সূচনা: উনবিংশ শতকের শেষদিকে কেরালা তথা দক্ষিণ ভারতে যে সমাজসংস্কার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তাতে নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন বিশিষ্ট সাধক ও চিন্তাবিদ শ্রীনারায়ণ গুরু (১৮৫৬- ১৯২৮খ্রি.)। তিনি কেরালার এজহাবা নামক এক দলিত অস্পৃশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কেরালার পিছিয়ে-পড়া মানুষের উন্নতি ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে আন্দোলন গড়ে তােলেন তা হিন্দু সংস্কার আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যােগ করে।
ভাবাদর্শ: সংস্কারক শ্রীনারায়ণ গুরুর সংস্কার আন্দোলনের প্রচারিত ভাবাদর্শের প্রধান দিকগুলি ছিল一
-
[i] শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে কুসংস্কারমুক্ত করা,
-
[ii] শক্তিশালী হওয়ার জন্য একতা গড়ে তােলা,
-
[iii] শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানাে।
অবদান: নারায়ণ গুরু তার সংস্কার কর্মসূচি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে তার অবদান সম্পর্কে নীচে আলােচনা করা হল一
-
অস্পৃশ্যতার বিরােধিতা: কেরালার মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ছিল এজহাবা নামে নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। হিন্দু দেবদেবীর মন্দির বা উচ্চবর্ণের মানুষের গৃহে প্রবেশের কোনাে অধিকার এই দলিত শ্রেণির মানুষের ছিল না। এমনকি এজহাবাদের নিজস্ব মন্দিরেও হিন্দু দেবদেবীর ছবি বা বিগ্রহ রাখা যেত না। নারায়ণ গুরু সামাজিক অস্পৃশ্যতার তীব্র বিরােধিতা করেন। সমাজের অস্পৃশ্য জাতির মানুষকে মন্দিরে অবাধ প্রবেশের সুযােগ। দেওয়ার দাবিতে তিনি তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলেন।
-
প্রচারকার্য: নারায়ণ গুরু কেরালার সর্বত্র ভ্রমণ করে প্রচলিত জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক অবিচার ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রচার চালান এবং এসবের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে তােলেন। তিনি মদ তৈরি ও মদ্যপানের বিরুদ্ধে এবং অসবর্ণ বিবাহের সপক্ষে প্রচার চালান। এজহারা সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি তাদের ব্যাবসা করার পরামর্শ দেন। সমাজসংস্কারের বিষয়ে তাঁর আদর্শ প্রচার এবং তার প্রতিষ্ঠিত মন্দির, মঠ ও বিদ্যালয়গুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনারায়ণ ধর্ম পরিপালন যােগম নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এজহাবা সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উন্নতি, তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং দক্ষিণ ভারতে অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
-
ভাইকম সত্যাগ্রহ: দক্ষিণ ভারতের ভাইকমে বর্ণহিন্দুদের একটি মন্দিরের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ব্যবহারের অধিকার সেখানকার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ছিল না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারায়ণ গুরু প্রবল জনমত ও তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলেন। তার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ‘ভাইকম সত্যাগ্রহ’ (১৯২৪ খ্রি.) নামে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বে মন্দিরে পুজোর জন্য ‘এজহারা পুরােহিত সম্প্রদায় গড়ে ওঠে এবং সেখানকার রন্ধনশালার কাজে তথাকথিত অস্পৃশ্যদের নিয়ােগ করা হয়। ভাইকম সত্যাগ্রহের ব্যাপকতায় মুগ্ধ গান্ধিজি দক্ষিণ ভারতে এসে এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। শেষপর্যন্ত ভাইকম সত্যাগ্রহ জয়যুক্ত হয়।
-
শিক্ষার প্রসার: নারায়ণ গুরু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দলিত অনগ্রসর জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি। এজন্য তিনি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি অর্থভাণ্ডার খােলেন। তার উদ্যোগে কেরালায় বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
মূল্যায়ন: শ্রীনারায়ণ গুরুর নেতৃত্বে সংস্কার আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত দলিতদের উন্নতির লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও তা শীঘ্রই দক্ষিণ ভারতের জাতিভেদপ্রথা ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরােধী হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ শ্ৰীনারায়ণ গুরুর আন্দোলনে শামিল হলে তা দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
Leave a comment