অথবা, বৈষ্ণব পদাবলীর মানবিক উপাদান বিশ্লেষণ কর

উত্তর : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব রস-আশ্রিত রাধা-কৃষ্ণ-বিষয়ক ভক্তিরসমিশ্রিত গীতিকবিতাগুলোই বৈষ্ণর কবিতা হিসেবে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সৃষ্ট বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ধারাটি অভিনব মাত্রা ব্যঞ্জনায় বিকশিত হয়েছিল। পদাবলী মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি ব্যাপক ও শক্তিশালী ধারা। চৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমধর্ম বাঙালির স্বভাব সরস চিত্তে অপূর্ব এক মাধুর্য ও ভাবের সৃষ্টি করেছিল। প্রাণধর্মের সঙ্গে প্রেম ও ভক্তির মিলনে বাঙালির মনে যে ভাবের জোয়ার এল তা সমগ্র বাংলাদেশকে প্লাবিত করে দিল। এই ভাবেরই প্রকাশ ঘটল গীতিধর্মী বৈষ্ণব পদাবলীতে। এ সাহিত্য ধারায় মূলত মানবরসই ধর্মরসে সিক্ত হয়েছে। বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের ঐতিহ্য তুর্কি- বিজয়-পূর্ব বাঙালির লেখা সংস্কৃত সাহিত্য পর্যন্ত বিস্তৃত।

চৈতন্যদেব [১৪৮৬-১৫৩৩] বৈষ্ণব প্রেমধর্মের প্রচারক। তাঁর প্রেমলীলা রসের বিচিত্র আস্বাদন বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করে তুলেছে। অবশ্য চৈতন্যদেবের পূর্বেও বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্য ছিল। সংস্কৃত কবি জয়দেব, মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি, বাঙালি কবি বড়ু চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস পদাবলী সাহিত্যে প্রচুর খ্যাতিলাভ করেন। এমনকি চৈতন্যদেবও তাদের পদমাধুর্য আস্বাদনে আকুল হতেন। বৈষ্ণব সাহিত্য ধারায় বাংলা সাহিত্যে দেব-মাহাত্ম্যের পরিবর্তে ব্যক্তি মানুষের তথা মানবীয় আবেদনের প্রভাব পড়েছিল।

বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণিত হয়েছে। এই প্রেমলীলা মানবিক প্রেমের আধারেই বিধৃত। বিরহ-মিলন- কথায় পরিপূর্ণ বৈষ্ণব পদগুলো স্বভাবতই আমাদেরকে মানুষী প্রেমের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী থেকে তত্ত্বকথা আলাদা করে নিলে আর বৈষ্ণব পদাবলীতে মর্ত্যের নর-নারীর প্রেমই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। যেমন-

“বঁধু কি আর বলিব আমি।

জীবনে মরণে জনমে জনমে

প্রাণনাথ হৈও তুমি ॥”

শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন গড়ে উঠল এবং রাধাকৃষ্ণের অপ্রার্থিব প্রেমলীলা চৈতন্যদেবের জীবনে মূর্ত হয়ে দেখা দিল। শ্রীগৌরাঙ্গের জীবনে রাধার বিরহ-ব্যথা জীবন্তভাবে ফুটে ওঠে। তার প্রেমের তন্ময়তা শ্রীরাধার মনেও ব্যথার সৃষ্টি করে। এই রাধাভাবদ্যুতি বঙ্গদেশে ব্যাপ্ত হলো। সেই প্রেমসিন্ধু হতেই পদাবলীরূপে কৌস্তুভ মণির উদ্ভব। প্রেমের এই জীবন্ত মূর্তিকে প্রত্যক্ষ করে বা কবিমানসে রেখে বৈষ্ণব কবিরা রাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমগীতিহার রচনা করেছেন। কাজেই বৈষ্ণব কবিতাকে শুধু নর-নারীর প্রেম বললে ভুল হবে- এটা একান্তই মানবিক রসে জারিত প্রেম। কবির ভাষায়-

“রাধার কি হৈল অন্তরে বেথা।

বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে

না শুনে কাহারো কথা ॥”

ব্রজলীলার শ্রীরাধা, চন্দ্রাবলী, ললিতা, বিশাখা প্রভৃতি গোপীগণ কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেয়েছে। এরা কৃষ্ণের তৃপ্তিসাধনের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে কৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া হয়েছিলেন। পরস্পর অনুরক্ত এবং একত্রে অবস্থিত নায়ক- নায়িকার দর্শন-আলিঙ্গনাদির নিরোধক মান। যেখানে প্রণয় আছে- সেখানে মানও আছে। কৃষ্ণ-অন্তপ্রাণ রাধা কৃষ্ণকে কাছে না পেলে- কিংবা রাধার প্রতি কৃষ্ণের কোনো অবজ্ঞা দেখা দিলে শ্রীরাধিকার মান হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-

“সই কেমনে ধরিব হিয়া

আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায়

আমার আঙিনা দিয়া।” [চণ্ডীদাস]

বৈষ্ণব কবিরা বাস্তব জগতের প্রেমিক-প্রেমিকার অভিজ্ঞতাতেই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমমূর্তি এঁকেছেন। প্রেমের নিবিড়তায়- প্রেমের অসীমতায় প্রিয় নিকটে থাকলেও প্রেমিকার সন্দেহ জাগে বুঝি প্রিয়তমকে হারিয়ে ফেলেছেন। এই হলো প্রেমবৈচিত্র্যের অনুভূতি। যেমন-

“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু,

অনলে পুড়িয়া গেল।” [জ্ঞানদাস]

পূর্ব সম্মিলন পদে নায়ক-নায়িকা তথা রাধা-কৃষ্ণের যে বিরহ তা যেন মানব-মানবীরই চিরন্তন বেদনারই প্রকাশ। আমরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেম সংক্রান্ত সকল বিষয়ের মধ্যে মাটির পৃথিবীর নর-নারীর স্নিগ্ধ সুকুমার মুখচ্ছবি দেখতে পাই। তবে এ প্রেম ক্ষুদ্র নয়- গণ্ডিবদ্ধ নয়- এ প্রেম চিরন্তন। পদাবলীতে নায়ক-নায়িকার যে বিরহ তা যেন প্রতিটি নর-নারীরই বিরহ। যেমন-

“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর ॥” [বিদ্যাপতি]

পরিশেষে বলা যায়, বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা সাহিত্যের প্রাণ। বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রেমের এমন প্রকাশ ঘটেছে যা আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-মিলন বিজড়িত ধুলার ধরণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কৃষ্ণের রূপ, রাধার আকুলতা, মিলনের প্রগাঢ় আকুতি, রাধার অভিসার যাত্রা, শাশুড়ি-ননদের অত্যাচারিত রূপ আমাদের ঘরের কথাকেই চিত্রিত করে। সুতরাং বলা যায়, বৈষ্ণব পদাবলি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও তাতে মানবিক আবেদনই প্রধান হয়ে উঠেছে।