তরাইনের যুদ্ধ:

ইতিমধ্যে আজমিরে চৌহানবংশীয় তৃতীয় পৃথ্বীরাজের (রাই পিথোরা) অভিষেকের কয়েক বছরের মধ্যে রাজপুতানার রাজনীতির দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটেছিল। বহু কাহিনি ও কিংবদন্তীর নায়ক পৃথ্বীরাজ রাজস্থানের ছোটো ছোটো রাজ্যকে বিধ্বস্ত করে আজমিরের রাজ্যসীমা দ্রুত বৃদ্ধি করেছিলেন। মাহবা’র সন্নিকটে চন্দেল্ল-রাজাকে পরাজিত করে পৃথ্বীরাজ গুজরাট আক্রমণ করেন। কিন্তু গুজরাটের শাসক ভীমদেবের কাছে তিনি পরাজিত হন। রাজ্যলিপ্স পৃথ্বীরাজ গুজরাটের কাছে বাধা পাওয়ার ফলে পাঞ্জাব ও গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেন। এখন মহম্মদ ঘুরি ও পৃথ্বীরাজের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মহম্মদ ঘুরি লাহোর দখল করার পর আকস্মিক ভাতিন্দা (বা তরবার হিন্দু) আক্রমণ করেন। ফেরিস্তার বিবরণ অনুযায়ী পৃথ্বীরাজ এই আক্রমণের আকস্মিকতায় প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য দ্রুত তিনি নিজেকে সামলে নেন এবং অবিলম্বে মহম্মদ ঘুরির বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের নিকটবর্তী তরাইনের প্রান্তরে উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। রাজপুত-বাহিনী মুসলমানদের ভীষণভাবে বিধ্বস্ত করে। রাজপুত সেনাপতি স্কন্দ এই যুদ্ধে দারুণ বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এমনকি মহম্মদ ঘুরিও দারুণ আহত হন এবং জনৈক খলজি অশ্বারোহী সৈনিকের সাহায্যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। ঘুরির অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান বাহিনী প্রতিরোধ-শক্তি হারিয়ে পিছু হটতে থাকে। রাজপুতগণ প্রায় ৪০ মাইল তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে যায়। সম্ভবত ইতিপূর্বে মুসলমান বাহিনী এমন জঘন্যভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়নি। Lanepool লিখেছেন : “Never had the armies of Islam been so worsted by the infidels.” সন্ত্রস্ত মহম্মদ ঘুরি লাহোরে থাকাটাও নিরাপদ নয় চিন্তা করে সোজা ঘুর রাজ্যে ফিরে যান। পৃথ্বীরাজ এক বছর অবরোধের পর ভাতিন্দা দখল করতে সক্ষম হন। কিন্তু তরাইনের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ের সুফল আহরণ করার কোনো চেষ্টা করেননি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তৎকালীন ভারতীয় নৃপতিদের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা থেকে তিনিও মুক্ত ছিলেন না। তাই তিনিও ভেবেছিলেন যে, মহম্মদ ঘুরি পাঞ্জাবের অধিকার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন। এই সুযোগে পাঞ্জাব থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করে ভবিষ্যৎ আক্রমণের সম্ভাবনা বিনষ্ট করার কোনো চেষ্টাই পৃথ্বীরাজ করেননি। এমনকি পলায়মান মুসলিম সৈনিকদের বন্দি করে মহম্মদ ঘুরির সামরিক শক্তির ভিতটাকে ভেঙে দেবার কথাও তিনি ভাবেননি।

মহম্মদ ঘুরি পরের বছরেই (১১৯২ খ্রিঃ) প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী-সহ পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করেন। ঘুর আক্রমণের তীব্রতা উপলব্ধি করে পৃথ্বীরাজ উত্তর ভারতের অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সংঘবদ্ধ হবার ও সাহায্যদানের আবেদন জানান। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে অনেকেই তাঁকে সাহায্য পাঠান। কিন্তু সংযুক্তার সাথে পৃথ্বীরাজের বিবাহের ঘটনায় ক্ষুব্ধ কনৌজের রাজা তথা সংযুক্তার পিতা জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজের বিরোধিতা করেন। অবশ্য আধুনিক পণ্ডিতদের মতে, সংযুক্তা-পৃথ্বীরাজ প্রণয়োপাখ্যান ‘পৃথ্বীরাজরসো’ গ্রন্থটি কল্পনাভিত্তিক। কারণ এই উপাখ্যানে এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আছে, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাই মনে হয়, পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে চৌহানবংশের উত্থানে কনৌজের রাঠোরবংশ ঈর্ষান্বিত ও শঙ্কিত ছিল। তাই পৃথ্বীরাজের ধ্বংসকামনায় তারা এই যুদ্ধে নিস্পৃহ থাকে। যাই হোক্, সংখ্যার বিচারে উভয় বাহিনী প্রায় সমান হলেও, তুর্কি অশ্বারোহী ও তিরন্দাজ বাহিনীর ক্ষিপ্রগতি ও রণকৌশলের কাছে রাজপুত বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তুর্কি সেনারা হাসি, সরস্বতী ও সামানা দুর্গগুলি দ্রুত দখল করে নেয়। অবশ্য পৃথ্বীরাজের শেষ পরিণতি সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত আছে। মিনহাজউদ্দিনের মতে, মহম্মদ ঘুরি যুদ্ধের পরে পরেই পৃথ্বীরাজ ও তার ভাইকে নরকে পাঠিয়ে দেন (হত্যা করেন)। চাঁদ বরদাই এর মতে, পৃথ্বীরাজকে বন্দি করে গজনিতে এনে মহম্মদ ঘুরি নিজে হত্যা করেন। কিন্তু হাসান নিজামীর মতে, বন্দি পৃথ্বীরাজকে ঘুরি আজমিরে নিয়ে যান এবং তাঁর বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে আরও কিছুদিন আজমির শাসনের দায়িত্ব দেন। তবে কিছুদিন পরে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে পৃথ্বীরাজকে হত্যা করে তাঁর পুত্র (মতান্তরে জামাতা রাই কোলা) কে আজমিরের শাসক নিয়োগ করা হয়। এই মতটাই অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। কারণ সমকালীন কিছু মুদ্রায় এক পিঠে ‘পৃথ্বীরাজদেব’ এবং অন্য পিঠে ‘শ্রীমহম্মদ সাম’ লেখাগুলি খোদিত ছিল। এইসব মুদ্রা নিজামীর বক্তব্যকেই সমর্থন করে।

‘তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ'(১১৯২ খ্রিঃ) ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই যুদ্ধে চৌহানবীর পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের সুদুরপ্রসারী প্রভাবের গুরুত্ব বোঝাতে কেউ কেউ এই যুদ্ধকে ভারত-ইতিহাসের ‘জলবিভাজিকা’ (Watershed) বলেছেন। বস্তুত ভারতের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই যুদ্ধের গুরুত্ব অস্বীকার করা কঠিন। রাজনৈতিক দিক থেকে এই যুদ্ধে বিজয়ের অব্যবহিত পরেই অবশ্য মহম্মদ ঘুরি এদেশের শাসন-দায়িত্ব সরাসরি নিজের হাতে নেননি; তবে এই জয়লাভের ফলে তিনি নতুন উদ্যমে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। অতঃপর মূলত তাঁর প্রতিনিধিরাই নতুন নতুন ভূখণ্ডে তুর্কি-আধিপত্য প্রসারিত করেন। উপরন্তু ‘তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে’ মহম্মদ ঘুরির সাফল্য একদিকে যেমন ভারতীয় রাজপুত জাতির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা স্পষ্ট করে দেয়, তেমনি ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে অ-হিন্দু বহিরাগত তুর্কিদের অধিষ্ঠানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে। মহম্মদ ঘুরির এই সাফল্যকে ভিত্তি করে অল্পকালের মধ্যে ভারতে সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠা ঘটে। তাছাড়া, তুর্কি শাসনের সূত্রে ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও গুরুতর পরিবর্তনের সূচনা করে। ভারতে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে মধ্য-এশিয়ার সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে ভারতের পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। ভাষা, সাহিত্য, ধর্মভাবনা ইত্যাদি নানাক্ষেত্রে বহির্ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল, ঘটেছিল সংস্কৃতির সমন্বয়। এই যুদ্ধে ভারতীয় সামরিক পদ্ধতির ত্রুটি ও দুর্বলতা আক্রমণকারীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চরম বিপদের মুহূর্তেও রাজপুত শক্তিগুলি সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে পৃথ্বীরাজের আহ্বানে সাড়া দিতে ব্যর্থ হন। এই সত্য মহম্মদ ঘুরিকে নতুন প্রেরণা দেয়। তাই ঐতিহাসিক ভি স্মিথ, (V. Smith) লিখেছেনঃ “It may be regarded as the decisive contest which assured the ultimate success of Muhammadan attack on Hindustan.” এই পরিণতির জন্য পৃথ্বীরাজের অদূরদর্শিতা এবং ব্যক্তিগত ত্রুটিবিচ্যুতিও কম দায়ী ছিল না। আগেই দেখেছি যে, তরাইনের প্রথম যুদ্ধের পর পৃথ্বীরাজের কৌশলগত ত্রুটি মহম্মদ ঘুরিকে পুনরায় শক্তিসঞ্চয়ে ও আক্রমণে পুনর্লিপ্ত হতে সাহায্য করেছিল। রাজপুতদের সংকীর্ণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে তিনিও উঠতে পারেননি। তাই গুজরাটের বিরুদ্ধে মহম্মদ ঘুরির আক্রমণের সময় পৃথ্বীরাজ নির্লিপ্ত থেকে শোলাঙ্কিদের সর্বনাশ কামনা করছিলেন। কিন্তু শোলাঙ্কিদের থেকে বহিরাগত আক্রমণকারীরা যে বেশি বিপজ্জনক—এ সত্য তিনিও উপলিব্ধ করতে পারেননি।

তুর্কিশক্তির অগ্রগতি :

মহম্মদ ঘুরি তরাইনের যুদ্ধে বিজয়ের পর অধিকৃত অঞ্চলসমূহের শাসন-দায়িত্ব তাঁর বিশ্বস্ত ও সুদক্ষ সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবকের ওপর ন্যস্ত করে গজনি ফিরে যান। পৃথ্বীরাজের পুত্রকে রণথম্ভোর দেওয়া হয়। কুতুবউদ্দিন দু-বছরের মধ্যেই বুলন্দ শহর, মীরাট, দিল্লি, পাঞ্জাব, আজমির, কোইল প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর তুর্কি কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত করেন। দিল্লি তুর্কিদের রাজধানী শহরে পরিণত হয়। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি পুনরায় সসৈন্যে ভারতে উপস্থিত হন এবং রাজপুতদের শক্ত ঘাঁটি কনৌজ আক্রমণ করেন। ‘চন্দওয়ার যুদ্ধে’ কনৌজরাজ জয়চাঁদকে পরাজিত করে ঘুরি বেনারস আক্রমণ করেন। এখানে তিনি প্রায় ১ হাজার হিন্দুমন্দির ধ্বংস করেন এবং বহু সম্পদ লুণ্ঠন করেন। অবশ্য রাজপুতদের দীর্ঘ প্রতিরোধ চূর্ণ করে কনৌজ বিজয় সম্পূর্ণ করতে ঘুরিকে প্রায় চার বছর সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। যাই হোক্, কনৌজের পতনের পর তুর্কিদের বিরুদ্ধে রাজপুতদের প্রতিরোধের তীব্রতা অনেকটাই কমে যায়।

১১৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরি বেয়ানা দখল করে বাহাউদ্দিন তুমিলকে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেন। অতঃপর দিল্লির দক্ষিণ দিক সুরক্ষিত করার জন্য তিনি গোয়ালিয়রের দুর্গগুলি দখলের চেষ্টা করেন। সুলক্ষ্মণ পালের দৃঢ় প্রতিরোধের জন্য ঘুরি তাঁর সাথে আপস করেন এবং সুলক্ষ্মণ পালের বশ্যতা আদায় করে ফিরে যান। পরবর্তীকালে বাহাউদ্দিন গোয়ালিয়র দখল করেন। ১১৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন গুজরাট ও অনহিলবারের শাসক দ্বিতীয় ভীমদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং ওই স্থান দখল করে একজন তুর্কি-শাসক নিযুক্ত করেন। অবশ্য অল্পকালের মধ্যেই গুজরাট থেকে তুর্কিরা বিতাড়িত হয় এবং সেখানে শোলাঙ্কিদের কর্তত্ব পুনঃস্থাপিত হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই আইবক চন্দেল্লরাজা পরমার্দিদেবকে পরাজিত করে ‘কালিঞ্জর’, ‘মাহবা’ ও ‘খাজুরাহো’ দখল করেন (১২০২ খ্রিঃ)।