অথবা, সমালােচনাসহ বুদ্ধিবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসাবে বুদ্ধিবাদের বর্ণনা দাও।
ভূমিকাঃ ইংরেজি ‘ইপিসটেমােলজি’ শব্দ থেকে জ্ঞানবিদ্যা শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। আর আধুনিক দর্শন মূলত জ্ঞানবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল। যথাথ দর্শনে ঢুকতে হলে তার প্রধান একমাত্র দ্বার জ্ঞানবিদ্যা। দর্শনের যে শাখা জ্ঞানের উৎপত্তি, প্রকৃতি, পরিণতি, শর্ত, সীমা, বৈধতা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলােচনা করে তাকে জ্ঞানবিদ্যা বলে। এই জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। অতীতে দর্শনে অধিবিদ্যার তুলনায় জ্ঞানবিদ্যা কিছুটা উপেক্ষিত হলেও আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে ক্রমশ তা অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করে। জ্ঞানের স্বরূপ, উৎপত্তি, সীমা, বৈধতা ও যথার্থতা ইত্যাদি নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতবিরােধের ফলে দর্শনের ইতিহাসে জ্ঞানের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে বুদ্ধিবাদ অন্যতম একটি প্রধান মতবাদ। জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে বুদ্ধিবাদ সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হলাে-
বুদ্ধিবাদঃ বুদ্ধিবাদের মূল বক্তব্য হলাে:জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েই লাভ করা যায়। যে মতবাদ বিশুদ্ধ বুদ্ধিকে সার্বিক ও নিশ্চিত জ্ঞানের উৎস বলে মনে করে তাকেই বুদ্ধিবাদ বলে। বুদ্ধিই যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রধান উপায়, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বস্তুর বাহ্যরূপেই সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি সে জ্ঞান অসঙ্গত এবং অসম্পূর্ণ। অতএব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের মাধ্যমে তত্ত্বালােচনা করা যায় না। তাই বুদ্ধিবাদী দার্শনিকেরা বুদ্ধিকেই জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় ও উৎস হিসেবে উল্লেখ করেন। বুদ্ধিবাদীদের মতে আমাদের জ্ঞান অভিজ্ঞতাপূর্ণ। এর জন্য কোনাে অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন হয় না। বুদ্ধিবাদীদের মতে, মন বা আত্মা হলাে প্রধানত সক্রিয়। বুদ্ধি এর স্বাভাবিক গুণ। প্রাচীন বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য তারা হলেন সক্রেটিস ও প্লেটো। নব্য পাশ্চাত্য দর্শনের জনক বুদ্ধিবাদের প্রধান পুরােহিত হলেন ডেকার্ট। স্পিনােজা, ভলফ ও লাইবনিজও নামকরা বুদ্ধিবাদী। এরা সবাই স্বীকার করেন যে, বুদ্ধির সাহায্যেই নিশ্চিত ও যথার্থ জ্ঞান লাভ সম্ভব। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান সঠিক নয়। এ জ্ঞান অসঙ্গত এবং অযথার্থ।
বুদ্ধিবাদের বৈশিষ্ট্যঃ উপরােক্ত আলােচনা থেকে বুদ্ধিবাদের কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা: (ক) বুদ্ধিবাদ একটি অবরােহমূলক প্রক্রিয়া। (খ) বুদ্ধিবাদ অনুসারে বুদ্ধিই একমাত্র জ্ঞানের উৎস বলে বিবেচিত হয়। (গ) বুদ্ধিবাদ সর্বজনীন জ্ঞান সংগ্রহ করে। (ঘ) বুদ্ধিবাদ নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে। (ঙ) বুদ্ধি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ জ্ঞান দেয়। (চ) বুদ্ধি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান স্থান-কাল-পাত্রভেদে অভিন্ন। (ছ) বুদ্ধিবাদ অনুসারে মন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
বুদ্ধিবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতামতঃ নিম্নে বুদ্ধিবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতামত তুলে ধরা হলাে-
ডেকার্টঃ মধ্যযুগে সমস্ত বিশ্বাসকে সন্দেহাকারে ডেকার্ট তার দার্শনিক আলােচনা করেন। তিনি তিন প্রকার ধারণার কথা বলেছেন। যেমন (ক) আগন্তুক ধারণা, (খ) কৃত্রিম ধারণা ও (গ) অন্তর বা সহজাত ধারণা।
(১) আগন্তুক ধারণাঃ যেসব ধারণা বাইরে থেকে আমাদের মনে আসে সেগুলােকে বলে আগন্তুক ধারণা। যেমন বাড়ি, নদী, পাহাড় ইত্যাদি। এ ধারণা স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও উজ্জ্বল নয়।
(২) কৃত্রিম ধারণাঃ আমাদের মনের বিভিন্ন ধারণার সাথে যােগ-বিয়ােগের ফলে যে ধারণার উৎপত্তি হয় সেগুলাে কৃত্রিম ধারণা। যেমন-পঙ্খিরাজ ঘােড়া, সােনার হরিণ ইত্যাদি। এ ধারণা স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও উজ্জ্বল নয়।
(৩) অন্তর ধারণাঃ ডেকার্ট-এর মতে কতকগুলাে অন্তর ধারণা ঈশ্বর জন্ম থেকেই আমাদের মনে মুদ্রিত করে দিয়েছেন। যেমন- অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণসত্তা বা ঈশ্বরের ধারণা। তার মতে, সুস্পষ্টতা এবং প্রাঞ্জলতাই এসব ধারণার সত্যতা প্রমাণ করে। এগুলাে স্বতঃসিদ্ধ। এসব অন্তর ধারণা থেকেই আমরা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে দার্শনিক জ্ঞান লাভ করে থাকি।
ডেকার্টঃ ডেকার্ট মনে করেন, জ্যামিতিতে যেমন কতকগুলাে স্বতঃসিদ্ধ সূত্র আছে যেগুলাে অবরােহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত চনা হয়, তেমনি মানুষের মনেও কতকগুলাে স্বতঃসিদ্ধ অন্তর ধারণা আছে যেগুলাে থেকে অবরােহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত টানা হয়। তিনি মনে করেন, দার্শনিক সত্য গাণিতিক সত্যের মতাে সুনিশ্চিত এবং যথার্থ।
স্পিনােজাঃ বুদ্ধিবাদী দার্শনিক স্পিনােজাও ডেকার্টের মতাে অন্তর ধারণা অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তিনি ঈশ্বর সম্বন্ধীয় অন্তর ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে জ্যামিতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে, অবরােহের সাহায্যে জীবাত্মা ও জীবজগতের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
লাইবনিজঃ জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ বলেন, জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায়। তবে ইন্দ্রিয় কখনও যথার্থ জ্ঞানের সন্ধান দিতে পারে না। যথার্থ জ্ঞান একমাত্র বুদ্ধির সাহায্যেই লাভ করা যায়।
ভল্ফঃ চরমপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ভলফ বলেন, আমাদের মনে কতকগুলাে মৌলিক বা সহজাত ধারণা আছে। এসব ধারণা থেকে অবরােহ পদ্ধতিতে জগৎ, আত্মা, ঈশ্বর ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানলাভ করা যায়।
সমালােচনাঃ জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে বুদ্ধিবাদ সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি। এ মতবাদের ত্রুটিগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে-
(১) সহজাত ধারণার অস্তিত্ব প্রশ্নসাপেক্ষঃ আমরা জানি যে বুদ্ধিবাদ সহজাত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই সহজাত ধারণার অস্তিত্ব প্রশ্নসাপেক্ষ। অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকগণ সহজাত ধারণার অস্তিত্বে সংশয় প্রকাশ করেন। তাদের মতে, যদি সহজাত ধারণার অস্তিত্ব থাকত তাহলে এসব ধারণা সবার মনে সমানভাবে উপস্থিত থাকত।
(২) বুদ্ধিবাদীদের সিদ্ধান্তে পার্থক্য বিদ্যমানঃ বুদ্ধিবাদীদের মতে, বুদ্ধি জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এখন প্রশ্ন হলাে বুদ্ধিই যদি জ্ঞানের একমাত্র উৎস হয় তাহলে বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞানের সিদ্ধান্ত এক নয় কেন? এজন্য বুদ্ধিবাদীদের সিদ্ধান্তে পার্থক্য বিদ্যমান।
(৩) বুদ্ধিবাদ মনােজগতের জ্ঞান দেয় নাঃ বুদ্ধিবাদীদের জ্যামিতিক পদ্ধতি বহিঃজগতের জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে সর্বাংশে কার্যকর, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানসিক পদ্ধতিতে এ পদ্ধতি কার্যকর নয়। বহিঃজগতের জ্ঞানের মতাে মনােজগতের জ্ঞানও আমাদের দরকার-এ সম্পর্কে বুদ্ধিবাদীরা নির্বাক।
(৪) বুদ্ধিবাদ জ্ঞানের একটি দিক ব্যাখ্যা করেঃ বুদ্ধিবাদীদের মতে, বুদ্ধিই জ্ঞানের একমাত্র উত্স। কিন্তু কান্ট পরে দেখিয়েছেন যে, জ্ঞানের জন্য বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দুটোরই সমান গুরুত্ব রয়েছে। বুদ্ধি দেয় আকার এবং অভিজ্ঞতা দেয় উপাদান। এদের সমন্বয়েই জ্ঞান।
(৫) গাণিতিক জ্ঞান ও দর্শনের জ্ঞান এক নয়ঃ সহজাত ধারণালব্ধ গাণিতিক জ্ঞান ও দর্শনের জ্ঞান এক নয়। গণিতের জ্ঞান অমূর্ত বিষয় সম্পর্কে আর দর্শনের জ্ঞান মূর্ত বিষয় সম্পর্কে। আর অভিজ্ঞতা ছাড়া মূর্ত জ্ঞান পাওয়া সম্ভব নয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কোনাে বিচার না করেই বুদ্ধিকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলা অযৌক্তিক। আসল কথা কোনাে কিছুকে সােজাসুজি জানার পথ বুদ্ধি নয়। আমরা আগে যা জেনেছি বুদ্ধি দিয়ে তার সত্যাসত্য বিচার করি। কাজেই বুদ্ধিবাদ স্বয়ংসম্পূর্ণ মতবাদ নয়।
Leave a comment