যুগন্ধর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই বৈচিত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। কাব্য মহাকাব্য-পত্রকাব্য সনেট কারো সঙ্গে কারো পুনরাবৃত্তিকরণ দৃষ্ট হয় না। তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে অভিনব ও অনবদ্য তাঁর পত্রকাব্য—বীরাঙ্গনা কাব্য। মেঘনাদবধ কাব্য তাঁর অত্যুজ্জ্বল প্রতিভার কালজয়ী সৃষ্টি রূপে পরিগণিত হলেও বীরাঙ্গনা কাব্য তারও মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠরূপে বিবেচিত। ভাষায়, ভাবে, ত্রুটি বিবর্জিত ছন্দে এর অনবদ্যতা সর্বজন স্বীকৃত।
বীরাঙ্গনা কাব্য – পত্রকাব্য। পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে সংগৃহীত এগারোজন নায়িকার হৃদয়াবেগ উদ্ধৃত একোক্তিমূলক রচনা। নায়িকাগণ কর্তৃক তাঁদের প্রেমাস্পদ বা পতির উদ্দেশ্যে লিখিত ও প্রেরিত পত্রিকা বা লিপির সংকলন হল বীরাঙ্গনা কাব্য। রোমক কবি ওভিদের দি হিরোইদেস কাব্যের আদর্শে প্রাণিত হয়ে কবি মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্য রচনা করেছিলেন। বলা বাহুল্য পাশ্চাত্য কবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও এবং ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করলেও বীরাঙ্গনা কবির মৌলিক কবিত্ব শক্তির স্বাক্ষরবাহী।
বীরাঙ্গনা কাব্যের মূল সুর প্রেমের সুর। তা সত্ত্বেও পত্রিকাগুলির মধ্যে নায়িকাদের স্বভাব চরিত্রভেদে স্বাতন্ত্র্য বর্তমান। মোট চারটি শ্রেণীতে এই কাব্যের পত্রগুলিকে বিন্যস্ত করলেও, এগারোটি পত্রই স্বতন্ত্রভাব ও রসের বাহক। যেমন, শকুন্তলা ও দ্রৌপদী উভয়েই প্রোষিতভর্তৃকা। উভয়েই স্বামীর অদর্শনজনিত কারণে উৎকণ্ঠিতা। পতি মিলন পিয়াসী এই দুই নারীর চিঠির বিষয়বস্তু এক ধরণের হলেও দুটি পত্রের মধ্যেই ভিন্নতা বর্তমান। ভিন্নতা এই দুই নারীর স্বভাব চরিত্র ও মনোভাবের কারণে। শকুন্তলা সরলা আশ্রমকন্যা। তিনি কোমল স্বভাব যুক্তা। উচ্চ কণ্ঠে তিনি কথা বলতে পারেন না এবং নিজের বিরহজনিত কারণে প্রাপ্ত দুঃখের জন্যে তিনি দুষ্মস্তকে দায়ী না করে নিজের মন্দভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করেন। তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত হল পতির কল্যাণ সাধন। তাই দুখস্তের কথা এবং নিজের বিরহব্যথার কথা কারো কাছে তিনি প্রকাশ করতে পারেন না, পাছে কেউ শকুন্তলার দুঃখ দেখে দুষ্মন্তের প্রতি কুবাক্য বলে কিম্বা বনদেব বনদেবী রুষ্ট হয়ে দুষ্মন্তকে অভিশাপ দেন। শকুন্তলার বিরহ বেদনা তাই তার একার।
অন্যদিকে দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর মধ্যে কেবল অর্জুনের জন্যে বিরহ কাতরা। অর্জুন ইন্দ্রলোকে অস্ত্র শিক্ষা করতে গেছে। তার বিরহ দ্রৌপদীর আর সহ্য হচ্ছে না। দ্রৌপদী শকুন্তলার মত সম্বৃতবাক নন। তিনি বাকপটু। কাজেই তাঁর পত্রেও সেই মুখরতা লক্ষ্য করা যায়। অর্জুনকে তিনি দাম্পত্য প্রেমের দাবীতে কটাক্ষ করেছেন। অর্জুন যে মনোরমা স্বর্গের অপ্সরীদের সেবা যত্নে কাল যাপন করছেন, তাতে তাঁর পক্ষে দ্রৌপদীর কথা মনে রাখা সম্ভব কিনা—এ বিষয়ে কটাক্ষ করে দ্রৌপদী অর্জুনকে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন। নানা পূর্ব কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অর্জুনের হৃদয়ে পুরনো প্রেমের নবস্রোতোদ্বেলতা আনবার চেষ্টা করেছেন। দ্রৌপদীর মধ্যে যে স্ত্রীর দাবী প্রতিষ্ঠিত, সেই দাবীতেই দ্রৌপদী অর্জুনকে ফিরে এসে বিরহের অবসান ঘটাতে আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচ্য দুটি পত্রিকাই প্রোষিতভর্তৃকার বিরহ সংজ্ঞাপক পত্রিকা। দুটি পত্রিকারই মূল বক্তব্য এক। কিন্তু নায়িকাভেদে পত্রিকা দুটির ভাবে ও ভাষায় স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। এই রকমই একই ভাবাশ্রিত অনুযোগ পত্রিকা দুটির মধ্যেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দশরথ পত্নী কেকয়ী ও নীলধ্বজ পত্নী জনা তাঁদের স্বামীদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিমানী চিত্তে দুটি অনুযোগ পত্রিকা রচনা করেন।
কেকয়ী তাঁর দাসী মন্থরার মুখে রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবার সংবাদ শুনে দশরথের প্রতি ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। কেন না, একদা দশরথ কেকয়ীর সেবায় তুষ্ট হয়ে কেকয়ী-নন্দন ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করবেন কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যকালে কৌশল্যানন্দন, জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করালে কেকয়ী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর পুত্রস্বার্থ রক্ষার আন্দোলন ক্রমে পরিণত হয় সত্য বিচার প্রার্থনায়। কেননা একদা যে সত্য দশরথ কেকয়ীর কাছে করেছিলেন আজ তিনি সে সত্য থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। কাজেই ‘পরম অধর্মাচারী রঘু-কুল পতি’ কথাটি চতুর্দিকে রাষ্ট্র করতে তিনি বদ্ধপরিকর হয়ে যান এবং পত্রের শেষে সত্যের অপলাপ ঘটানোর জন্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে দশরথের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেন ও সপুত্র তিনি রাজপুরী ত্যাগ করার বাসনা প্রকাশ করেন। কেকয়ীর পত্রে তাই অবশেষে আত্মস্বার্থ, পুত্রস্বার্থের চেয়েও সত্যের বিচার প্রার্থনা বড় হয়ে উঠেছে।
মাহেশ্বরী রাজ্ঞী জনার স্বামীর প্রতি অভিযোগের কারণ অন্য। অর্জুনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে তাঁর বীরপুত্র প্রবীর বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। এখবর শুনে জনা মর্মাহত। কিন্তু বীরপুত্রের রণক্ষেত্রে বীরগতি প্রাপ্ত হওয়ায় শোকের চেয়েও ক্ষত্রিয় রমণী হিসেবে গর্ব অনুভব করেছেন। কিন্তু যখন শুনলেন তাঁর স্বামী অর্থাৎ প্রবীরের পিতা, পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে, পুত্র হস্তারককে পরমমিত্র জ্ঞানে রাজপুরীতে আশ্রয় দিয়েছেন। নরনারায়ণ জ্ঞানে অর্জুনকে পূজা করছেন। অর্জুনের তুষ্টি বিধান করতে রাজসভায় নাচ-গানের আনন্দময় বাতাবরণ সৃষ্টি করছেন তখন জনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তিনি নানাভাবে স্বামীকে সচেতন করতে চেষ্টা করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয়, এত সত্ত্বেও জনার স্বামী প্রেম, স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তির হানি হয়নি। ক্ষত্রিয় রমণী হিসেবে তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলেও স্বামীকে তিনি অবমাননা করেন নি। এ পত্রিকা বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা হলেও, আমাদের মতে তারা পত্রিকাটিই সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকা রূপে গণ্য হবার যোগ্য।
তারা পত্রিকার মধ্যে পরিপূর্ণ ভাবে নারীত্বের প্রতি মর্যাদা দান করেছেন কবি মধুসূদন। এ ছাড়াও এর মধ্যে ভাবে ভাষায় নূতনের কেতন উড়িয়েছেন কবি। শকুন্তলা দ্রৌপদী বা কেকয়ী-জনার পত্রিকার প্রেক্ষাপট ছিল গতানুগতিক। কোন একজন বিরহী স্ত্রীর ভাবনা কিম্বা বীরাঙ্গনার ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনার চেয়েও বিবাহিতা স্ত্রীর পক্ষে, সর্বোপরি যখন যে ঋষি কন্যা ও ঋষিপত্নী তার পক্ষে অবৈধ প্রণয় সম্ভাষণ সে যুগে একটা বৈপ্লবিক ঘটনা। বস্তুতঃ বীরাঙ্গনার তারা পত্রিকার সূত্রধরেই বাংলা সাহিত্যে অবৈধ প্রেম কাহিনীর প্রচলন ঘটে।
সোমের প্রতি তারা পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল রত্ন বিশেষ। মুক্তপ্রেমের বা প্রেমমুক্তির জয়গান এখানে গীত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দাম্পত্য প্রেম বৈচিত্র্যহীন। শেষের কবিতার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ঘড়ার জল’ প্রয়োজন মতোই সে প্রেমের ব্যবহার প্রকাশ ও আস্বাদন। কিন্তু পরকীয়া প্রেম যেন ‘সাঁতার পানি’। যত ইচ্ছে যেমন ইচ্ছে উদ্দামতা সেখানে অনায়াসে প্রকাশ করা যায়। সাহিত্যে তাই এই আবেগ মথিত সমাজনিন্দিত প্রেমই নন্দিত হয়েছে।
বৃহস্পতি-পত্নী তারা তাঁর স্বামী-শিষ্য সোমকে দেখে প্রণয়াসক্ত হয়েছিলেন এবং সে কথা তিনি গোপন করে। রেখেছিলেন কিন্তু সোম বা চন্দ্র যখন অধ্যয়ন সমাপনান্তে গুরু চরণে বিদায় প্রার্থনা করলেন, তারা তখন চন্দ্রকে আপন মনোগত অভিপ্রায় জানিয়ে পত্র লিখে পাঠালেন। পত্রে তারার প্রেমবুভুক্ষু অন্তরের বেদনা, চন্দ্রকে দেখার পর সেই প্রেম বুভুক্ষু চিত্তে নতুন আশার সঞ্চার, সমাজের রীতি বহির্ভূত প্রেম অঙ্গীকার এবং দীর্ঘদিন ধরে চেতনে অবচেতনে লালিত সামাজিক শাসনের দ্বন্দ্ব এবং অবশেষে সে দ্বন্দ্বকে দুহাতে সরিয়ে চন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পণ ‘জীবন মরণ মম আজি তব হাতে’—সব মিলিয়ে পত্রিকাটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর ও সার্থক করে তুলেছে।
তারা তাঁর পত্রিকা রচনা শুরু করেছেন কোন আকস্মিকতা দিয়ে নয়। প্রেমে দ্রবিভূত হয়েছেন অথচ পূর্ব সম্বন্ধানুযায়ী তিনি চন্দ্রের গুরুমাতা। তাই দ্বিধান্বিত চিত্তে তাঁর পত্র শুরু হয়েছে—
“কি বলিয়া সম্বোধিবে, হে সুধাংশুনিধি
তোমারে অভাগী তারা? গুরুপত্নী আমি
তোমার, পুরুষ রত্ন; কিন্তু ভাগ্যদোষে,
ইচ্ছা করে দাসী হয়ে সেবি পা দুখানি!”
এ পর্যন্ত লিখেই তাঁর আজন্ম লালিত সংস্কারে ধাক্কা লাগায় তারা তাঁর লেখনীকেই দোষারোপ করেছেন, “কি লজ্জা! কেমনে তুই রে পোড়া লেখনি, লিখিলি ও পাপ কথা?’ কিন্তু দোষারোপ যাই করুন, তারার সর্বশেষ উক্তি—
এ নব যৌবন, বিধু, অর্পিব গোপনে
তোমায়, গোপনে যথা অর্পেন আনিয়া
সিন্ধু পদে মন্দাকিনী স্বর্ণ, হীরা, মণি।’
পত্রিকায় একাংশে তারার কল্পনা নৈপুণ্য দেখে এবং বাকপটুতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। চন্দ্রকে আহ্বান জানাতে তারা চন্দ্রকে রূপকের আশ্রয় নিয়ে বলেছেন—
তারানাথ তুমি,
জুড়াও তারার জ্বালা। নিজ রাজ্য ত্যজি
ভ্রমে কি বিদেশে রাজা, রাজ কাজ ভুলি?
সেই সঙ্গে সংবাদে জানিয়েছেন যে পঞ্চ খর শর নিয়ে মীনধ্বজ রথী চন্দ্রের অবর্তমানে চন্দ্রের রাজত্ব অর্থাৎ তারার দেহ ও মন আক্রমণ করেছে।
প্রকৃত পক্ষে তারা পত্রিকার মধ্যেই চরিত্র সৃষ্টির উৎকর্ষ, কী বাক্ বৈদগ্ধে, কী কল্পনা নৈপুণ্যে অপূর্ব চমৎকারিত্ব লক্ষ্য করা যায়। তাই বীরাঙ্গনা কাব্যের তারা পত্রিকাকেই শ্রেষ্ঠ পত্রিকা বলে উল্লেখ করা সঙ্গত।
Leave a comment