প্রশ্নঃ টর্ট আইনে ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া এবং ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনো এর গুরুত্ব উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।
ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া এবং ইনভুরিয়া সাইন ড্যামনো এর গুরুত্ব (Importance of Damnum sine Injuiria and Injuria sine Damno.): ‘ড্যামনাম’ বলতে আর্থিক ক্ষতি, স্বাচ্ছন্দের ব্যাঘাত বা শারীরিক ক্ষতি বুঝায়। ‘সাইন’ শব্দের অর্থ ব্যতীত এবং ‘ইনজুরিয়া’ হচ্ছে বৈধ অধিকার লংঘন, আইনগত ক্ষতি৷ অতএব ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া বলতে আইনগত ক্ষতি ব্যতিরেকে প্রকৃত ক্ষতি বুঝায়। ‘ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনো’ বলতে এর বিপরীত অর্থাৎ প্রকৃত ক্ষতি ব্যতিরেকে আইনগত ক্ষতি বুঝায়।
রোমান আইন হতে উদ্ভূত এ নীতিসমূহ ব্রিটিশ আইনে বিভিন্ন মামলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমানেও চালু আছে। এ সূত্রগুলির দ্বারা আইনগত ক্ষতি এবং প্রকৃত ক্ষতির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়েছে এবং টর্টে নিরঙ্কুশ অধিকার (absolute right) এবং শর্ত সাপেক্ষ অধিকার (qualified right) এর অবস্থান বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়াঃ ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া ম্যাক্সিম দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, বিবাদীর কোন অবৈধ কার্যের দ্বারা বা নিবৃত্তির ফলে বাদীর যদি প্রকৃত ক্ষতি হয়, কিন্তু বৈধ অধিকার লংঘিত না হয়ে থাকে অর্থাৎ আইনগত অধিকার লংঘিত না হয়ে থাকে তবে তা প্রতিকারযোগ্য নয়। বিবাদীর কার্যের ফলে বাদীর অনেক প্রকার ক্ষতি হতে পারে। সকল ক্ষতি প্রতিকারযোগ্য হতে পারে না। এগুলির কারণ বহুবিধ। তবে মূল কারণ হচ্ছে সামাজিক সমস্যা। কোন ব্যক্তি যদি যুক্তিসঙ্গত সীমার মধ্যে তার বৈধ অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অন্যের কিছু অসুবিধার সৃষ্টি করে এবং এজন্য আইনে তাকে জবাবদিহি করতে হয়— তবে এ অধিকার শুধু তাত্ত্বিক অর্থে ব্যবহৃত হবে, প্রকৃত অর্থে নয়। যেমন, বিধিসম্মতভাবে ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা করলে প্রতিদ্বন্ধী ব্যবসায়ীর আর্থিক ক্ষতি হতে পারে কিংবা বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত পরিস্থিতিতে যথা— সংসদে মানহানির উক্তি করলে কারো সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে, কিংবা বৃহৎ স্বার্থ রক্ষার্থে কারো ক্ষুদ্র স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে, কিংবা একজনের আচরণে আর একজন মনক্ষুণ্ণ হতে পারে, কিংবা আর্থিক প্রতিকার ছাড়া অন্য আইনে ভিন্ন প্রতিকার থাকতে পারে। এ সকল ক্ষেত্রে টর্টের মামলা গ্রহণযোগ্য হলে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সামাজিক সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে এগুলি টর্টে মামলাযোগ্য করা হয় নাই সেজন্য স্যামণ্ড (Salmond) বলেছেন : There are many acts which though harmful are not wrongful, and give no right of action to him who suffers their effects. অর্থাৎ অনেক কার্য আছে যা যদিও ক্ষতিকর কিন্তু অন্যায় নয় এবং এর ফলে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাকে মামলা করার কোন অধিকার দেয় না।
এ প্রসঙ্গে পুলকের (Pollock) বক্তব্যঃ বিভিন্ন কাজ কর্ম ব্যতিরেকে সাধারণ জীবন যাপন সম্ভবপর হয় না । কিন্তু এ কাজ কর্ম কম বেশী অন্যের ক্ষতি বা অসুবিধার সৃষ্টি করে এবং এগুলি এভাবে ঘটায় যে এর কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না।
এই নীতিটি ইংলিশ আইনে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪১০ সালে প্রখ্যাত গ্লসেষ্টার গ্রামার স্কুল মামলায়। পরবর্তীকালে অনেক মামলায় এর প্রয়োগ হয়েছে এবং এখনো তা চালু আছে। এই মামলার ঘটনায় প্রকাশ, বাদীর গ্রামার স্কুলের সম্মুখে বিবাদী আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুল স্থাপন করেন । এতে বাদীর স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কমে যায় এবং বাদীকে অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু আইন সম্মতভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য বাদী তার বৈধ অধিকার প্রয়োগ করেছে বিধায় ‘ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া’-এর সূত্র অনুযায়ী মামলাটি টিকে নাই৷
চেসমোর বনাম রিচার্ডসঃ বাদী এক মিল মালিক। প্রায় ৬০ বছর যাবৎ তিনি প্রস্রবণের পানি ভোগ করে আসছিলেন যা ভূগর্ভ হতে চুয়ায়ে আসছিল। বিবাদী পার্শ্ববর্তী জমির মালিক ছিলেন । তিনি নিজ ভূমিতে একটি কুয়া খনন করেন। এর ফলে বাদীর পানি বেশ কমে যায় এবং এ অসুবিধার জন্য তিনি মামলা দায়ের করেন। বিবাদী তার নিজ জমিতে কুপ খনন করেছিলেন এবং এতে বাদীর প্রকৃত ক্ষতি হলেও ‘ইনজুরিয়া’ বা আইনগত ক্ষতি হয় নাই। তাই ‘ ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া’ নীতির ভিত্তিতে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
মোগল স্টীমশীপ কোং বনাম ম্যাকগ্রেগর গাউ এণ্ড কোংঃ বিবাদীরা (কতিপয় জাহাজ কোম্পানী) চীন দেশের চা পরিবহনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করতে সচেষ্ট ছিল। তারা একত্রিত হয়ে পরিবহন ভাড়া হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ শুধু তাদের জাহাজে মালামাল পরিবহন করা হলে এ সুবিধা দিবার ব্যবস্থা করা হয়। পরিবহনের কতিপয় এজেন্টকে বাদীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বিবাদীরা পরামর্শ দেয়। বাদী (অপর জাহাজের মালিক) এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা করে। লর্ডস সভা সিদ্ধান্ত নেন যে, বিবাদীরা তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থ উন্নয়নের জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং তারা কোন প্রকার অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে নাই। তাই ‘ড্যামনাম সাইন ইনজুরিয়া’ নীতি অনুসারে এ মামলাটি নিষ্ফল হয়েছে।
মেয়র অব ব্রাডফোর্ড বনাম পিক্সঃ বিবাদী তার ভূমি খনন করে নিম্নভূমিস্থ পানির প্রবাহকে বাধা দেন। এ প্রবাহ বাদীর জলাধারে গিয়ে পড়তো। বিবাদীর এ কার্যের ফলে বাদী উক্ত পানি হতে বঞ্চিত হন। বিবাদীর ভূমি ক্রয় করতে বাদীকে বাধ্য করার জন্য বিবাদী এ কাজ করেছিলেন। কিন্তু আদালতের মতে একটি বৈধ কাজ খারাপ মোটিভের জন্য অবৈধ হয়ে যায় না যদি না, তা আইনে খারাপ মোটিভ হয়। তাই চেসমোর মামলার নীতি সম্প্রসারিত করে এ মামলাটিও অপ্রতিকারযোগ্য করা হয়।
ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনোঃ ‘ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনো’ সূত্রটির অর্থ হচ্ছে এই যে, বাহ্যিক বা প্রকৃত ক্ষতি ছাড়াও যদি কারো আইনগত ক্ষতি সংঘটিত হয় তবে তা প্রতিকারযোগ্য। (Alterum non laeder) অর্থাৎ কথায় বা কাজে কারো ক্ষতি না করা —সামাজিক এ কর্তব্য ভঙ্গ করলে টর্টের দায় সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে যে, কাজে বা কথায় কেউ ক্ষতি করবে না। অহেতুক কেউ এ অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে টর্টে এর প্রতিকার আছে, কারণ যেখানে অধিকার আছে সেখানে সে অধিকার লংঘনের প্রতিকার আছে। এ ধরনের ব্যক্তিগত অধিকার দু’ধরনের-নিরঙ্কুশ (absolute) এবং শর্ত সাপেক্ষ (qualified)। নিরঙ্কুশ অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে কোন প্রকার ক্ষতির প্রমাণ ছাড়াই তা প্রতিকারযোগ্য। তাই কারো ভূমিতে ট্রেসপাস করলে ক্ষতির প্রমাণ ব্যতিরেকেই টর্টে প্রতিকার পাওয়া যায়। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষ অধিকারের ক্ষেত্রে ক্ষতির প্রমাণ প্রয়োজন। তাই গণ উৎপাতের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে টর্টের প্রতিকার দাবী করলে তার বিশেষ ক্ষতি বা প্রকৃত ক্ষতি প্রমাণ করতে হবে। সামাজিক অসুবিধার কথা বিবেচনা করেই এটা করা হয়েছে। গণ উৎপাতের ফলে অনেক লোকই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু সকলকে টর্টের প্রতিকার দিতে হলে অসংখ্য মামলা হতে পারে যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর নয়। তাই এক্ষেত্রে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত লোকের চেয়ে বাদীর ক্ষতি একটু বিশেষ ধরণের তা প্রমানের প্রয়োজন।
এ প্রসংগে নিম্নোক্ত মামলাগুলি উল্লেখযোগ্যঃ
এ্যাসবী বনাম হোয়াইটঃ ১৭০৩ সালে প্রখ্যাত এ্যাসবী বনাম হোয়াইট মামলায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, প্রতিটি অপকার বা অন্যায় কাজ আইনগত ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে যদিও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের এক কপর্দকও বাস্তব ক্ষতি হয় না। বিবাদী ছিলেন একজন রিটার্নিং অফিসার। বাদীর ভোট দানের বৈধ অধিকার তিনি অস্বীকার করেছিলেন। বাদী যার অনকূলে ভোট দিতে গিয়েছিলেন তিনি বাদীর ভোট ছাড়াই জয়লাভ করেছিলেন। অতএব এই ভোট অস্বীকার করার ফলে কারো কোন প্রকৃত ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু যেহেতু বাদীকে তার বৈধ অধিকার প্রয়োগ করা হতে বঞ্চিত রাখা হয়েছে সেহেতু ‘ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনো’ নীতি অনুসারে বাদী ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকারী বলে আদালত রায় দেন।
ম্যাজেটি বনাম উইলিয়ামঃ বিবাদী একজন ব্যাংকার এবং বাদী একজন গ্রাহক ছিলেন। বাদীর হিসাবে যথেষ্ট অর্থ থাকা সত্ত্বেও বাদী কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি চেক প্রত্যাখ্যাত হয়। এতে বাদীর প্রকৃত কোন ক্ষতি হয় নাই। তবুও ইনজুরিয়া সাইন ড্যামনো নীতি অনুসারে বিবাদীকে দায়ী করা হয়।
Leave a comment