সূচনা: রেলপথ স্থাপনকে ঘিরে উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকে ভারতবাসীর অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির আমলেই ভারতে প্রথম (১৮৫৩ খ্রি., ১৬ এপ্রিল) বােম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ২১ মাইল দীর্ঘ রেলযােগাযােগ স্থাপন করে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে কোম্পানি (GIPR)। কার্ল মার্কসের মত— ভারতের রেলওয়ে ব্যবস্থা হতে হবে প্রকৃত অর্থেই আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রদূত।

উদ্দেশ্য: ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত প্রতিবেদনে বড়ােলাট ডালহৌসি ঘােষণা করেন যে, ভারতীয় অর্থনীতির আধুনিকীকরণের উদ্দেশ্যেই রেলপথ স্থাপন করা হয়। রেলপথ প্রবর্তনে ডালহৌসির ব্যক্তিগত উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল— [i] ভারতের দূরবর্তী জায়গাগুলিতে বিদ্রোহ দমনের জন্য অন্তত দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানাে। [ii] রেলপথের মাধ্যমে যােগাযােগ ব্যবস্থাকে উন্নততর করে তুলে বাণিজ্যিক সুযােগ সুবিধাকে আরও প্রসারিত করা। [iii] রেলপথের মাধ্যমে শিল্প পরিকাঠামাে গড়ে তুলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের শিল্পোদ্যোগকে স্বাগত জানানাে। [iv] দূরবর্তী অঞ্চলগুলি থেকে রেলপথের মাধ্যমে অতি সহজেই বাণিজ্যিক বন্দরগুলিতে কাঁচামাল আদানপ্রদানের সুযােগ বৃদ্ধি করা।

  • অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য: [a] ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের দৌলতে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ ব্রিটিশ পণ্য ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া। [b] শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের হাতে জমে যাওয়া প্রচুর উদ্বৃত্ত পুঁজির লাভজনক বিনিয়ােগের নিরাপদ ক্ষেত্র তৈরি করা। [c] রেলপথকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে এদেশে কর্মসংস্থানের সুযােগ বাড়ানাে।

  • রাজনৈতিক-প্রশাসনিক উদ্দেশ্য: ডালহৌসির শাসনকালে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশাল আকার ধারণ করে। তাই রাজনৈতিক প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বিশাল ওই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দ্রুত সংবাদ আদানপ্রদান ও যােগাযােগ গড়ে তােলার জন্য আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থার প্রয়ােজন দেখা দেয়।

  • সামরিক উদ্দেশ্য: বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহের মােকাবিলা করা, সেনাবাহিনীর কাছে খাদ্য ও রসদ দ্রুত পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি কাজেও রেলপথ অপরিহার্য হল। তাই দেখা যায়, মহাবিদ্রোহের পর তীব্র অর্থসংকট সত্ত্বেও সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে দ্রুত রেলপথ নির্মিত হয়েছে।

রেলপথের প্রবর্তন ও প্রসার: বড়ালাট ডালহৌসির আমলে বােম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত প্রথম রেলপথ চালু হয় (১৮৫৩ খ্রি.)। পরের বছর হাওড়া থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত রেলপথ গড়ে তােলা হয়। ১৮৫৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে এই রেলপথকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ থেকে আর্কট পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয়। এই বছরেই বােম্বাই, কলকাতা ও মাদ্রাজ বন্দর রেলপথের দ্বারা দেশের ভেতরের বিভিন্ন অংশে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৫৭ সালে ভারতে। রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৪৩৯ কিলােমিটার। পরবর্তী দশ বছরে যা বেড়ে হয় ১৩৪৯ কিমি।

প্রাথমিক উদ্যোগ: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আপত্তি সত্ত্বেও ইংরেজ পুঁজিপতিরা ভারতে রেলপথ স্থাপনে যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়। তবে রেলপথে পুঁজি বিনিয়ােগ করে কতটা লাভ করা যাবে তা নিয়ে তারা চিন্তিত ছিল। প্রাথমিক আলাপ আলােচনার পর স্থির হয় যদি আয়ের পরিমাণ লগ্নীকৃত অর্থে শতকরা ৫ ভাগের কম হয় তাহলে সরকার তার রাজস্ব থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ওই অর্থ দেবে। একে গ্যারান্টি প্রথা বলা হয়। গ্যারান্টি প্রথার ফলে বেসরকারি মালিকেরা রেলপথে নিজেদের পুঁজির বিনিয়ােগ থেকে আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তা ছাড়া সরকার ৯৯ বছর ইজারার ভিত্তিতে বিনামূল্যে রেলপথ তৈরির জন্য জমি দিতেও রাজি হয়। বিনিময়ে রেলকোম্পানিগুলি কথা দেয় তারা স্বল্পমূল্যে সেনাদের রেলপথে চলাচলের অধিকার দেবে। এভাবে বেসরকারি উদ্যোগে রেলপথের দ্রুত প্রসার শুরু হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের পর সরকারি উদ্যোগেও রেলপথ তৈরি শুরু হয়। এর দশ বছর বাদে সরকার দেশের বৃহত্তম রেলপথ ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ কিনে নেন। পরবর্তী সময়ে আর্থিক দুর্বলতার কারণে রেলপথ তৈরির কাজ ব্যাহত হলে নতুন রূপে গ্যারান্টি প্রথা চালু করা হয়। এই নতুন ব্যবস্থায় রেলপথে বিনিয়ােগ করা মূলধনের ওপর নতুন সুদের হার নির্ধারিত হয় ৩%। নবনির্মিত রেলপথগুলি ভারত সচিবের সম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এভাবে ভারতে তিন ধরনের রেলপথ চালু হয়।

  • [i] পুরােপুরি সরকার পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত সরকারি রেলপথ, 

  • [ii] কোম্পানির পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত সরকারি রেলপথ এবং 

  • [iii] গ্যারান্টি প্রথাভুক্ত বেসরকারি মালিকানাধীন ও পরিচালিত রেলপথ।

উপসংহার: অনেকেই ভারতে রেলপরিবহণ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানালেও সমকালীন ভারতের বেশকিছু চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী রেলব্যবস্থাকে সুনজরে দেখেননি। দাদাভাই নওরােজি, জি. ভি. জোশি, জি. এস. আয়ার, রমেশচন্দ্র দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলক প্রভৃতি বরেণ্য ব্যক্তি রেলপথের তীব্র সমালােচনা করেছিলেন। তাদের ধারণায় ঔপনিবেশিক স্বার্থে ভারতে রেলব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। তাতে ভারতের কোনাে উপকার হয়নি। ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশও ঘটেনি বা ভারতবাসীর সার্বিক উন্নতিও হয়নি।