন্ধানও আমাদের প্রদান করে। সত্য, মঙ্গল এবং সুন্দর-মানব জীবনের এই তিনটি পরমাদর্শের সন্ধান আমরা দর্শন পাঠে জানতে পারি। দর্শনের মূল্যকে অস্বীকার করা পরমাদর্শকে অস্বীকার করারই নামান্তর।

(৫) মনন চর্চার ক্ষেত্রে দর্শনঃ দর্শন মানেই জীবন-জিজ্ঞাসা। জীবন ও জগৎকে ঘিরে যেসব মৌলিক সমস্যা আমাদের সামনে উদিত হয়, কোনােরূপ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ছাড়াই যুক্তির কষ্টিপাথরের দর্শন সে সবের সমাধান দেয়ার চেষ্টা করে। এর যৌক্তিক ফলশ্রুতিতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি শাণিত হয়।

(৬) সাহিত্য সংস্কৃতিতে দর্শনঃ সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, অর্থনীতি এবং রাজনীতিসহ জ্ঞানার্জনের অন্যান্য শাখার ওপরও দর্শনের প্রভাব অপরিসীম। দার্শনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ না হলে কোনাে সাহিত্যিকের বা কোনাে শিল্পীর পক্ষেই সাহিত্য ও শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক চিন্তা-ধারায় উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছিলেন বলেই তার সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে।

(৭) মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় দর্শনঃ দর্শন মানুষকে যন্ত্র হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখার শিক্ষা দান করে। দর্শনের সার্থক চর্চা ও অনুশীলন মানুষকে মানবতাবােধে উদ্বুদ্ধ করতে সরাসরি সাহায্য করে থাকে। দর্শনের শিক্ষা মানুষকে জগতের স্বার্থে না দেখে জগতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখতে অনুপ্রাণিত করে।

(৮) ব্যবহারিক জীবনে দর্শনঃ ব্যবহারিক জীবনে দর্শনের মূল্য সর্বাধিক। দর্শন আমাদের ব্যবহারিক সমস্যার তাৎক্ষণিক কোনাে সমাধান বা আমাদের ভাত-রুটির ব্যবস্থা করতে না পারলেও সুস্থ জীবন পরিচালনায় দর্শনের ভূমিকা রয়েছে। মানসিক সুস্থতা আনয়ন করে দর্শন। আর মানসিক সুস্থতা মানেই দৈহিক সুস্থতা।

(৯) উদার দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে দর্শনঃ দর্শন আমাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস, সর্বনাশা কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অনুদার ও পক্ষপাত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে উদার হওয়ার শিক্ষা দেয়। দর্শন তার সর্বাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির কল্যাণে যাবতীয় সংকীর্ণতার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে পরমতসহিষ্ণু হবার মহৎ শিক্ষা প্রদান করে।

(১০) ব্যক্তি চরিত্রের প্রেক্ষাপটে দর্শনঃ আমরা যদি ব্যক্তি চরিত্রের দিক থেকে দর্শনকে মল্যায়ন করি তাহলে দেখতে পাই যে, ব্যক্তিগত জীবনেও দর্শনের বাস্তব মূল্য রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তি চরিত্রের দিকে আমরা তাকালে দেখতে পাই যে, প্রতিটি মানুষেরই একটা নিজস্ব মত, একটা বিশেষ দর্শন রয়েছে, যার আলােকে সে জগতের সবকিছুকে বােঝার চেষ্টা করে। সুতরাং ব্যক্তিগত জীবনে দর্শনের মূল্য রয়েছে।

(১১) মানবসভ্যতায় দর্শনঃ মানবসভ্যতায় দর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম। মানবসভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, এই সভ্যতা থেমে নেই, ক্রমাগত চলছে। দর্শনের আলােকে মানুষ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসমুক্ত হয়ে একের পর এক সভ্যতা সৃষ্টি করে চলেছে। এই সভ্যতা সৃষ্টির মূলে বিজ্ঞানের চেয়ে দর্শনের মূল্য অধিক। সুতরাং মানবসভ্যতায় দর্শনের গুরুত্ব অধিক।

(১২) বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যে দর্শনঃ দর্শন বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যকে ঘােষণা করে। মানুষ জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী। বুদ্ধিবৃত্তি সবসময় জীববৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দর্শন এই বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যকে ঘােষণা করে জীবন ও জগতের সব মৌলিক সমস্যা সমাধান করে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শন এমন একটা বিষয় যেটা আমাদের কুসংস্কারমুক্ত হয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জগৎ-জীবনসহ ব্যবহারিক জীবনের যাবতীয় মৌলিক সমস্যার সমাধান আমাদের সামনে তুলে ধরে।