অথবা, দর্শনের উৎপত্তির কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, দর্শনের উৎপত্তি সম্পর্কে যা জানাে লেখ।
ভূমিকাঃ দর্শন সত্য উদঘটানের জন্য চিন্তার মৌলিক সূত্র হতে শুরু করে জীবন ও জগতের মৌলিক প্রশ্নের যৌক্তিক ভিত্তির সন্ধান করে। জগত ও জীবনের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও পরিণতি সংক্ৰন্ত এমন কিছু মৌল বিষয় আছে যেগুলাে যুগপৎ মানুষের মনে বিস্ময় ও কৌতূহল সৃষ্টি করে। এই বিস্ময়বােধ ও কৌতুহলের তাগিদেই মানুষ অবলীলাক্রমে চালিত হয় অজানাকে জানার জন্য। জগত সংসার ও মানবজীবনের বিবিধ রহস্য উদঘাটনের লক্ষ্যে কৌতূহলী মানুষ তার শত সীমার বাঁধনকে উপেক্ষা করে ব্রতী হয় জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের দুঃসাধ্য কাজে। এই জগত সত্তার মূল রহস্য কী? আমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব ইত্যাদি প্রশ্নকে ঘিরে উৎপত্তি হয় দর্শনের।
দর্শনের উৎস বা উৎপত্তিঃ যেহেতু দর্শনের কোনাে সঠিক সংজ্ঞা একবারে দেয়া সম্ভব নয়। তাই | এর উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোনাে মতবাদ একবারে দেয়া সম্ভব হয় না। নিম্নে দর্শনের উৎস বা উৎপত্তি সম্পর্কে আলােচনা করা হলােঃ
(১) কৌতূহলী চেতনা থেকে দর্শনঃ মানুষের মন অজানকে জানার কৌতূহলে ভরা। বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি রহস্যকে জানার কৌতুহল মানুষের আজন্মের। মানুষ যতই বিভিন্ন রহস্যকে উন্মােচন করে ততই আরাে নতুন কিছু জানার আগ্রহ তার বেড়ে যায়। তাই দেখা যায় যে, এই জ্ঞানস্পৃহার ফলেই মানুষ আজ চাঁদের দেশে পাড়ি জমিয়ে ক্ষান্ত হতে পারে নি। সে আজ অভিযান চালাচ্ছে মঙ্গল গ্রহকে আয়ত্ত করতে, আর এদিক থেকে বলা যায় যে, কৌতূহল থেকেই দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে।
(২) জগত ও জীবনের ব্যবহারিক প্রয়ােজনেই দর্শনঃ প্রকৃতির বিরাট অংশরূপেই মানুষ বিদ্যমান। জন্মের পর মানুষকে বাঁচতে হয় প্রকৃতির মাঝে। বাঁচার জন্য মানুষের প্রয়ােজন হয় প্রকৃতিকে ভালােভাবে বুঝার। প্রকৃতি থেকে প্রয়ােজনীয় বস্তুসমূহ বের করে নেবার। ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ আরম্ভ করে মানুষের স্বভাবে, মানুষের প্রয়ােজনে।
(৩) বিস্ময় থেকে দর্শনঃ প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বলেন, বিস্ময় থেকে দর্শনের সৃষ্টি। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকগণ প্রকৃতিক লীলাখেলায় বিস্মিত হয়ে, প্রকৃতির ভেতর অসংখ্য জটিল সমস্যা সমাধানে তৎপর হন। অবশ্য বিস্ময়ে তাদের দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হলেও আসলে এর উৎপত্তি মানবকল্যাণে।
(৪) সংশয় হতে দর্শনঃ সংশয়কেও দর্শনের উৎপত্তির কারণ বলা হয়। অনেক দার্শনিকের মতে, বিশ্বের সবকিছুই. সংশয়পূর্ণ। তাদের মতে, চূড়ান্ত জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব। সত্যকে পাওয়া যায় না, সবকিছুতে অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। গ্রিসের সােফিস্টগণ এই দলের অন্তর্ভুক্ত। মধ্যযুগের সকল ধর্মীয় বিশ্বাসকে সন্দেহে করে নবযুগের সূচনা হয়। দার্শনিক ডেকার্ট সুষ্ঠু দার্শনিক চিন্তা প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে সবকিছুকে সন্দেই করেই যাত্রা শুরু করেন। কাজেই বলা যায়, সংশয় দ্বিধাও সন্দেহ হতে দর্শনের উৎপত্তি।
(৫) উপযােগিতার ভিত্তি দর্শনের উৎসঃ প্রয়ােজনের আরেক নাম হলাে উপযােগিতা; আর এই উপযােগিতার ভিত্তিতেই দার্শনিক চিন্তা প্রসার লাভ করে। জেমস, শীলার, ডিউই প্রমুখ কোনাে কিছুর উপযােগিতার ওপর ভিত্তি করে একপ্রকার চিন্তা পদ্ধতির কথা বলেন। আর সেটাই হলাে দর্শন।
(৬) জ্ঞানপ্রীতিই দর্শনের উৎসঃ জ্ঞানপ্রীতি থেকেও দর্শনের উৎপত্তি হয়। মানুষ সবসময় অজানাকে জানতে চায়। তার আকাক্ষার নিবৃত্তির জন্য সে পরিবেশ ও পরিবেশের বাইরের কথা চিন্তা করে। জানতে চায় এদের ভেতরের রহস্যকে। অজানাকে জানতে চায় সে নিজের প্রয়ােজনে। অজানাকে জানলে সে সুখী ও তৃপ্তি হয়। কাজেই এই জ্ঞানপ্রীতিও মানুষের কল্যাণেই হয়। আর এ জ্ঞানপ্রীতি থেকেই দর্শনের উৎপত্তি হয়।
(৭) আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে দর্শনঃ আধ্যাত্মিক প্রেরণা, আধ্যাত্মিক অভাব পূরণ, আত্মজ্ঞান ও আত্মশুদ্ধির জন্য মানুষ দার্শনিক কলাকৌশল গ্রহণ করে থাকে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে দর্শনের উৎপত্তি ঘটেছে। অর্থাৎ দর্শনের মূলে রয়েছে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অভাববােধ।
(৮) জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টায় দর্শনের উৎপত্তিঃ জাগতিক দুঃখ পরিহার ও সুখলাভের প্রেরণা মানুষকে জগত ও জীবনের বড় বড় প্রশ্নের সমাধানে তৎপর করে তােলে। এ সংসারে জরা মৃত্যু, ব্যাধি অমঙ্গল, আশাভঙ্গ, জ্ঞানাচার, অবিচার অত্যাচার ইত্যাদি লেগেই আছে। তাই আধ্যাত্মিক প্রয়ােজন ছাড়াও সংসারের দুঃখ দৈন্য থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বের করার প্রয়ােজন থেকে দর্শনের উৎপত্তি হয়েছে।
(৯) জীবনে পূর্ণতা লাভের আশাই দর্শনের উৎসঃ জীবনে পূর্ণতা লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকেও দর্শনের উৎপত্তি হয়। কামনা, বাসনা, লালসা, ঈর্ষা, হিংসা, বিদ্বেষ ইদ্যাদি বৃদ্ধির দ্বারা চালিত করে সুখী, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষাও দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি ঘটায়।
(১০) সত্য উদঘাটনই দর্শনের উৎসঃ একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই জন্ম থেকে দার্শনিক। প্রত্যেক ব্যক্তিই চায় সত্যের দ্বার উদঘাটন করতে এবং সত্যকে উপলব্ধি করতে। আর এভাবেই সত্যের দ্বার উদঘাটেনের প্রয়ােজনেই দর্শনের উৎপত্তি হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন কারনে দর্শনের উৎপত্তি হলেও এর মূলে রয়েছে মানুষের প্রয়ােজন তথা মঙ্গলসাধন। দার্শনিক চিন্তা মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে ও জীবন পথে চলতে শেখায়। দর্শন মানুষের বিপদের বন্ধু ও সত্যপথ প্রদর্শক। সুতরাং মানুষ দার্শনিক চিন্তা করে এ সত্য উপলব্ধির প্রয়ােজনে; জীবনকে পূর্ণভাবে ভাবতে। সত্যকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করার প্রয়ােজনেই দার্শনিক চিন্তার উৎপত্তি হয়েছে।
Leave a comment