অথবা, দর্শনের সাথে জীবনের সম্পর্ক আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ দৈনন্দিন জীবনে মানব মনে প্রকৃতির অপার রহস্য ও জীবনের অজস্র জটিলতা বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। আর এ জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নেয় দর্শন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে এসব রহস্য ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবনের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্যকেও আবিষ্কার করেছে। আর এজন্যই দর্শন একটি সর্বাত্মক বিষয়। দর্শন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দৃশ ধাতু থেকে। বাংলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ হলাে দেখা। দৈনন্দিন জীবনে দেখা বলতে আমরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণকে বুঝি। কিন্তু এখানে দেখা মানে চাক্ষুষ দেখা নয়। দর্শন হচ্ছে জীব ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি।
জীবনের সাথে দর্শনের সম্পর্কঃ জীবন ও জগতের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা ও তার মূল্যায়নই দর্শনের প্রধান কাজ। সুতরাং দর্শন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এ সম্পর্ককে আরাে ভালােভাবে জানতে আমাদের উভয়ের স্বরূপ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। দর্শন সম্পর্কে আমরা উপরে আলােচনা করেছি। এখন আমরা জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা নেব।
জীবনের স্বরূপঃ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করার পরই মানব শিশু নতুন পরিবেশের মধ্যে নিপতিত হয়। মায়ের গর্ভ থেকে সে পৃথিবীর নতুন পরিবেশে আবির্ভূত হয়। তারপর আস্তে আস্তে তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে। এবং এই বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করে রেখেছে। এই বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারাই সে জীবনে প্রতিষ্ঠা পায়, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান। করে। মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং এই সব মিলিয়েই মানুষের জীবন।
সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, জীবনকে ঘিরেই দর্শন। জীবনের জন্যই দর্শন। নিচে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করব-
(১) দর্শন ও জীবন দর্শন অভিন্নঃ জীবনকে পরিহার করে, কোনাে দর্শন হতে পারে না। এ কথার সমর্থনে দার্শনিক কানিংহাম বলেন, “জীবন ও জীবনের প্রয়ােজন থেকেই দর্শন জন্মলাভ করে। কোনাে ব্যক্তি যদি ভাবনা চিন্তার ভেতর জীবনযাপন করে তবে মনে করতে হবে যে, সে কিছুটা হলেও একজন দার্শনিক।”
(২) মানব জীবনে দর্শন অপরিহার্যঃ পরিবেশ একটি জটিল সংগঠন, এখানে মানুষ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। জীবনের প্রয়ােজনে মানুষকে সুচিন্তিত উপায়ে সমস্যা সমাধানে অনুসন্ধান কাজে আত্মনিয়ােগ করতে হয়। এ সময় জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। সুতরাং দেখা যায় জীবনের জটিলতা থেকেই দর্শনের উৎপত্তি।
(৩) জীবনের মতাে দর্শনঃ পরিবর্তনশীল মানুষ চিরকাল একইভাবে জীবন ও জগৎকে মূল্যায়ন করে না। কারণ জীবনের গতিধারার সাথে দর্শনের পরিবর্তন হয়ে থাকে। বিশেষ করে জীবনের সাথে সম্পর্কহীন দর্শন মূল্যহীন।
(৪) দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ ও সর্বজনীনঃ দার্শনিক দৃষ্টি দ্বারা পরিচালিত হলে আমরা সামাজিক কোন্দল, অনাচার ও অনেক অসত্যের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি। আবার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে সামান্য বিষয় সামাজিক, পারিবারিক কোন্দলের কারণ হয়ে ওঠে।
(৫) দৈনন্দিন জীবনেও দর্শনের প্রয়ােজন অপরিহার্যঃ ব্যক্তিজীবনে অথবা সামাজিক জীবনে যক্তিপ্রবণ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটানাে সুস্থ মনের পরিচায়ক। একমাত্র দর্শন অনুশীলনই দৈনন্দিন জীবনে সুস্থ মানসিকতা এনে দিতে পারে।
(৬) আধুনিক দর্শন জীবনকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করেঃ এ যুগে দার্শনিকগণ মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। জীবন, সত্তা ও জগৎ সম্পর্কে এক নতুন ধারণা সৃষ্টি করে তারা মানবকল্যাণকে নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন। তাই বর্তমানে দর্শন মানবতাবাদী।
(৭) ব্যক্তিজীবনের প্রেক্ষাপটে দর্শনঃ যেহেতু জীবন ও জগতের দর্শনের প্রধান কাজ সে কারণে প্রতিটি মানুষই কোনাে না কোনাে অর্থে দার্শনিক। প্রতিটি মানুষই জীবন ও জগতের কোনাে না কোনাে দিকের পর্যালােচনা করে, মূল্যায়ন করে। তাই ব্যক্তিজীবনে দর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম।
(৮) সমাজ জীবন ও দর্শনঃ সমাজ জীবনেও দর্শনের মূল্য অপরিসীম। সমাজ জীবনে আমরা দেখতে পাই যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দার্শনিক তাদের মতবাদ দ্বারা সমাজকে প্রভাবিত করেছেন। যেমন আমরা কার্ল মার্কসের দর্শনের কথা উল্লেখ করতে পারি। মার্কস তার দর্শন দ্বারা এক শশাষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেটা বাস্তবেও পরিণত হয়েছিল। সুতরাং সমাজ জীবনে দর্শনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যথাযথই দর্শন আকস্মিক কোনাে কিছু নয়। আসলে এটি মানব মনের গভীর চিন্তার অতি স্বাভাবিক ফসল। সুতরাং মানব জীবনের সাথে দর্শনের সম্পর্ক অতি গভীর ও একান্ত ঘনিষ্ঠ।
Leave a comment